‘ডিসিরা যদি আমলা হয়, তবে কামলা কারা?’

আতাউর রহমান কানন

৪ মার্চ ২০০৭, রবিবার। সকাল সাড়ে ৯টায় দি রোজেস কালেক্টরেট স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগদান করি। সেখান থেকে অফিসে ফিরে আসন্ন দাখিল পরীক্ষা পরিচালনা সংক্রান্ত সভা করি। সকাল ১০টায় খোয়াই নদীর ওপর নির্মিত কামড়াপুর ব্রিজের ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতা নিরসনকল্পে এক সভায় মিলিত হই। সভায় সেনাবাহিনীর সিও কর্নেল মনির ও এসপি মান্নান যোগদান করেন। সড়ক ও জনপথ বিভাগ বেশ কয়েকমাস আগেই ব্রিজটির নির্মাণ কাজ শেষ করে বসে আছে। অ্যাপ্রোচ রোড অংশের অধিগ্রহণকৃত ভূমির ক্ষতিপূরণের পাওনা পরিশোধ নিয়ে ভূমি মালিকদের ওয়ারিশগণের মধ্যে বিরোধ দেখা দেওয়ায় রোডের ওই অংশের কাজ শেষ না হওয়ায় ব্রিজটি চালু করা যাচ্ছে না। আর জনস্বার্থে সরকারের কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ব্রিজটির কোনো সুফল জনগণ পাচ্ছেন না। সভা শেষে সড়ক ও জনপথের নির্বাহী প্রকৌশলীকে নিয়ে কর্নেল, এসপি ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-সহ ব্রিজ এলাকা পরিদর্শন করি। বিরোধীয় ভূমির মালিকগণও উপস্থিত ছিলেন। আমরা তাদের শুনানী নিলাম। পাওনার বিষয়ে ভূমির মালিকানা পরীক্ষা করে ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তাকে তা পরিশোধের জন্য তাৎক্ষণিকভাবে নির্দেশ দিলাম। আর নির্বাহী প্রকৌশলীকে প্রয়োজনীয় কাজ সমাপ্ত করে একমাসের মধ্যে ব্রিজটি চালুর ব্যবস্থা নিতে বললাম। এখন সামরিক-বেসামরিক যৌথ কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা হওয়ায় সবাই ‘জি স্যার’ বলল। আমরা সেখান থেকে সন্তুষ্টি নিয়ে ফিরে এলাম।
সন্ধে সাড়ে ৬টায় হবিগঞ্জের খ্যাতনামা সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান সুরবিতান ললিতকলা একাডেমিতে যাই। পদাধিকার বলে আমি এটির সভাপতি। আমি এবারই প্রথম এখানে এসে পরিচালনা কমিটির সভা করি। সভা শেষে পরিদর্শন বহিতে মন্তব্য লেখার সঙ্গে সেক্রেটারির অনুরোধে সুরবিতানের ওপর একটি গান লিখে দিই। সে গানটির শিরোনাম ‘সুরবিতান সংগীত’ দেওয়া হয়। একাডেমির সেক্রেটারি প্রখ্যাত শিল্পী ও সুরকার সিদ্ধার্থ বিশ্বাস গানটির সুরারোপ করে আগামী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সূচনা সংগীত হিসেবে পরিবেশন করবেন বলে অনুমতি চান। আমি সহাস্যবদনে অনুমতি দিয়ে সাড়ে ৭টায় বাসায় ফিরে আসি।
৫ মার্চ ২০০৭, সোমবার। সকাল ৯টায় বাহুবলের উদ্দেশে রওনা করি। সেখানে পৌঁছে ইউএনও অফিসে আয়োজিত জন্মনিবন্ধন অবহিতকরণ কোর্সের উদ্বোধন করি। উপজেলার কর্মকর্তাগণ ছাড়াও বিভিন্ন শ্রেণি পেশার লোকজন কোর্সে অংশগ্রহণ করেন। বাহুবল থেকে রওনা হয়ে ১১টায় নবীগঞ্জ ডিগ্রি কলেজে পৌঁছি এবং কলেজের গভর্নিং বডির সভায় সভাপতিত্ব করি। কলেজ থেকে সাড়ে ১২টায় বিবিয়ানা গ্যাস ফিল্ডে যাই। সেখানে আগামী ১৮ তারিখে প্রধান উপদেষ্টা ড. ফখরুদ্দীন আহমেদ এসে গ্যাসফিল্ডের আনুষ্ঠানিক উৎপাদন উদ্বোধন করবেন। পুলিশ সুপার বিবিয়ানায় এসে আমার সাথে যোগদান করেন। প্রধান উপদেষ্টার আগমন উপলক্ষ্যে হেলিপ্যাড নির্মাণ ও সভাস্থলের স্থান পরিদর্শন করি।
