
আবুল কালাম আজাদ, চুনারুঘাট থেকে ॥ হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার ২৪টি চা বাগান নানা সংকটে পড়েছে। উৎপাদন হ্রাস, আর্থিক সংকট, বিগত দিনের নানা দুর্নীতি ও অনিয়ম, ব্যাংক ঋণ জটিলতা, জলবায়ূ পরিবর্তনের প্রভাব, চায়েল মূল্য না বাড়া, বাগানে ঘনঘন অবরোধ ধর্মঘট ও নানা রোগে আক্রান্ত চা বাগানগুলো এখন আর উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারছে না। পাশাপাশি চরম আর্থিক সংকটে বেশ কয়েকটি বাগান বন্ধ হওয়ার পথে রয়েছে।
উপজেলার লস্করপুর ভ্যালীর ২৪টি চা বাগানের মধ্যে ১৭টি মূল বাগানে ফ্যাক্টরী রয়েছে। এসব বাগান থেকেই মূলত চা তৈরী ও বাজারজাত করা হয়। এর মধ্যে ডানকান ব্রাদার্স, দেউন্দি টি কোম্পানী, ন্যাশনাল টি কোম্পানী ও ব্যক্তি মালিকানাধীন বাগানই বেশি। এসব বাগানের মধ্যে দেউন্দি টি কোম্পানীর দেউন্দি, লালচান্দ, নোয়াপাড়া, ন্যাশনাল টি কোম্পানীর চন্ডিছড়া, পারকুল ও তেলিয়াপাড়া চা বাগান প্রচ- ঝুঁকির মুখে রয়েছে। চায়ের উৎপাদন কমে যাওয়া, অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে অর্থনৈতিক মন্দা, বাজারমূল্যে ধ্বস, বৈরী প্রকৃতিসহ নানা কারণে এসব বাগান এখন শ্রমিকদের মজুরিই ঠিকমতো দিতে পারছে না। এসব বাগানে শ্রমিকদের মজুরি বকেয়া রয়েছে। বিশেষ করে দেউন্দি টি কোম্পানীর বাগানগুলো অর্থ সংকটে এখন চালানোই কঠিন হয়ে পড়েছে।
তার উপর এসব বাগান ক্রমাগত লোকসান দিচ্ছে। কয়েক বছর ধরে এনটিসির চন্ডিছড়া, পারকুল ও তেলিয়াপাড়া চা বাগানে লোকসান হচ্ছে। গত ১০/১২ বছর ধরেই সিন্ডিকেটের কারণে নিলাম বাজারে চায়ের ন্যায্যমূল্য পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে ক্রমাগত লোকসান গুনতে হচ্ছে বাগানগুলোকে।
চা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, বিগত সময়ের অনিয়মগুলোর ভোগান্তি বইতে হচ্ছে তাদের। এ সংকট কাটিয়ে উঠতে না পারলে চা বাগানগুলো চিরতরে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ইতোমধ্যে অর্থ সংকটে দেউন্দি ও লালচান্দ চা বাগানের কারখানা দুদফা বন্ধ হয়েছে। রয়েছে গ্যাস বিদ্যুতের বিল বকেয়া।
দেউন্দি চা বাগানের সিনিয়র ম্যানেজার রিয়াজ উদ্দিন জানান, বাগানগুলোর আর্থিক সংকট দূরীকরণে চার থেকে পাঁচ ভাগ হারে ব্যাংক ঋণ প্রদানসহ নানা অসুবিধা দূরীকরণে বাগান মালিকরা চা সংসদের চেয়ারম্যানের পদক্ষেপ দাবি করেছেন। একই সঙ্গে তারা চা শিল্পকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে কৃষি মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত, সিলেটে একটি নিলাম কেন্দ্র স্থাপন, চা বেশি পরিমাণে রপ্তানি, চা শ্রমিকদের ভূমির অধিকার নিশ্চিত করার উদ্যোগসহ ১২টি প্রস্তাবনা চা সংসদের চেয়ারম্যান বরাবর উত্থাপন করেছেন। একই সঙ্গে তারা উত্তরাঞ্চলে মান নিয়ন্ত্রণহীনভাবে চায়ের উৎপাদনে চায়ের দর পতনের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে উত্থাপন করেছেন।
চন্ডিছড়া চা বাগানের ম্যানেজার সেলিমুর রহমান জানান, এ বছর চায়ের উৎপাদন অনেক কমে গেছে। এখন পর্যন্ত ভ্যালীতে প্রায় ১৯ শতাংশ উৎপাদন ঘাটতি রয়েছে। কিন্তু উৎপাদন খরচ বেড়েছে। চা বাগান এখন টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। স্বল্প সুদে সরকার ব্যাংক ঋণ দিলে বাগান বাঁচিয়ে রাখা যাবে।
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের (বাচাশ্রই) ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নিপেন পাল বলেন, চা শ্রমিকদের অধিকাংশই নারী, যারা তাদের পরিবারের অর্থনৈতিক ভিত্তি গড়ে তুলতে চা শিল্পের ওপর নির্ভরশীল। তাই শ্রমিকদের ভূমি অধিকার সুরক্ষা, ন্যায্য মজুরি নিশ্চিতকরণ এবং কল্যাণমূলক কার্যক্রম গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি।
সিনিয়র টি প্লান্টার এবং বাংলাদেশীয় চা সংসদের সিলেট ব্রাঞ্চ প্রতিনিধি ইবাদুল হক বলেন, সরকার নিলাম মূল্য প্রতি কেজি চা ২৪৫ টাকা নির্ধারণ করে দিলেও সিন্ডিকেটের তৎপরতায় বাগান মালিকসহ সংশ্লিষ্টরা এ নিয়ে শঙ্কিত। এ অবস্থায় চায়ের কাক্সিক্ষত দাম পাওয়া না গেলে চায়ে লোকসান বাড়বে। দেশের চা বাগানগুলো আদৌ টিকে থাকবে কিনা, সন্দেহ আছে।
তিনি বলেন, ২০১৫ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত চায়ের উৎপাদন খরচ বেড়েছে ৫৮ দশমিক ৩০ শতাংশ। একই সময়ে চায়ের দর বেড়েছে ৯ দশমিক ১৬ শতাংশ। দামের তুলনায় উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় চা শিল্পের আর্থিক সক্ষমতা কমেছে। তাই চা শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে প্রতি কেজি চায়ের গড় দাম ৩০০ টাকায় উন্নীত করতে হবে।