হবিগঞ্জে এনজিওগুলোর মধ্যে কাজের কোনো সমন্বয় নেই বললেই চলে
সবাই মাইক্রোক্রেডিট জালে দরিদ্রদের আটকে ফেলে দরিদ্রদের আরও দরিদ্রতর করে ফেলছে
আতাউর রহমান কানন
২১ অক্টোবর ২০০৭, রবিবার। দুর্গাপূজার বিজয়া দশমী উপলক্ষ্যে আজ সরকারি ছুটি। আমি সারাদিন বাসাতেই ছিলাম। সকালে ঢাকা থেকে আমার ভাতিজী শিপুর শ্বশুর আসেন। তিনি মূলত এসেছেন তাঁর বড় ছেলের বিবাহজনিত বিষয়ে পাত্রীপক্ষের খোঁজখবর নিতে। পাত্রীর বাড়ি হবিগঞ্জ শহরেই। আমি আমার সোর্সের মাধ্যমে কিছু খবর জোগাড় করে তাঁকে দিলাম। তিনি মোটামুটি একটা বোঝ নিয়ে লাঞ্চ করে চলে যান।
আকাশটা আজ সারাদিনই বেশ পরিষ্কার থাকে। রাতে দিগন্তজোড়া দশমীর চাঁদের ফক্ফকা হাসি। সেইসঙ্গে নির্মল হেমন্ত হাওয়ার দোলা জানালাপথে গা জুড়িয়ে দেয়। তবে আমার বাসার অদূরে এক মন্দির থেকে দিনরাত ক্ষণে ক্ষণে পূজারিদের বাদ্যযন্ত্র বাজতেই থাকে। দিন শেষে গভীর রাতের এই বাদ্যযন্ত্রের শব্দমালা আমার জন্য যন্ত্রণাদায়ক হলেও বন্ধ করার কোনো উপায় নেই। আজ দুর্গা দেবীকে বিসর্জন দিয়ে ভক্তকুলের বিরহ-বেদনা যেন সব এই বাদ্যযন্ত্রের মাধ্যম মিটিয়ে দেওয়া হচ্ছে ! এই শব্দমালার কাছে একসময় আমার ক্লান্ত দেহ হার মেনে ঘুমিয়ে পড়ে।
২২ অক্টোবর ২০০৭, সোমবার। একনাগাড়ে তিন দিন বন্ধের পর আজ অফিস খুলেছে। ডিসি অফিস সেবা প্রার্থীদের আনাগোনায় ভরে ওঠে। জেলার এই সর্ববৃহৎ অফিসকে ঘিরে প্রতিদিন বহুলোকের আনাগোনা ও জীবন-জীবিকা। এই অফিসেই কোর্টকাচারির ম্যাজিস্ট্রেট, আর উকিল-মক্কেলের কার্যকলাপ যুগযুগ ধরে চলে আসছে। বিশেষ করে ফৌজদারি কাজকর্মের গরম হাওয়ায় অফিস সব সময়ই সরগরম। তবে এই অফিসের ফৌজাদারি কার্যক্রম আর থাকছে না। বর্তমান সরকার জুডিশিয়াল সেপারেশন সম্পন্ন করে এনেছেন। আগামী মাস হতে নির্বাহী বিভাগ তথা জেলা প্রশাসকের নিয়ন্ত্রণ থেকে ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থা চলে যাচ্ছে। সরকার জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট পদ সৃজন করেছে, যারা বিচার বিভাগ তথা জেলা জজের নিয়ন্ত্রণে থাকবেন। সরকারের ইচ্ছা বিচার ব্যবস্থার ওপর নির্বাহী বিভাগের প্রভাব দূর করে স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। সরকারের এই ইচ্ছাকে আমি সাধুবাদ জানাই। আমি একজন মাঠ প্রশাসক হিসেবে এদেশে স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা গড়ে উঠুক এটা মনেপ্রাণে চাই কিন্তু ‘স্বাধীন বিচার’ এদেশে কি বাস্তবে দেখে যেতে পারব?
