হবিগঞ্জ থেকে বদলী হয়ে যাওয়ার জন্য আমার চেষ্টা চলছিল
আতাউর রহমান কানন
৩ আগস্ট ২০০৮, রবিবার। দুদিন জ্বরে ভোগার পর গতকাল বিকেল থেকে আমার গায়ে আর জ্বর উঠেনি, তবে কাশি ও কফ আছে। আজ সকাল ৮টায় এ অবস্থাতেই আমার কর্মস্থল হবিগঞ্জের উদ্দেশে রওনা করি। ১১টায় হবিগঞ্জ পৌঁছে বাসাতে বসেই এ বেলা অফিসের কাজকর্ম করতে থাকি। লাঞ্চের পর তিনটায় অফিসে যাই।
সন্ধ্যা ৭টায় সার্কিট হাউজে অবস্থানরত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামসুল আলমের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। তিনি গতকাল হবিগঞ্জে একটি তদন্তকাজে এসেছেন বলে আমাকে জানালেন। কীসের তদন্ত, কার বিরুদ্ধে তদন্ত তেমন কিছুই জানালেন না। তবে সারাদেশে বর্তমানে কর্মরত ডিসিদের একটি তালিকা আমাকে দেখিয়ে তাঁদের সম্পর্কে আমার কাছে ভালোমন্দ কিছু জানতে চান। আমি তো আর সবাইকে ভালো করে চিনি না, তবে যতটুকু সম্ভব জানালাম।
আমি তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসার সময় তিনি বললেন, আপনার সম্পর্কে আমি এ দুদিন অনেক খোঁজ খবর নিয়েছি। হবিগঞ্জের একজন ছাড়া সবাই এক কথায় আপনার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। এমন কি আমার একসময়ের সহপাঠী ইম্ব্যালান্সড রানা অ্যাডভোকেট পর্যন্ত! তবে আমি ভেরি মাচ স্যাটিস্ফাইড অ্যাবাইট ইউ। আপনার কি ওই পার্সন সম্পর্কে কোনো ধারণা আছে- কে হতে পারে?
আমি বললাম, আমার ধারণায় তিনি একজন অ্যাডভোকেট ও রাজনীতিবিদ।
রাইট। আর কিছু?
নামটা না হয় না-ই বললাম, স্যার।
ওকে, কিন্তু কেন?
ওয়ান ইলেভেনের পর কোনো কারণে তাঁর দাপট বেড়ে যায়। নানা অনিয়মের তদবির নিয়ে আমার কাছে আসেন; কিন্তু আমি আমার নীতিতে অটল থাকায় তখন থেকেই আমার পেছনে লেগে আছেন। তিনি আমার বদলির জন্য আদাজল খেয়ে নামেন, আর আমিও চলে যাওয়ার জন্য শুধু প্রস্তুত না- মন্ত্রণালয়ে তদবির অব্যাহত রেখেছি। এ পর্যন্ত অনেকেরই দফায় দফায় বদলি হয়েছে; কিন্তু আমার ক্ষেত্রে ওই বিজ্ঞ অ্যাডভোকেট কিংবা আমি কেউ সফল হতে পারছি না।
ব্রিগেডিয়ার সাহেব হাহা করে উচ্চস্বরে হেসে বললেন, ওই অ্যাডভোকেটকে আমি ভালো করেই চিনি। আমার বাবার চাকরির সুবাদে আমি হবিগঞ্জ গভর্নমেন্ট হাইস্কুলে পড়েছি। তখন সে আমার সহপাঠী ছিল। ডোন্ট ওয়ারি, ও আর আপনার কিছুই করতে পারবে না। ওর গোড়া ভেঙে গেছে। গুড লাক।
আসি স্যার, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আমার রিকুয়েস্ট রইল, সম্ভব হলে আমার বদলিতে সহায়তা করবেন।
আমি ওঠে দাঁড়ালে তিনি আমাকে তাঁর কন্টাক্ট নম্বর দিয়ে বললেন, বদলির বিষয়টি বাদ দিয়ে অন্য যেকোনো বিষয়ে আমার সাথে যোগাযোগ করতে পারেন।
৪ আগস্ট ২০০৮, সোমবার। আজ দুপুরে আমার ব্যক্তিগত সহকারী আবদুল খালেকের বউভাত অনুষ্ঠান। অফিস থেকেই সে অনুষ্ঠানে অন্যান্য কর্মকর্তাদের নিয়ে যোগদান করি।
