![](https://dailyhabiganjermukh.com/wp-content/uploads/2024/09/Untitled-1-1.jpg)
ইংরেজ সাহেবগণ চা বাগান ছেড়ে চলে গেলেও যে সাহেবিপনা রেখে গেছেন তা বাগানের অনুষ্ঠানে এলে চোখে পড়ে
আচমকা বাহুবল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রবেশ করি। দেড়টা বাজে কিন্তু কোনো ডাক্তারের চেহারার দর্শন পেলাম না। ওয়ার্ডসমূহে ঢোকার মুহূর্তে আমার স্টাফ অফিসার বলল, স্যার, মুখে রুমাল দিয়ে নিন। কেমন যেন একটা অভাবনীয় বিদঘুটে গন্ধে আমার নাড়িভুঁড়িতে ঘুর্ণিঝড় বয়ে গেল। এরমধ্যে দেখি কয়েকটি বিড়ালের অবাধ বিচরণ। বারান্দায় কুকুরও ২-৪টি বিশ্রাম নিচ্ছে। …অফিসে ফিরে ফ্রেশ হয়ে লাঞ্চ করতে বসার পরও কেন যে আমার ওই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কথা মনে পড়ল, যার জন্য আমার খিদে ওড়ে গেল। এমন অবস্থা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের থাকলে মানুষের স্বাস্থ্যের দশা কী হতে পারে- তা মাথায় কেবলই ঘুরপাক খেতে থাকে।
আতাউর রহমান কানন
ভাতিজির বিয়েতে যোগদান করে পরদিন সকাল ৮টায় আমি হবিগঞ্জের উদ্দেশে রওনা করি। আকাশটা মেঘে ঢাকা। যেকোনো সময় মেঘ গাঢ় হয়ে বৃষ্টি নামতে পারে। আমার গাড়ি ছুটে চলছে। পরিবারের সদস্যরা ঢাকার বাসায় রয়ে যাওয়ায় তাদের থেকে ক্রমেই আমার দূরত্ব বাড়তে থাকে। ভৈরবের ছাড়িয়ে আসার পর বৃষ্টিতে পেল। প্রায় আধঘণ্টা চলে। আমি ততক্ষণে হবিগঞ্জের প্রবেশদ্বার মাধবপুর উপজেলায় ঢুকে পড়ি। এদিকে কোনো বৃষ্টির আলামত দেখলাম না। আকাশজুড়ে কোনো গাঢ় মেঘমালাও নেই। ছেঁড়া ছেঁড়া শুভ্র মেঘখন্ড আকাশে দৌড়াড়ৌড়ি করছে। মেঘেদের এমনকান্ডে নাকি বৃষ্টি হয় না।
পাহাড় বনবনানী পেরিয়ে সকাল ১১টায় আমি বাসায় পৌঁছি। বাসায় ঢুকে কেন যেন আমার দুদিন আগে কমিশনারের সাথে ছুটি নিয়ে যা ঘটেছিল, তা মনে পড়ল। ভাবলাম, ফোন দিয়ে কমিশনারকে জানাই ‘আমি ফিরে এসেছি।’ আবার মন বলল, থাক, পড়ে হবে।
সাড়ে ১২টায় আমার অফিসের সম্মেলনকক্ষে যাই। সেখানে বাংলাদেশ অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার্স কল্যাণ সমিতি কর্তৃক আয়োজিত ‘শিশুবান্ধব বিচার ব্যবস্থা’ বিষয়ক সেমিনারে সভাপতি হিসেবে যোগদান করি। সেমিনারে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন বাংলাদেশ ল কমিশনের সদস্য সাবেক আইজিপি ড. এনামুল হক। আলোচনায় অংশ নেন হবিগঞ্জের আইনজীবী সমিতির নেতৃবর্গ, প্রেসক্লাবের সিনিয়র সাংবাদিক, সুধীজন ও জেলার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাগণ। লাঞ্চের মাধ্যমে সেমিনার শেষ হয়।
৫ আগস্ট ২০০৭, সোমবার। সকাল ৯টায় অফিসে যাই। অফিসারদের সালাম পাঠিয়ে আমার অফিসকক্ষে এনে কাজের খোঁজখবর নিই। আমার এমন ছুটির কাহিনি আমার অফিসারদেরও বিস্মিত করে। স্টাফ অফিসার আলমগীর হোসেন জানায়, গতকাল বিকেলে তাকে নাকি কমিশনারের পিএস ফোন করে জেনে নিয়েছে আমি ফিরেছি কি না। চায়ে আপ্যায়িত হয়ে অফিসারগণ যার যার কাজে চলে যান।
