পাঁচ দিনের উত্তেজনার পর ৪ ঘন্টাব্যাপী ভয়াবহ সংঘর্ষে আহত হয়েছেন কয়েক শতাধিক ॥ অসংখ্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বেসরকারী হাসপাতাল ট্রাক বাস সিএনজি অটোরিকশা মোটরসাইকেলে আগুন ভাংচুর লুটপাট ॥ কয়েক কোটি টাকার ক্ষতি ॥ ১৪৪ ধারা অমান্য করে কয়েকঘন্টা চলে সংঘর্ষ

এম,এ আহমদ আজাদ, নবীগঞ্জ থেকে ॥ হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ শহরে দুই এলাকাবাসীর ৫দিনের উত্তেজনার পর ৪ ঘন্টাব্যাপী সংঘর্ষে একজন নিহত ও শতাধিক আহত হয়েছে। সংঘর্ষ চলাকালে ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান, বেসরকারী হাসপাতাল ও যানবাহনে ভাঙচুর-লুটপাট এবং ট্রাক, বাস, সিএনজি, ভাংচুর এবং মোটরসাইকেলে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। ভাঙচুর ও লুটপাটে অন্তত কয়েক কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। গতকাল সোমবার বিকাল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত সংঘর্ষ চলে। বিকাল ৪টায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও নবীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ রুহুল আমিন নবীগঞ্জ শহরে ১৪৪ ধারা জারি করেন। কিন্তু ১৪৪ ধারা জারির পরেও ৩ ঘন্টা সংঘর্ষ চলে। পরে যৌথবাহিনীর সদস্যরা মাইকিং করে লোকজন অথবা মিডিয়াকর্মীদের সরে যাওয়ার জন্য। যৌথবাহিনী ব্যাপক লাঠিচার্জ করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করেন। এরিপোর্ট লেখা পর্যন্ত থেমে থেমে চোরাগুপ্তা হামলা চলছিল। সংঘর্ষ চলাকালে কয়েকটি ককটেল বিস্ফোরণ হয়। এসময় বিদ্যুতের ট্রান্সমিটার পুড়ে যায়, নবীগঞ্জ শহর বিদ্যুবিহীন রয়েছে। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী সংঘর্ষে আহত পূর্ব তিমিরপুর গ্রামের আউয়াল মিয়ার পুত্র ফারুক মিয়া (৪৫) সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে যাওয়ার পথে রাত ৮টার দিকে মারা যান। আশংকাজনক অবস্থায় উভয়পক্ষের ২০ জন সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্র্তি রয়েছেন।
নবীগঞ্জ উপজেলা গণঅধিকার পরিষদের সহ সভাপতি ও যুবলীগের সাবেক নেতা আশাহিদ আলী আশা ও নবীগঞ্জ প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও নবীগঞ্জ পৌর বিএনপির সদস্য সেলিম তালুকদার এর মধ্যে বিরোধের জের ধরে গত শুক্রবার সন্ধ্যায় সেলিম তালুকদার এর শ্যালক খসরু মিয়া তালুকদার এর সাথীদের সাথে আশাহিদ আলী আশার কথাকাটাকাটি ও মারপিট হয়। এর জের ধরে গত ৪দিন ধরে উত্তেজনা ও হামলা পল্টা হামলা চলে আসছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে সোমবার সংঘর্ষের সুত্রপাত হয়।
সোমবার সকালে আনমনু ও পূর্ব তিমিরপুর গ্রামের লোকজন পুর্ব ঘোষনা দিয়ে নিজ নিজ এলাকায় পুর্ব প্রস্তুতিমুলক মিটিং করেন। এর পরে বিকাল ৩টায় ঘোষনা দিয়ে উভয় গ্রামের শত শত মানুষ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে শহরের মারামারি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় রুপ নেয়। নবীগঞ্জ শহরে আশপাশের তিন চারটি মৎস্যজীবি গ্রামের লোকজন এক পক্ষে, পূর্ব তিমিরপুর, পশ্চিম তিমিরপুর ও চরগাও গ্রামের নারী পুরুষ দুটি পক্ষ হয়ে কয়েক হাজার মানুষ সংঘর্ষে জড়ান। সংঘর্ষ চলাকালে শহরের মধ্যে দুই শতাধিক দোকান পাট ভাংচুর ও লুটপাট হয়েছে। সংঘর্ষ চলাকালে কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আগুন দেয়া হয়। বিশেষ করে কয়েকটি মৎস্যজীবি সম্প্রদায়ের মালিকাধীন ইউনাইডেট হসপিটাল ভাংচুর, মাছ বাজার ভাংচুর লুটপাট হয়েছে। এছাড়া শহরের পশ্চিম বাজারে প্রতিটি মার্কেট ও দোকানপাট ভাংচুর লুটপাট হয়েছে।
