ঢাকায় বদলী হয়ে ১ সেপ্টেম্বর ২০০৮ হবিগঞ্জ ছেড়ে চলে আসি
হবিগঞ্জ থেকে চলে এসেছি ১৫ বছর কেটে গিয়েছে। হবিগঞ্জের অনেকের কথাই কমবেশি মনে পড়ে। অনেকের সাথে এখনও হাই-হ্যালো হয়। তবে সময়ের সাথে সাথে খরস্রোতা নদী যেমন স্রোতের খরতা হারায়, ঠিক তেমনি অনেকের সাথে যোগাযোগও স্তিমিত হয়ে আসছে
আতাউর রহমান কানন
২১ আগস্ট ২০০৮, বৃহস্পতিবার। সন্ধ্যায় ফ্যাক্সের মাধ্যমে এক সাথে ৩৫ জন জেলা প্রশাসক প্রত্যাহারের আদেশ জারির কপি পাওয়া গেল। সে আদেশে আমাকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপসচিব করা হয়েছে। আমি সাথে সাথে আমার বদলির সুসংবাদটি আমার ঢাকার বাসায় ফোনে জানালাম। তারা বেশ আনন্দিত হয়। আমি কবে চলে যাব তাও জানতে চায়। টিভি চ্যানেলসমূহে বদলির সংবাদ প্রচার হওয়ায় রাতের মধ্যে সংবাদ সচেতন ও আগ্রহী অনেকেই জেনে যান। উৎসাহী স্বজনেরা আমাকে ফোন করে তাদের মতো করে সৌজন্য কথাবার্তা বলেন।
২৩ আগস্ট ২০০৮, শনিবার। সকালে সাড়ে ৯টায় এডিসি জেনারেল আমার বাসভবনে এসে জানান যে, ভোররাতে ট্রেনে চেপে হবিগঞ্জে পদায়নকৃত জেলা প্রশাসক মো. আবুল কাশেম তালুকদার এসে সার্কিট হাউজে উঠেছেন। তিনি স্টেশন থেকে রিসিভ করে এনেছেন। আর অসময়ে এসেছেন বলে আমাকে ডিসটার্ব করেননি।
আমি বললাম, জানালেই পারতে। তিনিও জানালে পারতেন। তিনি তো আমার পরিচিত। একই জেলায় একসময় কাজ করেছি। আর অর্ডারে দেখলাম, তিনি মালয়েশিয়াতে প্রশিক্ষণরত। প্রশিক্ষণ ফেলে চলে এসেছেন?
-তাইতো দেখছি, স্যার!
-ভালো, তাঁর টেককেয়ার করো।
-স্যার, আরেকটা কথা!
-বলো।
-নতুন স্যার জানতে চাইছিলেন, কবে চার্জ দিবেন।
আমি অবাক দৃষ্টিতে এডিসির দিকে তাকিয়ে ভাবলাম, ‘এ যে কী হনু রে অবস্থা!’ আর মুখে বললাম, আজ সকালেই নিতে পারেন। আমার কোনো অসুবিধা নেই। তোমরা ট্রেজারি হস্তান্তর প্রক্রিয়া ও অন্যান্য কাগজপত্র প্রস্তুত করো।
-স্যার, এত দ্রুত এসব প্রস্তুত করা সম্ভব না। আর এভাবে তো কোনোদিন জেলা প্রশাসকদের যেতেও দেখিনি।
-আমি না হয় একটা উদারণ হয়েই রইলাম।
সকাল ১০টায় জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ পালন উপলক্ষ্যে পূর্বনির্ধারিত প্রোগ্রাম ছিল। এডিসি-সহ সেই প্রোগ্রামে যোগদানের জন্য বেরিয়ে যাই। প্রথমে জেলা জজ কোর্ট পুকুরে রুই মাছের পোনা অবমুক্ত করে এই সপ্তাহের উদ্বোধন করি। এরপর একটি বর্ণাঢ্য র‌্যালির নেতৃত্ব দিয়ে শহর প্রদক্ষিণ করি। এবারের প্রতিপাদ্য স্লোগান হল- ‘মাছের বংশ রক্ষা পেলে, খাদ্য অর্থ দুই-ই মিলে’। র‌্যালি শেষে জেলা পরিষদ মিলনায়তনে আলোচনা সভায় যোগদান করি। বক্তৃতা পর্ব শেষে সফল মৎস্যচাষীদের পুরস্কৃত করা হয়।