সকাল ১১টায় যৌথবাহিনীর সঙ্গে জেলার বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে সভা করি। হবিগঞ্জের পরিস্থিতি সার্বিক বিবেচনায় স্বাভাবিক। সভায় আমরা নানাবিধ বিষয় আলোচনা-পর্যালোচনা করে ভবিষ্যত করণীয় নির্ধারণ করি।
সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় জেলা ক্রীড়া সংস্থার কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় সভাপতিত্ব করি। সভা ডিনারের মাধ্যমে শেষ হয়।
৬ আগস্ট ২০০৭, মঙ্গলবার। সকাল ৯টা থেকে ২টা পর্যন্ত অফিসেই অবস্থান করি। অতঃপর বিকাল ৪টায় দিনারপুর রাগিব-রাবেয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজ মাঠে খন্দকার ট্রাস্টের চেক ও পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগদান করি। এখানে আয়োজিত অনুষ্ঠানে খন্দকার ট্রাস্টের সভাপতি আলহাজ সুফি মিয়া হবিগঞ্জ শহরের মাছুলিয়ায় নির্মাণাধীন ডায়াবেটিক হাসপাতালের জন্য অনুদান হিসেবে ৩৪ লাখ টাকার চেক আমার নিকট হস্তান্তর করেন। এছাড়া রাগিব-রাবেয়া কলেজের ২২ জন মেধাবী ছাত্রছাত্রীর মাঝে ১ লাখ ১০ হাজার টাকা উপবৃত্তি প্রদান করেন। অনুষ্ঠানে আমার বক্তব্যে সুফি মিয়ার ভূয়সী প্রশংসা করি এবং এমনিভাবে এলাকার দানবীরদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানাই। সেখান থেকে সন্ধ্যানাগাদ বাসায় ফিরে আবার চুনারুঘাট উপজেলার দেউন্দি চা বাগানের বার্ষিক ডিনারে যোগদান করি। ব্যাপক আয়োজন ছিল। ইংরেজ সাহেবগণ চা বাগান ছেড়ে চলে গেলেও তাঁদের সাহেবিপনা যে রেখে গেছেন, তা বাগানের অনুষ্ঠানে এলে চোখে পড়ে। এসপি ও সিও সাহেবও আমার সঙ্গে আমন্ত্রিত ছিলেন। আশেপাশের বাগানের ম্যানেজারগণও সে ডিনারে অংশগ্রহণ করেন। বাগান থেকে ফিরতে ফিরতে রাত ১০টা বেজে যায়।
৮ আগস্ট ২০০৭, বুধবার। সকাল ১০টায় বাহুবল যাই। আমার রুটিন ওয়ার্কের অংশ হিসেবে ইউএনও অফিস, এসি(ল্যান্ড) অফিস ও একটি প্রাইমারি স্কুল পরিদর্শন করি। ফেরার পথে আচমকা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রবেশ করি। দেড়টা বাজে কিন্তু কোনো ডাক্তারের চেহারার দর্শন পেলাম না। ওয়ার্ডসমূহে ঢোকার মুহূর্তে আমার স্টাফ অফিসার বলল, স্যার, মুখে রুমাল দিয়ে নিন।
কেমন যেন একটা অভাবনীয় বিদঘুটে গন্ধে আমার নাড়িভুঁড়িতে ঘুর্ণিঝড় বয়ে গেল। এরমধ্যে দেখি কয়েকটি বিড়ালের অবাধ বিচরণ। বারান্দায় কুকুরও ২-৪টি বিশ্রাম নিচ্ছে। এমন পরিবেশে আমরা ‘সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা’ দিচ্ছি! আমি টিকতে না পেরে বেরিয়ে এলাম। গাড়িতে বসে আমার স্টাফ অফিসারকে বললাম, সিভিল সার্জনকে এসব বিষয় উল্লেখকরত দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য একটি পত্র রেডি করতে।
অফিসে ফিরে ফ্রেশ হয়ে লাঞ্চ করতে বসার পরও কেন যে আমার ওই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কথা মনে পড়ল, যার জন্য আমার খিদে ওড়ে গেল। এমন অবস্থা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের থাকলে মানুষের স্বাস্থ্যের দশা কী হতে পারে- তা মাথায় কেবলই ঘুরপাক খেতে থাকে।
