নৌকা ভ্রমণ
এসএম সুরুজ আলী

পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সচরাচর ঘুরতে যাওয়া হয়নি। তবে প্রতি বছর বর্ষা মওসুমে নৌকা ভ্রমণে একবার যাওয়া হয়। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যদিও বিভিন্ন সময় ভাটি এলাকাতে যাই সেই যাওয়াটি শুধু দায়িত্বের মাঝে বন্দি থাকে। এবারও পবিত্র ঈদুল আযহার দু’দিন পর বানিয়াচং উপজেলাধীন আমাদের আতুকুড়া গ্রামের যুব সমাজের পক্ষ থেকে নৌকা ভ্রমণের আয়োজন করা হয়। প্রথমে যদিও আমার যাওয়ার ইচ্ছা ছিল না। পরবর্তীতে বন্ধু-বান্ধবসহ আয়োজকদের অনুরোধে নৌকা ভ্রমণে গিয়েছিলাম। এই প্রথম আমার সাথে নৌকা ভ্রমণে গিয়েছিল আমার ছেলে এসএম সাইফ আলী আবির। সকাল ৮টার দিকে আতুকুড়া বাজার থেকে আমরা প্রায় দেড়শত ভ্রমণ প্রেমীরা নৌকা নিয়ে কিশোরগঞ্জ জেলার মিটাইমনের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করি। নৌকা ছাড়ার পর ভ্রমণ প্রেমিরা কেউ নৌকা ভেতরে আর কেউ নৌকার উপরে বসেন। এরপর হবিগঞ্জের এক সময়ে জনপ্রিয় কন্ঠশিল্পী শাহ আলম চৌধুরী মিন্টুর তত্ত্বাবধানে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আগত শিল্পীদের গান পরিবেশন শুরু হয়। গান শুনতে শুনতে আর নৌকায় আনন্দ উল্লাস করতে করতে বেলা ১টার দিকে মিটাইমন এলাকায় আমাদের নৌকা গিয়ে পৌছে। এর মধ্যে আমরা হাওর জলরাশি ঢেউয়ে খেলা ও প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করি। মিটাইমন এলাকায় যাওয়ার পরই হাওরে বর্তমান সরকারের উন্নয়নের চিত্রগুলো আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠে। চারদিকে পানি আর পানি এর মধ্যে এতো সুন্দর রাস্তা, ব্রীজ, কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে। সেই সৌন্দর্য্যগুলো কাছে গিয়ে উপভোগ করতে মন চাচ্ছে। এর মাঝে নৌকার মাঝিকে বললাম রাস্তায় নৌকা লাগাতে। নৌকা মাঝি জানালেন মিটাইমন বাজার থেকে ফিরে আসার সময় রাস্তায় নৌকা লাগাবেন। আমি আর কিছু বললাম না নৌকা চলে যাচ্ছে মিটাইমন বাজারে দিকে। আমরা কেউ গান শুনছি আবার কেউ সেলফী তুলছি। এর মধ্যে বাজারের কাছে নৌকা আসার পর চোখের সামনে ভেসে উঠলে কাঠ আর কাঠ। যখন ছোট ছিলাম আমাদের বাড়িতে কোন প্রকার কাঠের প্রয়োজনে হলে আমাদের বাড়ি লোকজন কাঠ ক্রয় করার জন্য নৌকা দিয়ে মিটাইমন বাজারে ছুটে যেতেন। একবার মিটাইন বাজার থেকে কাঠ ক্রয় করে বাড়িতে ফেরার সময় আমার বড় ভাইসহ তার সাথে যারা নৌকাতে ছিলেন তারা ডাকাতের আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন। এ ঘটনাটি আমার মনে পড়ে গেল। নৌকা বাজারে লাগানোর পরই স্থানীয় লোকজনদের সাথে আলাপ করে জানতে পারলাম এটি একটি প্রাচীন কাঠ বাজার। এখানে দেশের বিভিন্ন প্রজাতির কাঠ পাওয়া যায়। এর পর আমরা বাজারটি ঘুরে দেখলাম। অনেকেই বাজারে নাস্তা করেছেন। বাজারের কিছু দুরেই মহামান্য রাষ্ট্রপতি অ্যাডভোকেট আব্দুল হামিদ এর বাসভবন। যার কথা এতক্ষণ লেখিনি। লেখলেই সারামর্ম তার উপর লিখতে হবে। আমাদের অনেকেই রাষ্ট্রপতির বাড়িটি গিয়ে দেখেছেন। কিন্তু কিছু দিন পূর্বে রাষ্ট্রপতির ছোট ভাই মারা যাওয়ার কারণে বাড়িতে তার পরিবারের লোকজন অবস্থান করায় কঠোর নিরাপত্তা জোরদার ছিল। যে কারণে কেউ বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করতে পারেননি। মূলত এ অঞ্চলের উন্নয়ন রাষ্ট্রপতি নিজেই করেছেন। আর এই উন্নয়নকে কেন্দ্র করেই হাওর অঞ্চলে পর্যটন এলাকা গড়ে উঠেছে। বাজারে অবস্থানকালে