কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই মরমী কবি শেখ ভানু শাহ হাজার খানেক মরমী গান ও পুঁথি সাহিত্য রচনা করেছেন
আতাউর রহমান কানন
৩০ ডিসেম্বর ২০০৭, রবিবার। একবেলা অফিস করে বিকেল ৩টায় পূর্বনির্ধারিত প্রোগ্রাম অনুযায়ী লাখাই উপজেলায় যাই। সেখানে ইউএনও অফিস দর্শন করি। উপজেলার কর্মকর্তাদের সাথে মতবিনিময় করি। ৪টায় উপজেলা সদর হতে ১ কিলোমিটার দূরে বামৈ ইউনিয়নের ভাদিকারা গ্রামে অবস্থিত বাউল সাধক ও মরমী কবি শেখ ভানু শাহের মাজারে যাই। সেখানে ভানু শাহের ৮৯তম মৃত্যুদিবস উপলক্ষ্যে উরস এবং আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। আমি সে আলোচনা অনুষ্ঠানে যোগদান করি। উরস গত পরশু (১৪ পৌষ) থেকে শুরু হয়েছে। এ উরস ‘ভানুমেলা’ নামেও পরিচিত। মূলত সিলেট এলাকার সন্তান ইউএনও আয়াতুল ইসলামের অনুরোধে আমি একরকম ঢেকি গেলার মতো অবস্থায় এখানে এসেছি। মাজারের কর্মকা- আমি শিরক্ এ আকবর বলেই জানি।
আজকের আলোচনা ও সংগৃহীত তথ্যাদি থেকে যতটুকু জানা যায়, সে অনুযায়ী শেখ ভানু শাহ ১৮৪৯ সালে লাখাই উপজেলার ভাদিকারা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই তিনি স্বমহিমায় বিভিন্ন ধরনের প্রায় হাজার খানেক মরমী গান রচনা করেন। এছাড়া তিনি পুঁথি সাহিত্যও রচনা করেছেন।
তিনি দরিদ্র পরিবারের একমাত্র পুত্র সন্তান হওয়ায় ১০-১২ বছর বয়সেই পিতার সাথে ধানের কারবারে যুক্ত হন। ব্যবসার কারণে আশুগঞ্জ, ভৈরব, মোহনগঞ্জ-সহ ভাটি এলাকার আড়তসমূহে তাঁর যাতায়াত ছিল। কথিত আছে, বর্ষা মৌসুমের কোনো একদিন ভৈরব বাজারে ধান নিয়ে নৌকায় করে যাওয়ার সময় পথিমধ্যে মেঘনা নদীর চরের কানলারবাগ নামক স্থানে দেখতে পান একটি মৃতদেহকে কাক ঠুক্রে খাচ্ছে। ঘটনাটি তাঁকে ভাবাবিষ্ট করে। তাঁর মনে প্রশ্ন জাগে- সোনার দেহ কেন কাকে খায়? জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্যই বা কী?
তিনি নৌকা থেকে কোনো এক জায়গায় নেমে পড়েন এবং মাঝিকে বলে যান, মহাজনকে সবকিছু যেন বুঝিয়ে দিয়ে আসে। তিনি হাঁটতে হাঁটতে কখনো কাঁদেন, কখনো হাসেন এবং তা তাঁর পিছু পিছু গমনকারী একজন পদচারি লক্ষ্য করেন। একটা সময় বাড়িতে পৌঁছে তিনি জ্বরে পড়েন। সুস্থ হলেও তিনি আধ্যাত্মিক চিন্তায় ব্যাকুল হয়ে পড়েন এবং যোগ্য গুরুর সন্ধানে বেরিয়ে পড়েন। একসময় তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাসিরনগর থানাধীন কচুয়ায় সন্ধান পান মিরান শাহ তাঁতারীর। তিনি তাঁর বাইয়্যাত গ্রহণ করে আধ্যাত্ম সাধনায় নিমগ্ন হন। মিরান শাহের শিষ্যত্ব গ্রহণ করার পর তিনি অনেকটা আত্মমগ্ন ও নিভৃতচারী হয়ে পড়েন।