বিকেল তিনটায় বাসায় ফিরে লাঞ্চ করে অফিসে যাই। কাজকর্ম শেষে বিকেল ৫টায় লস্করপুর সাহেব বাড়িতে পূর্বনির্ধারিত প্রোগ্রামে যাই। ঐতিহ্যবাহী সাহেব বাড়ি ও এর আঙিনা দেখে অভিভূত না হয়ে উপায় নেই। এ বাড়ির কৃতী সন্তানদের দুজন দেশের প্রধান বিচারপতি হয়েছেন। এদের একজন সৈয়দ জে আর মোদাচ্ছির হুসেন যিনি গত ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০০৭ অবসরে গেছেন। এছাড়াও রয়েছেন দেশে-বিদেশে কয়েকজন উচ্চপদধারী। তবে বাগান পরিবেষ্টিত বাড়িটি লোকের অভাবে যেন খা খা করছে। এ বাড়ির আঙিনার একপাশে আহছানিয়া মহিলা মিশনের নির্মিতব্য ভবনের ভিস্তিপ্রস্তর স্থাপনের আজ আমি প্রধান অতিথি। ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন শেষে সন্ধ্যালগ্নে সেখান থেকে বিদায় নিই।
৬ মার্চ ২০০৭, মঙ্গলবার। ফাল্গুনের সকাল। চমৎকার পরিষ্কার আকাশ। আমি অভ্যাসবশত বাসভবনের ভেতর আঙিনার পুকুরের চারপাশ দিয়ে কয়েকটি চক্কর দিয়ে বাসায় ঢুকে ফ্রেশ হলাম। স্ত্রী-কন্যার সাথে বসে নাশতা সারলাম। কদিন আগে ওরা ঢাকা থেকে এসেছিল। মেয়েটার স্কুল কামাই হচ্ছে বলে আজ সকালেই তারা চলে যাবে। আমি আবার একা হয়ে চাকরির ঘানি টানায় ব্যস্ত হয়ে পড়ব। নাশতার পর নিচতলায় নেমে বাসার অফিসে বসে টেবিলে জমা থাকা নথিগুলো নিষ্পত্তি করলাম। সাড়ে দশটার দিকে মেয়েটা আমার কাছে এসে বলল, বাবা আমরা রেডি, চলে যাচ্ছি। তুমি কবে ঢাকায় আসবে?
আমি বললাম, আমার তো মা ছুটিছাটার বিষয় থাকে। তবু খুব শিগগিরই আসব। মন দিয়ে পড়াশুনা করো।
মেয়েটা ঘাড় নেড়ে ‘ঠিক আছে’ বলে আবার দোতলায় চলে গেল। বাইরে ঢাকায় যাওয়ার গাড়ি প্রস্তুত। একটু পড়েই মা-মেয়ে নেমে এলে তাদের গাড়িতে তুলে দিই। গাড়ি বাসভবনের গেট দিয়ে বেরিয়ে যায়। আমি সেদিকে চেয়ে রইলাম, আর আমার মন খানিকটা পারিবারিক বিচ্ছেদ বেদনা অনুভব করল।
আমি ১১টায় অফিসে যাই। দেশে সব জিনিসপত্রের দামই নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে। নিত্যপণ্যের মূল্যের ঊর্ধ্বমুখিতা কোনোভাবেই যেন ঠেকানো যাচ্ছে না। একদিকে রাজনীতিক ও দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ীদের ধরপাকড় চলছে, অপরদিকে সব জিনিসপত্রের দাম বেড়েই চলছে। সরকার থেকে মূল্য নিয়ন্ত্রণের যথাযথ কার্যক্রম নেওয়ার জন্য নির্দেশনা পেয়ে যাচ্ছি। আর্মি-পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা একটা কঠিন ও অবাস্তব কাজ বলে বিগত কয়েকদিনে অনুধাবন করেছি। বেশি দামে পণ্য বিক্রয়কারীকে ধরা যায়, শাস্তি দেওয়া যায়; এতে উপস্থিত দাম কমে কিন্তু তারা মাঠ থেকে ফিরে আসলে ‘যে লাউ সেই কদু’। এতে ব্যবসায়ীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। উপরন্তু বাজার থেকে পণ্য গায়েব। ফলশ্রুতিতে, ক্রেতাদের মধ্যে আরও হাহাকার বাড়ে। যার লাগে এক কেজি সে কিনে নেয় পাঁচ কেজি। তবু প্রশাসনের তো আর হাত-পা গুটিয়ে থাকলে চলে না। উপায় বের করতেই হবে। আজ দুপুর ১২টায় উপায় হিসেবে ব্যবসায়ী সমিতির নেতৃবর্গ নিয়ে আমার অফিসে আবার দ্বিতীয়বারের মতো বসলাম। সভায় এসপি মান্নান ও সেনা ইউনিটের সিও কর্নেল মনির উপস্থিত ছিলেন। প্রেসক্লাবের সভাপতি ও সেক্রেটারিসহ সিনিয়র সাংবাদিকদের সভায় আমন্ত্রণ জানানো হয়। ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সমস্যা শুনে সিও সাহেব নরমেগরমে কিছু বললেন। এসপি সাহেবও তথাস্তু।