অনুষ্ঠান শেষে আমি বাসায় এসে বিভাগীয় কমিশনার ড. জাফর আহমদ খানকে টেলিফোন করে নতুন জেলা প্রশাসকের আগমন ও আমার চার্জ হস্তান্তর বিষয় নিয়ে আলাপ করি। আলাপ শেষে তিনি বললেন, তুমি এ মাস তো থাকবেই, তারপর তোমার সুবিধামত চার্জ দিবে। জেলায় ডিসির যোগদান ও বিদায় সবই বিফিটিং হওয়া চাই। তুমি তোমার মতো প্রস্তুতি নাও। আর বাকি যা বলার আমি ওকে বলে দিব।
এ দিন সন্ধ্যায় আবুল কাশেম আমার সাথে সাক্ষাতে এলেন। সৌজন্য কথাবার্তা হলো। চা-নাশতায় আপ্যায়িত হয়ে চলে গেলেন।
২৪ আগস্ট ২০০৮, রবিবার। আমি অফিসে গিয়ে আমার অফিসারদের নিয়ে বসলাম। তাঁদের সাথে সৌজন্য কথাবার্তা বলে কাজকর্ম গোছাতে বলি। আমার সময়ের কোনো পেন্ডিং কাজ রেখে বিদায় নিয়ে কোনো সমালোচনায় পড়তে চাই না। তাই সবকিছু আপডেট করার জন্য নির্দেশ দিলাম।
সারাদিন অফিসেই ছিলাম। জেলা প্রশাসক হিসেবে আমি বিভিন্ন সংস্থা, শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সভাপতি। এসব প্রতিষ্ঠানের অনেকেই আজ এসে তাঁদের সাথে বসার সময় দিতে অনুরোধ জানান। উকিল বার ও প্রেসক্লাবের পক্ষ থেকেও সময় চান। এছাড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসারগণ তো আছেনই। এত জায়গায় আমার যাওয়ার সময় হবে না। আর আমি ঘটা করে ফেয়ারওয়েল নেওয়াটা অতীত থেকেই তেমন একটা পছন্দ করি না। তাই স্টাফ অফিসারকে দিয়ে একটি শর্টলিস্ট তৈরি করার সিদ্ধান্ত নিলাম। যে কদিন আছি অফিসের কাজের ফাঁকে ফাঁকে অবস্থা ও গুরুত্ব বিবেচনায় তাঁদের প্রতিষ্ঠানে গিয়ে বিদায় নিয়ে আসব।
দেখতে দেখতে মাস শেষ হয়। হবিগঞ্জের ৮ উপজেলার ভেতর শুধু সদর আর লাখাই থেকে ফেয়ারওয়েল নিলাম। এদিকে জেলা ক্রীড়া সংস্থা, টেনিস ক্লাব, প্রেসক্লাব, কালেক্টরেট ক্লাব এবং বিসিএস (প্রশাসন) অ্যাসোসিয়েশন হবিগঞ্জ থেকে বিদায় সংবর্ধনা নেওয়া সম্ভব হয়। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সময় চাইলেও সময় দিতে পারিনি। তবে শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের প্রধানগণ দু-চার জন সঙ্গীসাথি নিয়ে ফুল, মানপত্র ও ক্রেস্ট-সহ আমার অফিসে এসে সাক্ষাৎ করতে ভুলেননি।
অতিথিপরায়ণ হবিগঞ্জের অনেকেরই অভিব্যক্তি- এত কম ফেয়ারওয়েল নিয়ে নাকি ইতঃপূর্বে কোনো জেলা প্রশাসককে যেতে দেখেননি।
আমি পহেলা সেপ্টেম্বর চার্জ হস্তান্তর করে হবিগঞ্জ ত্যাগ করব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। সে অনুযায়ী আমার গোছগাছ চলছিল। ২৯ আগস্ট শুক্রবার, ঢাকা থেকে আমার সহধর্মিণী পুত্র-কন্যা নিয়ে হবিগঞ্জ আসে। সে জেলা মহিলা ক্রীড়া সংস্থা ও জেলা লেডিস ক্লাবের পদাধিকার সভাপতি। এই সংস্থার পক্ষ থেকে তাঁকে বিদায় সংবর্ধনা দেওয়া হয়।
নব যোগদানকৃত জেলা প্রশাসক হবিগঞ্জে আসার পর থেকেই সার্কিট হাউজেই সপরিবারে বসবাস করছিলেন। তাঁর পূর্ববর্তী কর্মস্থল থেকে বাসার মালামাল এবং সেই সাথে ট্রাকভর্তি তাঁর পালিত গরু-বাছুরগুলো আনিয়েছেন। উল্লেখ্য, তিনি ময়মনসিংহ জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার পদে থাকাবস্থায় জেলা প্রশাসক পদে নিয়োগ পেয়েছেন।