গত শনিবার রাতে সংঘাতের পর পুলিশ ও সেনাবাহিনীর যৌথ অভিযান শহরের পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত করলেও পরদিন শনিবার সকাল থেকে আবার উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। আনমুনু গ্রামের লোকজন দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে নবীগঞ্জ শহর ও আনমনু পয়েন্টে জড়ো হতে থাকলে আতঙ্কে দোকানপাট বন্ধ করে দেন ব্যবসায়ীরা। এর জের ধরে শহরে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে পড়ে। রবিবার সকালে ও রাতে সংঘর্ষ ও চোরাগুপ্তা হামলা হয়। এর জের ধরে সোমবার সকালে উভয় গ্রামের লোকজন পূর্ব প্রস্তুতি সভা করে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়।
শনিবার (৫ জুলাই) সকালে নবীগঞ্জ শহরে উপজেলার ৬নং কুর্শি ইউনিয়নের বাংলাবাজার এলাকার এক নিরীহ গাড়ি চালকের ওপর আনমনু গ্রামের লোকজন হামলা চালায়। চালককে আটকে বেধড়ক মারধরের পাশাপাশি তার গাড়িও ভাঙচুর করা হয়। এমনকি তার গলা বরাবর ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করার চেষ্টা করা হয়। ভাগ্যক্রমে চালক সরে গিয়ে প্রাণে বেঁচে যান। এসময় গাড়ির চাবি, গাড়ির কাগজ এবং গাড়িতে থাকা দুটি ফোন ও টাকা লুট করে নিয়ে গেছে বলে জানান শ্রমিকরা। এ ঘটনায় শ্রমিকদের মধ্যে ব্যাপক উত্তেজনা বিরাজ করছে। শহরের সংঘর্ষের সময় সুযোগ নিয়ে হামলা ও লুটপাট চালায় একটি সংঘবদ্ধ চক্র।
শামীম আহমদ নামে এক ব্যবসায়ী প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বাজারে যখন আতঙ্কে নিরবতা নেমে আসে এবং কেউ থাকে না, তখন এই চক্রটি ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানে ঢুকে হামলা ও লুটপাট চালায়।
গত ৪ দিনে বাজারের অন্তত ৫০টি দোকানে ভাঙচুর ও লুটের ঘটনা ঘটে। ব্যাটারিচালিত মিশুক ভাঙচুর করে ব্যাটারি চুরি করা হয়েছে। এছাড়া আরো কয়েকটি মিশুক ভাংচুর ও মোটর সাইকেলে আগুন দেয়া হয়েছে। ব্যবসায়ীরা দাবি করেছেন, অনেকেই সর্বস্ব হারিয়ে পথে বসেছেন।
নবীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ রুহুল আমিন জানান, নবীগঞ্জ শহরের মারামারি ঘটনায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে আমরা বিকাল ৪ টা থেকে ৮ জুলাই রাত ১২ টা পর্যন্ত ১৪৪ ধারা জারি করেছি। পরিস্থিতি বুঝে ১৪৪ ধারার সময় বর্ধিত করা হতে পারে। তিনি বলেন পরিস্থিতি এখন প্রশাসনে নিয়ন্ত্রনে রয়েছে।
নবীগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) শেখ মো. কামরুজ্জামান জানান, “আমরা বিষয়টি সমাধানের আহ্বান জানিয়েছিলাম। এখন সংঘর্ষ ও লুটপাটের বিষয়ে আমরা খোঁজ খবর নিচ্ছি। তবে পুরো বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারিতে রয়েছে।” শহরে শান্তি শৃংখলা রক্ষায় অতিরিক্ত পুলিশ, সেনাবাহিনী মোতায়েন রয়েছে। এদিকে সংঘর্ষের ঘটনায় রাতে অভিযান চালিয়ে ৪ জনকে গ্রেফতার করেছে যৌথবাহিনী। পরে গ্রেফতারকৃতদের থানায় হস্তান্তর করা হয়।
নবীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের টিএইচও ডাঃ আব্দুস সামাদ জানান, আমাদের হাসপাতালে অনেক রোগী রয়েছে। বিকালে ফারুক মিয়াকে সিলেট রেফার করা হয়। তিনি রাস্তায় মারা গেলে তার আত্মীয় স্বজন লাশ আবার হাসপাতালে নিয়ে আসেন। আমরা নবীগঞ্জ থানাকে জানিয়েছি লাশ নিয়ে যাওয়ার জন্য।