গত বছরের ন্যায় এবারও জেলা ক্রীড়া সংস্থার পরিচালনায় জেলা প্রশাসক গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট আয়োজন করা হয়েছে। বিকেল ৪টায় জালাল স্টেডিয়ামে গিয়ে এ টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচের প্রতিযোগী দলের খেলোয়াড়দের সাথে পরিচিত হয়ে খেলার উদ্বোধন করি। অতঃপর খেলা উপভোগ করে সন্ধে ৬টায় বাসায় ফিরে আসি।
৭ আগস্ট ২০০৮, বৃহস্পতিবার। আজ সকালে কিছু সময় অফিস করে ১১টায় বাহুবল উপজেলায় যাই। সেখানে ইউএনও অফিস দর্শন শেষে ইউএনও আবদুছ ছাত্তার শেখ-সহ ভাদেশ্বর ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে যাই। এই কার্যালয়ের জন্য সরকার নতুন ইউনিয়ন পরিষদ ভবন নির্মাণ করেছে। আজ সেই ভবনের উদ্বোধন করি। উদ্বোধন উপলক্ষ্যে চেয়ারম্যান আবুল হাসিম প্যান্ডেল টানিয়ে একটি সমাবেশের আয়োজন করেন। সেখানে বক্তব্য রাখি। অতঃপর ভাদেশ্বর তহসিল অফিস পরিদর্শন করে সরাসরি সদরদপ্তরে ফিরে আসি।
১০ আগস্ট ২০০৮, রবিবার। ঢাকা গিয়ে গত মাসের শেষ দিবসে ভাইরাস জ্বর ও জ্বরপরবর্তী ঠা-াকাশি লাগিয়ে এসেছিলাম। দুদিন ভোগার পর জ্বর সেরে গেলেও ঠা-াকাশি চলছিল। চিকিৎসক ভেজাল, না ওষুধ- এ প্রশ্নের জবাবে সিভিল সার্জন জানান যে, ওষুধ নিয়েই সন্দেহ আছে। থাক সে কথা। অনেক ওধুধ গলাধকরণের পর আজ সকাল থেকেই মনে হল, সে ঠা-াকাশি থেকে মুক্তি পেয়েছি।
সকাল ৯টায় অফিসে যাই। ভূমি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় ও তত্ত্বাবধানে দেশে ভূমি ব্যবস্থাপনার ওপর ভ্রাম্যমাণ ট্রেনিং কোর্স চলছে। আজ হবিগঞ্জ জেলায় তার আয়োজন করা হয়েছে। সকাল ১০টায় আমি সে কোর্স উদ্বোধন করে আমার অপর পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী সাড়ে ১১টায় বানিয়াচং উপজেলায় যাই। সেখানে ইউএনও অফিস পরিদর্শন করি। ইউএনও অফিস থেকে ফেরার পথে ইউএনও-সহকারে বানিয়াচংয়ে প্রতিষ্ঠিত ব্র্যাকের ‘আয়েশা-আবেদ ফাউন্ডেশন’ ভিজিট করি। সেখানের কারখানা ঘুরেফিরে দেখি। আড়ং এর জন্য প্রস্তুতকৃত পণ্যাদি দর্শনে মুগ্ধ হই। এখানের শোরুমেও তাঁর কিছু কিছু পণ্য বিক্রি করা হয়। ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ফজলে হাসান আবেদ এশিয়ার বৃহত্তম গ্রাম নামে অভিহিত এই বানিয়াচংয়েরই সন্তান।
বিকেল ৩টায় বানিয়াচং থেকে ফিরে বিকেজিসি সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে যাই। সেখানে সিলেট শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানের সভাপতিত্বে জেলার সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের নিয়ে আয়োজিত শিক্ষার মানোন্নয়ন বিষয়ক মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে যোগদান করি। ৫টায় সভা শেষ হলে আমি বিদায় নিয়ে চলে আসি।