১ সেপ্টেম্বর ২০০৮, সোমবার। সকালে অফিসে গিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে বিদায়ী সাক্ষাৎ করে আনুষ্ঠানিকভাবে ট্রেজারির চার্জ নবনিযুক্ত জেলা প্রশাসকের কাছে হস্তান্তর করে বাসভবনে চলে আসি। নবাগত জেলা প্রশাসকের পরিবারসহ একত্রে আমার বাসায় লাঞ্চ করি। এর মধ্যে আমাদের সুটকেসসমূহ জীপগাড়িতে ওঠানো হয়েছে। বাসভবনে আমার বিদায়কালে জেলায় কর্মরত সেনা ইউনিটের কর্নেল, পুলিশ সুপার, অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সুধীজনসহ অনেকেই উপস্থিত হন। সব বিদায়ই বেদনা-বিঁধুর। চিরন্তন কাব্যবাণী যেন সবার অন্তরে ক্ষণিকের তরে গুমরে ওঠে-
“যেতে নাহি দিব’। হায়,
তবু যেতে দিতে হয়, তবু চলে যায়।
চলিতেছে এমনি অনাদি কাল হতে
প্রলয় সমুদ্রবাহী সৃজনের স্রোতে।…”
আমার ভেতরটাও অনিয়ন্ত্রিত এক বেদনায় মোচড় দিয়ে ওঠে। তবু আমি যথাসম্ভব মুখে হাসি টেনে সবার সাথে হাত মিলাই। এরপর বাসভবনের হাউজ গার্ডদের বিদায়ী সালামি নিয়ে সপরিবারে গাড়িতে উঠে ঢাকার উদ্দেশে রওনা করি। পেছনে পড়ে থাকে আমার দুবছর ধরে বসবাসের বাসভবনটি, বিদায় জানাতে আসা কর্মকর্তা-কর্মচারী-সুধীজন, আর সেইসঙ্গে সকলকে ছাপিয়ে আমার সেবাকারী বাসভবনের কর্মচারীদের বিমর্ষ মুখচ্ছবি।
খোয়াই নদীর পানি বিগত দুবছরে হবিগঞ্জের ওপর দিয়ে অনেক গড়িয়েছে। এর পলিতে যেমন অনেক শস্য জন্মেছে, তেমনি কিছু ক্ষতিসাধনও হয়েছে। নদীর ভাঙা-গড়ার এ খেলা যেমন চিরন্তন সত্য, তেমনি মনুষ্য দ্বারাও লাভ-ক্ষতি চিরসত্য।
…. …… …… …… …… ……
পুনশ্চ: হবিগঞ্জ থেকে চলে এসেছি ১৫ বছর কেটে গিয়েছে। হবিগঞ্জের অনেকের কথাই কমবেশি মনে পড়ে। অনেকের সাথে এখনও হাই-হ্যালো হয়। তবে সময়ের সাথে সাথে খরস্রোতা নদী যেমন স্রোতের খরতা হারায়, ঠিক তেমনি অনেকের সাথে যোগাযোগও স্তিমিত হয়ে আসছে। তবে এই দীর্ঘদিনেও একজন ব্যক্তি আমার সাথে এখনও টেলিযোগাযোগ আগের মতোই অক্ষুণœ রেখেছেন। আমি মোবাইলের কাছে থাকলে তাঁর কল কখনও ধরতে মিস করি না। আর কল ধরলে তিনি বরাবরের মতো সালাম দিয়ে বলেন- ‘স্যার, বালা আছুইননি? শরীলটা বালানি? আপনার খতা মনে পড়ছে, তাই ফোন দিলাম্নে। বিরক্ত হওন না।’
কলদাতার নাম আবু তাহের, তিনি নিজেকে প্রতিবন্ধী তাহের নামে পরিচয় দেন। একবার আমার অফিসে অন্যের সহায়তায় প্রতিবন্ধী দিবসের দাওয়াত নিয়ে সাক্ষাৎ করতে আসেন। তিনি হাঁটতে পারেন না। তাঁর অসহায়ত্ব ও মায়াবী ব্যবহার আমাকে মুগ্ধ করে। তাই আমি নিজে থেকেই পরের দিনই তাঁকে একটি হুইলচেয়ার কিনে উপহার দিয়েছিলাম। (শেষ)

বি.দ্র. যাঁরা ধৈর্য না হারিয়ে আমার লেখা পড়েছেন, তাঁদের অসংখ্য ধন্যবাদ। এরপর আসছে সচিবালয়ে আমার চাকরির দশ বছরের অভিজ্ঞতার বিচিত্র কাহিনি নিয়ে লেখা ‘খেলাঘর’।