সকাল থেকে আজ অফিসেই ছিলাম। বিকেল ৩টায় বিজ্ঞ জেলা ও দায়রা জজ শাহীনুর ইসলাম তাঁর জজশিপের জজদের নিয়ে আমার অফিসে সাক্ষাতে আসেন। তিনি বিচার বিভাগ পৃথক হওয়ায় দায়িত্ব গ্রহণ নিয়ে আমার সাথে আলোচনা করেন এবং জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের জন্য বিদ্যমান ও প্রাপ্য সুবিধাদি সরেজমিন পরিদর্শন করেন। কালেক্টরেট ভবনের বিদ্যমান ৬টি এজলাসের ৪টি জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের ব্যবহারে দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানালে আমি অস্থায়ীভাবে দুটি ছেড়ে দেওয়ার সম্মতি দিলে তিনি তা মেনে চলে যান।
২৪ অক্টোবর ২০০৭, বুধবার। সকাল ১০টায় ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রণয়ন এবং জাতীয় পরিচয়পত্র কার্যক্রম প্রকল্প বিষয়ক জেলা সমন্বয় কমিটির সভায় সভাপতিত্ব করি। উপজেলাভিত্তিক কর্মসূচি প্রণয়ন করে ভোটার তালিকা প্রস্তুতের কাজ চলমান। জেলায় কর্মরত সেনাবাহিনীর অদম্য প্রচেষ্টায় কাজ এগিয়ে চলছে।
সাড়ে ১১টায় জাতীয় স্যানিটেশন মাস উদ্যাপন উপলক্ষ্যে ব্রিফিং সভায় সভাপতিত্ব করি। এ জেলায় স্যানিটেশন কভারেজ প্রায় ৬৩%। এবছরের মধ্যে ৯০% কভারেজের লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করে কার্যক্রম এগিয়ে যাচ্ছে।
আজ বিকেল সাড়ে ৩টায় জেলা ও দায়রা জজের কার্যালয়ে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ বিষয়ক এক মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়েছে। আমি আমন্ত্রিত হয়ে সেখানে যোগদান করি। পুলিশ সুপার, এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ ও অ্যাডভোকেট বারের সদস্যগণ সভায় অংশগ্রহণ করেন। মতবিনিময় সভায় বিজ্ঞ জজ সাহেব সরকারের সর্বশেষ নির্দেশনা তুলে ধরেন। আলোচনায় বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ সরকারি সিদ্ধান্তকে সবাই স্বাগত জানান। বিশেষ করে উকিল সাহেবগণ প্রশংসায় মুখে ফেনা তুলেন। যা হওয়ার তা তো হয়েই যাচ্ছে। কী আর করা! আমার ঝুলে থাকা ভাঙা হাত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়াই ভালো মনে করে আমিও সরকারের প্রশংসা করে বক্তব্য রাখি। আর নতুন ব্যবস্থা সফলভাবে পরিচালিত হওয়ার জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে যথাসাধ্য সহায়তার আশ্বাস দিই। মতবিনিময় সভা থেকে ফেরার পথে আমার মনটা কেন যেন অশান্ত হয়ে ওঠে। বুঝলাম, জগতে কেউ তার ক্ষমতা হারাতে চায় না, আমিও তো ওই কেউয়ের একজন বটে!