অনেক ব্যবসায়ী ও বয়স্ক লোকজনদের সাথে কথা বলে মহামান্য রাষ্ট্রপতির কৈশোর কাল কিভাবে কেটেছে তা জানতে পারলাম। বাজারের পাশের নদীতেই রাষ্ট্রপতি সাতার কাটতেন। পাশের মাঠে খেলাধুলা করতেন। এ এলাকায় রাষ্ট্রপতির অনেক স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে। ওই এলাকার বর্তমান সংসদ সদস্য রাষ্ট্রপতির ছেলে হলেও কোন প্রকার বড় ধরণের সমস্যা দেখা দিলে তা রাষ্ট্রপতি নিজেই মীমাংসা করে দেন। সেটি বঙ্গভবনে বসে কিংবা মোবাইল ফোনে। এখনও রাষ্ট্রপতি এলাকায় গেলে প্রটোকল ছাড়া রাস্তায় বের হন। তার প্রিয় এলাকার মানুষের সাথে সাক্ষাত করেন। রাষ্ট্রপতি এখনও এলাকার মানুষের সাথে আলাপকালে বলেন- কৈশোর ও যৌবনকালে এলাকার যে রূপ ছিল তা আর এখন নেই। সময়ের সাথে সব কিছুইর পরিবর্তন হয়েছে। মানুষের মনে অনেকটা পরিবর্তন এসেছে। তবে কিছু মানুষ এখনও আগের নিয়মে চলছেন। যাই হোক দুপুর দেড়টার দিকে আমরা নৌকা নিয়ে চলে যাই কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম, ইটনা রাস্তার মিটামইন এলাকায় নির্মিত সেতুর পাশে। সেখানে গিয়ে দেখি হবিগঞ্জ থেকে আরো বেশ কয়েকটি নৌকায় ভ্রমণপিপাসুরা এসেছেন। শুধু হবিগঞ্জ জেলা নয়, কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, সিলেট, নরসিংদীসহ বিভিন্ন জেলার লোকজন এসেছেন। মূলত ঈদুল আযহাকে কেন্দ্র করে নৌকা ভ্রমণে গিয়েছেন অনেকেই। সেতুর কাছে নৌকা লাগানোর পরই সেতুর নিচে দিয়ে পানির যে স্্েরাত দেখে ভ্রমণ পিপাসুরা স্্েরাতে নেমে সাতরিয়ে উল্লাস করছেন। আমি নিজেই আমার ছেলেকে নিয়ে পানিতে নামলাম। পানিতে নেমে সাতার কাটলাম। তবে পানি যে ¯্রােত, সেই ¯্রােতে সাবধানতা অবলম্বন না করলে যে কাউকে ভাসিয়ে নিতে পারে। অনেকটা সতর্কতার মধ্যে গোসল শেষ করেছি। এর মধ্যে প্রশাসনের লোকজন এসে নৌকাগুলো ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশনা দেয়। অন্যথায় জরিমানা করা হবে। তারও কারণ জানলাম সেটি হলো করোনা। এই করোনার কারণে ঘরবন্দি মানুষগুলো কোথাও বের হয়ে শান্তিÍ পাচ্ছেন না। তবে এ পরিস্থিতিতে সকলকে স্বাস্থ্যবিধি মনে চলা উচিত। জরিমানার ভয়ে নৌকার মাঝি তাৎক্ষণিক এখান থেকে আবারও নৌকা ছেড়ে আমরা বাড়ি’র উদেশ্যে রওয়ানা দিলাম। যতক্ষণ মিটামইনের বিশাল হাওরে নৌকা ছিলো। হাওরে ঢেউয়ের মাঝে নৌকায় লাফালাফি করলেও মনের ভিতরে ভয় জেগেছিল। কখন নৌকা ডুবে যায়। আর এই নৌকা ডুবলে আমি আমার সন্তানকে কিভাবে বাঁচাবো। আমি বাঁচার বিষয়টি প্রাধান্য দেই কিভাবে আমার সন্তানকে বাঁচাবো। এসব ভাবতে ভাবতে সন্ধ্যার দিকে বিথঙ্গল আখড়া উঠলাম। তারপর আমাদের অনেকেই আখড়া পরিদর্শন করেছেন। আখড়া পরিদর্শন শেষে আবারও আমরা বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। নৌকাতে গানের তালে অনেকেই নাচা-নাচি করছেন। যদিও সেই গানের নাচের স্বাদ আমি নিজেও উপভোগ করেছি। কিন্তু সন্তানকে সাথে নেয়ায় মনে ছিল অজানা এক আতংক। কখন নৌকা ডুবে যায়। শুধু নৌকা ডুবার বিষয়টি নয়। ইতিপূর্বে ভ্রমনকারী নৌকা বিদ্যুতের তারের সাথে লেগেও প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। তাই যারাই নৌকা ভ্রমণে যাবেন। অনেকটা সতর্কতার সাথে যাবেন। সে ক্ষেত্রে শিশু সন্তানদের সাথে না নেয়াই ভালো। যদি সাথে নেন মনের মাঝে সারাক্ষণ আমার মতো আতংক বিরাজ করবে। আমাদের নৌকা রাত ৮টার দিকে যখন আতুকুড়া বাজারে ফিরলো, তখন আমার মনের আতংক কাটলো।
লেখক সংবাদকর্মী ও মানবাধিকার কর্মী