১২ আগস্ট ২০০৮, মঙ্গলবার। সকাল থেকেই আজ সারাক্ষণ অফিসে ছিলাম। একবার জেলা নির্বাচন কর্মকর্তাকে সালাম দিয়ে ভোটার তালিকার আপডেট নিলাম। ভোটার তালিকা প্রণয়নের যে কাজ শুরু হয়েছিল, তা প্রায় শেষ হওয়ার পথে।
দেশে রাজনীতির দখিনা বাতাস বইতে শুরু করেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারও সে বাতাস নীরবে উপভোগ করছে। কেউ কেউ বলছেন, ডিসেম্বর মাসেই নির্বাচন হবে। দেশ-বিদেশের সংবাদেও এমন আভাস পাওয়া যাচ্ছে। আর সে বিষয়ে সরকারও প্রস্তুতি নিচ্ছে। নির্বাচনের আগে সরকার মাঠ প্রশাসনকে ঢেলে সাজানোর চিন্তাভাবনাও করছে। মন্ত্রণালয়ে নাকি এসবের তালিকা প্রস্তুত হচ্ছে। আমার অবশ্য এ এসব শুনে ভালোই লাগছে। আশা করছি এ ধাক্কায় আমি ঢাকায় চলে যেতে পারব।
আজ বিকেলে আমার বাসভবনের আঙিনায় বৃক্ষচারা রোপণের দিনক্ষণ ধার্য ছিল। অফিস থেকে আমার কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়ে বাসায় এসে কয়েকটি ফলদ ও ঔষধি গাছের চারা রোপণ করি।
১৮ আগস্ট ২০০৮, সোমবার। সকাল ১০টায় জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ে যাই। সেখানে সমাজসেবা তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান ‘রেনেসাঁ’ কর্তৃক ২৫ জন সফল কম্পিউটার প্রশিক্ষণার্থীদের মাঝে সনদ বিতরণ করি। স্থানীয় দরিদ্র ও মেধাবী বেকারদের বাছাই করে কম্পিউটার কোর্সে ভর্তি করে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। একটি দক্ষ কম্পিউটার প্রজন্ম যে এখন সময়ের দাবি- এ কথা আমার বক্তব্যে উল্লেখ করি। রেনেসাঁর চেয়ারম্যান বিশিষ্ট অ্যাডভোকেট নূর মিয়ার সভাপতিত্বে এ অনুষ্ঠানে হবিগঞ্জের শিক্ষাবিদ-সুধীজনগণও বক্তব্য রাখেন। এ অনুষ্ঠান শেষে আমি সাড়ে ১১টায় অফিসে ফিরে আসি।
১৯ আগস্ট ২০০৮, মঙ্গলবার। আজ সকাল ১১টায় নির্বাচন কমিশনার মুহম্মদ ছহুল হোসেন হবিগঞ্জ আসেন। তাঁর কর্মসূচি অনুযায়ী নির্বাচন বিষয়ে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের সাথে মতবিনিময় সভায় তিনি যোগদান করেন। সার্কিট হাউজের সভাকক্ষে জেলা প্রশাসন কর্তৃক আয়োজিত এ সভায় তিনি জানান- যথাশীঘ্র দেশে যে কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচন কমিশন প্রস্তুত। ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা প্রণয়ন শেষ। উক্ত তালিকায় নাম থাকলেই যে কেউ ভোট দিতে যোগ্য বিবেচিত হবেন। তিনি মধ্যাহ্নভোজের পর ঢাকা অভিমুখে রওনা হন। আমি অফিসে চলে আসি। বিকেলে ঢাকায় আমার সুহৃদ ব্যাচমেট আনিছুর রহমানের কাছ থেকে জানতে পারি, দু-একদিনের মধ্যেই বর্তমান ডিসিদের প্রত্যাহারের আদেশ জারি হতে যাচ্ছে। সরকার এখন নির্বাচনমুখী। (চলবে…)