৯ আগস্ট ২০০৭, বৃহস্পতিবার। আজ সকাল ১১টায় পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ড. ইফতেখার আহমদ চৌধুরী তাঁর পূর্বনির্ধারিত সফরসূচি অনুযায়ী হবিগঞ্জ আসেন। তিনি আমার কনফারেন্স রুমে জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে এক মতবিনিময় সভা করেন। এরপর বেলা ১টায় শহরের কেন্দ্রস্থলে নবনির্মিত ‘আমির-চাঁন কমপ্লেক্স’ নামক একটি বহুতল সুরম্য ভবন উদ্বোধন করেন। লন্ডন প্রবাসী আবুল কাশেম তাঁর বাবা-মায়ের নামে এই শপিংমল কাম আবাসিক হোটেলটি নির্মাণ করেছেন। হবিগঞ্জ শহরে এটিই এযাবৎকালের বৃহৎ কমপ্লেক্স ভবন। লাঞ্চ শেষে মাননীয় উপদেষ্টা বিকেল সোয়া ৩টায় সিলেট যাওয়ার পথে খোয়াই নদীর ভাদৈ এলাকার বাঁধ পরিদর্শন করেন। শহররক্ষা এই বাঁধের বেশ কিছুটা অংশ সম্প্রতি পাহাড়ি ঢলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যা জেলায় কর্মরত সেনাবাহিনীর উদ্যোগে সংস্কার করা হয়।
১৪ আগস্ট ২০০৭, মঙ্গলবার। সকাল ১০টায় বন্যা পূর্বসতর্কীকরণ সেমিনারে যোগদান করি। ১১টায় জেলা কারাগার পরিদর্শনে যাই। সেখান থেকে ফিরে সাড়ে ১২টায় ‘আলোর সন্ধানে শিক্ষা ফাইন্ডেশন’ গঠন বিষয়ক সাধারণ সভা করি। জেলার ধনাঢ্য ব্যক্তিদের নিয়ে বেশ কয়েকদিন ধরেই এ বিষয়ে গ্রাউন্ডওয়ার্ক করা হয়। এতে প্রবাসী ব্যক্তিবর্গও রয়েছেন। এ ফাউন্ডেশনের মূল সহযোগী উদ্যোক্তা হলেন- সেনা ইউনিটের সিও কর্নেল মনিরুল ইসলাম আখন্দ। আজকের সভায় খসড়া গঠনতন্ত্র অনুমোদন করা হয়। এ গঠনতন্ত্র মোতাবেক জেলা প্রশাসক পদাধিকার বলে এই ফাউন্ডেশনের সভাপতি, পুলিশ সুপার সহসভাপতি ও এডিসি (জেনারেল) সম্পাদক। আর প্রতিষ্ঠালগ্নের সভাপতি আজীবন ফাউন্ডেশনের সদস্য থাকবেন। তিনি যেখানেই থাকবেন তাকে বার্ষিক সাধারণ সভায় গেস্ট অব অনার করা হবে। এই ফান্ডে ৩ লাখ বা ততোধিক টাকা অনুদানকারী ট্রাস্টি এবং এর নিচে সর্বনিম্ন ১লাখ টাকা অনুদানকারীগণ আজীবন সদস্য বলে গণ্য হবেন। এ ছাড়া জেলার যেকোনো ব্যক্তি ১০০০ টাকা চাঁদা দিয়ে এক মেয়াদের (তিন বছর) জন্য সাধারণ সদস্য হতে পারবেন। আজ প্রথমদিনেই ট্রাস্টিদের কাছ থেকে ৫০ লাখ টাকার চেক গ্রহণ করা হয়। আরও প্রায় ৩০ লাখ টাকার প্রতিশ্রুতি পাওয়া যায়। অচিরেই এই ফাউন্ডেশনের ফান্ড এক কোটিতে উন্নীত করতে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়। এই ফান্ডের টাকা একটি ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট করা হবে এবং প্রাপ্ত লভ্যাংশ হতে জেলার দরিদ্র মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী এবং অসচ্ছল শিক্ষাবিদ, শিল্পী-সাহিত্যিকগণ বার্ষিক কিংবা এককালীন সাহায্য-অনুদান পাবেন। এ ছাড়া জেলার কৃতী ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, শিল্পী-সাহিত্যিকদের সংবর্ধনা ও পুরস্কার এবং জেলার শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রসার ও মৌলিক গবেষণার ক্ষেত্রে অনুদান প্রদান করা হবে। (চলবে…)