২৯ অক্টোবর ২০০৭, সোমবার। সকালে কিছুক্ষণ অফিসে বসে সাড়ে ১১টায় মাধবপুর সড়ক ও জনপদের রেস্ট হাউজে যাই। সেখানে মাননীয় পরারাষ্ট্র উপদেষ্টা ড. ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী সিলেট থেকে ঢাকা ফেরার পথে যাত্রা বিরতি করেন। আমি তাঁর প্রোটোকল করি। তিনি হবিগঞ্জের চলমান গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে জানতে চাইলে, তাঁর সঙ্গে হবিগঞ্জ জেলার সার বিতরণ ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করি। তিনি কৃষকের ফসল উৎপাদনে গুরুত্ব দেওয়ার জন্য কিছু পরামর্শ দেন। তিনি চলে গেলে আমি আমার পূর্বনির্ধারিত প্রোগ্রাম অনুযায়ী বাহুবল উপজেলার লামাতাসি ইউনিয়ন পরিষদ পরিদর্শনে যাই। ইউনিয়ন পরিষদের কাজকর্ম পর্যালোচনা করি। বর্তমানে জাতিসংঘের ইউএনডিপি কর্তৃক চলমান জঊঙচঅ প্রকল্পের কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত হই।
বিকেল ২টায় নিজ অফিসে ফিরে লাঞ্চ শেষে অপেক্ষায় থাকা দর্শনার্থীদের সাক্ষাৎ দিই ও অফিসের কাজকর্ম সারি। বিকেল সাড়ে ৪টায় কোর্ট মসজিদের নির্মাণ কাজের অগ্রগতি পরিদর্শন করি।
সন্ধ্যা ৭টায় সার্কিট হাউজে যাই। সেখানে ব্রি. জেনারেল মুজিবর রহমানের সঙ্গে পূর্বনির্ধারিত সভায় যোগদান করি। সভা শেষে রাত ৯টায় বাসায় ফিরে আসি।
বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জেলা প্রশাসক হিসেবে আমাকে এখন দুদিকের নির্দেশনায় কাজ ও কাজের জবাবদিহি করতে হচ্ছে। একদিকে সিভিল প্রশাসন এবং অপরদিকে মিলিটারি প্রশাসন। পান থেকে চুন খসেলেই শেষ! কোনো রক্ষাকবচ নেই। এরমধ্যে একবার আমি ঢাকা গিয়ে সংস্থাপন সচিব মহোদয়কে অনুরোধ জানিয়ে ছিলাম- আমাকে প্রত্যাহারের জন্য। তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেছিলেন, কে কাকে প্রত্যাহার করবে রে ভাই! আমার কিছু করার নাই। মুখ বুজে চোখ-কান খোলা রেখে চালিয়ে যাও।
৩১ অক্টোবর ২০০৭, বুধবার। সকাল সাড়ে ৯টায় হবিগঞ্জ প্রেসক্লাবে ঘঅঝওই কর্তৃক আয়োজিত ঞড়ঃধষ ছঁধষরঃু গধহধমবসবহঃ শীর্ষক সেমিনারে যোগদান করি। এরপর সেখান থেকে সাড়ে ১০টায় ইসলামিক ফাউন্ডেশনে গিয়ে মানবসম্পদ উন্নয়ন বিষয়ক কোর্সে ক্লাস নিই। সাড়ে ১১টায় আন্তর্জাতিক দুর্যোগ প্রশমন দিবস-২০০৭ এর র‌্যালি এবং আলোচনা অনুষ্ঠানে যোগদান করি।
সাড়ে ১২টায় ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রণয়ন এবং জাতীয় পরিচয়পত্র কার্যক্রম প্রকল্প বিষয়ক জেলা সমন্বয় কমিটি কর্তৃক আয়োজিত অনুষ্ঠানে যোগদান করি।
বিকেল ৩টায় এনজিও বিষয়ক জেলা সমন্বয় কমিটির সভায় সভাপতিত্ব করি। জেলার এনজিওগুলোর মধ্যে কাজের কোনো সমন্বয় নেই বললেই চলে। সবাই মাইক্রোক্রেডিট জালে দরিদ্রদের আটকে ফেলে দরিদ্রদের আরও দরিদ্রতর করে ফেলছে। ঋণের ওভারল্যাপিং এই সমস্যার মূল কারণ বলে বোঝা যায়। আমি এ জেলায় যোগদানের আগে এই সমন্বয় সভাটাই নিয়মিত হতো না। আমি এ ক্ষেত্রে কিছুটা সফল হতে পেরেছি। এখন সভাও নিয়মিত হচ্ছে, আর ঋণের ওভারল্যাপিংও কমে আসছে। উপরন্তু এনজিওদের স্থানীয় প্রশাসনের কাছে জবাবদিহি বেড়েছে। চলবে…