আলোচনা শেষে সমাধান হিসেবে শহরের ১০টি মুদি-মনোহারি দোকানকে চিহ্নিত করা হয়- সেখানে নিত্যপণ্য নির্ধারিত খুচরা মূল্যেই বিক্রি করা হবে। অন্যান্য দোকানেও বাধ্যতামমূলক মূল্য তালিকা টাঙানো হবে। ম্যাজিস্ট্রেট-পুলিশ-আর্মি ও ব্যবসায়ী সমিতির প্রতিনিধি সার্বক্ষণিকভাবে বাজার মনিটরিং করবে। আর মজুদ প্রতিরোধ করার জন্য সরকারি বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা কাজ করবে। সভায় গুরুত্বপূর্ণ এসব সিদ্ধান্ত নিয়ে সকলকে প্রথানুযায়ী ধন্যবাদ দিয়ে সভা শেষ করি।
৭ মার্চ ২০০৭, বুধবার। সকাল ৯টায় অফিসে গিয়ে আজ নির্ধারিত মাসিক সভা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। জেলা আইনশৃঙ্খলা, পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেসি, জুডিসিয়াল কনফারেন্স, রেভিনিউ কনফারেন্স ইত্যাদি-সহ সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত মোট ১২টি সভায় সভাপতিত্ব করি। সভা গুলোতে জেলার বিভিন্ন অফিস প্রধান ছাড়াও ইউএনওগণ সদস্য। সভাসমূহের নির্ধারিত আলোচ্যসূচির বাইরে গিয়েও দ্রব্যমূল্য নিয়ে আলোচনা করা হয়। ইউএনওগণকে তাঁদের নিজ নিজ উপজেলায় জেলায় গৃহীত কার্যক্রমের আলোকে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণের নিদের্শনা দেওয়া হয়।
দিনে অফিসে সভা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় কোনো ফাইলওয়ার্ক করতে পারিনি। সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে বাসভবনের অফিসে এসে দেখি ফাইলের পাহাড়। কী আর করা! ফ্রেশ হয়ে ফাইলের কাজ করতে শুরু করলাম। শেষ হলো রাত ১১টায়। আজ রাতের খবরে দেখলাম, তারেক জিয়াকে যৌথবাহিনী দুর্নীতির অভিযোগ গ্রেপ্তার করেছে। এ গ্রেপ্তারের তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া টিভি চ্যানেলে দেখলাম না।
৮ মার্চ ২০০৭, বৃহস্পতিবার। আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষ্যে জেলা মহিলা অধিদপ্তর ও জেলা মহিলা সংস্থা কর্তৃক আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগদান করি। সেখান থেকে ১১টায় মাসিক জেলা কারাগার পরিদর্শনে যাই। কারাগারের রুটিন পরিদর্শন শেষে বেলা ১১টায় সদর উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে আয়োজিত ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান-মেম্বারদের বেসিক কোর্সে ক্লাস নিই। অতঃপর চলমান এসএসসি ও দাখিল পরীক্ষার কয়েকটি কেন্দ্র পরিদর্শন করি। বিকেল দেড়টায় সেনাবাহিনীর এরিয়া কমান্ডার মেজর জেনারেল হাফিজ আহমেদ আসেন সার্কিট হাউজে। তাঁর সঙ্গে আমার ও এসপি সাহেবের সৌজন্য সাক্ষাৎ ও পূর্বনির্ধারিত সভা হয়। আমাদের কম শুনে তিনিই বেশি বলেন। বর্তমানে দেশের পরিস্থিতি ও করণীয় বিষয়ে তিনি কিছু দিকনির্দেশনা দেন। সভা শেষে আমি সাড়ে তিনটায় অফিসে ফিরে আসি। অফিসে কয়েকজন সাক্ষাৎপ্রার্থী ছিলেন। তাঁদের সাক্ষাৎ দিই। এর মধ্যেই কিছু জরুরি কাজকর্ম সেরে সন্ধে ৬টায় বাসায় ফিরে আসি। ৭টায় বাসভবনের অফিসিয়াল ড্রয়িংরুমে কোর্ট মসজিদের পরিচালনা কমিটির সভা করি। এরপর বাসার অফিসরুমে বসে সারাদিনের জমানো ফাইলের কাজ করে রাত সাড়ে ১২টায় ঘুমাতে যাই।
‘ডিসিরা যদি আমলা হয়, তবে কামলা কারা?’ এমন কথা আমার মাথায় এখন মাঝেমধ্যেই মনে পড়ছে। কথাটি বলেছিলেন, সিলেটের প্রথম বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান। আমি দিনের কাজ দিনে শেষ করে অফিস ত্যাগ করি। এরপর যেদিন অফিসের বাইরে প্রোগ্রাম থাকে, সেদিনের ফাইলগুলো অফিস সহকারীগণ বাসভবনের অফিসে এনে রাখে। সন্ধ্যার পর বাসভবনের অফিসে বসে তা নিষ্পত্তি করে তবেই আমার নিঃশ্বাস স্বাভাবিক হয়।