১৯৩৩ সালে সুসাহিত্যিক কাজী আব্দুল ওদুদের সভাপতিত্বে কলকাতায় অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সম্মেলনে লালন শাহ, শেখ মদন শাহ, শেখ ভানু শাহ ও হাছন রাজাকে দার্শনিক কবি হিসেবে অভিহিত করা হয়। ১৯৩৫ সালে শচীন দেব বর্মন শেখ ভানু শাহের বিখ্যাত গান ‘নিশীথে যাইও ফুল বনে রে ভ্রমরা’ গেয়ে ভারতীয় জাতীয় পুরস্কার লাভ করেন। শচীন দেব বর্মনের গাওয়ার পর গানটি জনপ্রিয়তা লাভ করে। তবে সে গানটিতে পল্লিকবি জসীম উদ্দীনকে গীতিকার হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। মূলত ভানু শাহের আধ্যাত্মিক গানটিকে তিনি পরিমার্জন ও পরিবর্তন করে নিজের নামে চালিয়েছেন বলে ভানু শাহের ভক্তকুলের দাবি যুগযুগ ধরে। ভানু শাহের মূল গানটি হলঃ
“নিশীথে যাইও ফুল বনে রে ভ্রমরা,
নিশীথে যাইও ফুল বনে।
নয় দরজা করি বন্ধ,
লইয়ো ও ফুলের গন্ধ গো,
অন্তরে জপিও মুর্শিদের নাম রে ভ্রমরা
নিশীথে যাইও ফুল বনে।।
জ্বালাইয়া দিলেরও বাতি
ফুটিবে ফুল নানা জাতি গো,
কতো রঙে ধরবে ফুলের কলি রে ভ্রমরা
নিশীথে যাইও ফুল বনে।।
ডাল পাতা বৃক্ষ নাই,
এমন ফুল ফুটাইছে সাঁই,
ভাবুক ছাড়া বুঝবে না পন্ডিতে রে ভ্রমরা।
নিশীথে যাইও ফুল বনে।।
অধীন শেখ ভানু বলে,
ঢেউ খেলাইয়ো আপন দিলে,
পদ্ম যেমন ভাসে গঙ্গার জলে রে ভ্রমরা।
নিশীথে যাইও ফুল বনে।।’’
শেখ ভানু শাহ ১৯১৯ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর রচিত মরমি গানগুলো বর্তমানে বিশ্ব পরিমন্ডলে ছড়িয়ে পড়ছে এবং ইংরেজিসহ বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হচ্ছে। বর্তমানে শেখ ভানু শাহের ভাগ্নির পুত্র বাদশা মিয়া মাজারের খাদেম এবং প্রপৌত্র আব্দুল মোতালিব শেখ ভানু শাহের ঘরে বসবাস করেন। ভানু শাহকে ঘিরেই যেন তাঁরা বেঁচে আছেন। প্রতিবছর এখানের উরস ও মেলা উপলক্ষ্যে দূরদূরান্ত থেকে মাজারপ্রেমি ও পর্যটকগণ এসে থাকেন।
৩১ ডিসেম্বর ২০০৭, সোমবার। এবার শীত যেন হবিগঞ্জে একরকম জেঁকে বসেছে। সকাল থেকে আজ সূর্যের দেখা নেই। বছরের শেষ দিন হওয়ায় নানা কারণেই দিনটি আজ গুরুত্বপূর্ণ। আমি সকাল ৯টায় অফিসে যাই। ১০টা থেকে ১২টা পর্যন্ত অফিসের কর্মকর্তাদের নিয়ে ট্রেজারি ভেরিফিকেশন করে সম্পদের হিসাব বহিতে স্বাক্ষর করি। আজ বছরের এই শেষ দিনে সোনালী ব্যাংকে লাঞ্চের দাওয়াত ছিল। আমি সে দাওয়াতে আমার এডিসিদের নিয়ে বেলা ১টায় অংশগ্রহণ করি। এ ব্যাংকটি জেলা-উপজেলায় ট্রেজারি ফাংশনে জড়িত থাকায় প্রশাসনের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র রয়েছে। দাওয়াত খেয়ে আড়াইটায় অফিসে ফিরে আসি।
রাতে নিয়মমাফিক টেনিস মাঠে যাই। তবে ঘন কুয়াশার কারণে মাঠ আজ বেশ পিচ্ছিল থাকায় না খেলেই বাসায় ফিরে আসি।
আজ রাত ১২টার পর একটি বছরের ক্যালেন্ডার শেষ হয়ে যায়। ভালোমন্দ মিলিয়ে ২০০৭ সালটি মানে মানে কেটেছে। আগামী দিনগুলো সবার জন্য মঙ্গলময় হোক- এই কামনায় ঘুমের রাজ্যে চলে যাই। (চলবে…)
© স্বত্ব দৈনিক হবিগঞ্জের মুখ ২০১৯
ওয়েবসাইটটি তৈরী করেছে ThemesBazar.Com