ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন এমপি ডিআইজিসহ পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ দীর্ঘদিন ধরে বানিয়াচং উপজেলার আগুয়া গ্রামে চলছে গোষ্ঠীভিত্তিক দ্বন্দ্ব। বিগত ইউপি নির্বাচনে এই বিরোধ তুঙ্গে উঠে। দুই গোষ্ঠীর দুইজন ইউপি সদস্য পদে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এরপর থেকে গ্রামটিতে দুইপক্ষের লোকজনের মধ্যে বিরোধ বাড়তে থাকে। সেই বিরোধ থেকেই বৃহস্পতিবার সিএনজিতে যাত্রী উঠানো নিয়ে দুইপক্ষের লোকজনের সংঘর্ষে ৩ জন নিহত হন। নিহতরা সকলেই একপক্ষের লোক। এ ছাড়াও গুরুতর আহতাবস্থায় কয়েকজন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। গতকাল শুক্রবার সকালে আগুয়া গ্রামে গিয়ে লোকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের জেরে এই ভয়াবহ সংঘর্ষ সংঘটিত হয়েছে। সংঘর্ষে একপক্ষের ৩ জন নিহতের ঘটনায় তাদের পরিবারে চলছে শোকের মাতম। নিহতের স্বজনদের আহাজারি ও বিলাপে পরিবেশ ভারী হয়ে উঠেছে। এছাড়াও বেশ কিছু বাড়িঘর ভাঙচুর হওয়ার দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়। এরইমধ্যে ওই সংঘর্ষে জড়িত একপক্ষের লোকজন বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছেন। গ্রামের একটি প্রান্তে গিয়ে দেখা যায়, নিহত ৩ জনকে দাফন করার জন্য পাশাপাশি তিনটি কবর খোঁড়া হচ্ছে।
গতকাল শুক্রবার দুপুরে সংঘর্ষে নিহত কাদির মিয়া, লিলু মিয়া ও সিরাজ মিয়ার মরদেহ ময়নাতদন্ত শেষে স্বজনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। বিকেলে মন্দরী ইউনিয়ন পরিষদ কমপ্লেক্স প্রাঙ্গণে ৩ জনের জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় স্থানীয় সংসদ সদস্য ময়েজ উদ্দির শরীফ রুয়েল, সাবেক সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট আব্দুল মজিদ খান, সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি শাহ মিজান শাফিউর রহমান ও হবিগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হাসিবুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন। এর আগে ডিআইজি নিহত ৩ জনের স্বজনদের সাথে কথা বলে তাদের ন্যায়বিচার পাওয়ার আশ্বাস দেন।
সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি শাহ মিজান শাফিউর রহমান নিহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে বলেন, প্রকৃত আসামিদের গ্রেফতার করা হবে। গ্রাম্য রাজনীতির মারপ্যাচে কোনো নিরীহ ব্যক্তিকে যেন ফাঁসানো না হয় সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা হবে। ৪/৫ মাসের মধ্যে এ মামলার চার্জশিট দেওয়া হবে।
বানিয়াচং থানার ওসি মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন জানান, ময়নাতদন্ত শেষে স্বজনের কাছে ৩টি মরদেহ হস্তান্তর করা হয়। গতকাল শুক্রবার আছরের নামাজের পর জানাজা শেষে মরদেহ দাফন করা হয়। এ ঘটনায় এখনও কোনো মামলা দায়ের হয়নি। হত্যাকান্ডে জড়িতদের গ্রেফতারে পুলিশের অভিযান চলছে। এছাড়া অস্থায়ীভাবে আগুয়া গ্রামে পুলিশের একটি ক্যাম্প বসানো হয়েছে।
নিহত ৩ জনের গোষ্ঠীর সর্দার মোঃ হাবিবুর রহমান বলেন, আগুয়া গ্রামের সিএনজি স্ট্যান্ডের ম্যানেজার বদরুল আলম বদির ও সোহেল মিয়া গত ইউপি নির্বাচনে মেম্বার পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এতে সোহেল মিয়া জয়ী হন। এরপর থেকে বদরুল আলম ও তার লোকজন আমাদের গোষ্ঠীর লোকজনের সাথে মারামারি করার জন্য ওঠেপড়ে লাগে। কিন্তু ঝগড়া এড়াতে তাদের উসকানিতে পা দেইনি।
মোঃ হাবিবুর রহমান আরো বলেন, বৃহস্পতিবার সকালে আমার ভাতিজা কাদির মিয়া বাড়ির পাশ থেকে সিএনজিতে একজন যাত্রী ওঠায়। বিষয়টি জেনে ম্যানেজার বদরুল আলম তাকে স্ট্যান্ডের অফিসে ডাকেন। কাদির মিয়া অফিসে গেলে তাকে কয়েকজন মিলে বাজে ভাষায় গালিগালাজ ও মারপিট করে। ঘটনাটি লাইন সভাপতি আশিক মিয়াকে জানানো হলে তিনি বিষয়টি দেখার আশ্বাস দেন। বেলা ২টার দিকে বদরুল আলম ও তার লোকজন কাদিরের বসতবাড়ি ঘেরাও করে হামলায় চালায়। এরপর দুইপক্ষের সংঘর্ষ শুরু হয়। এতে আমাদের ৩ জনকে নৃশংসভাবে হত্যা করে বদরুলের লোকজন।
নিহত লিলু মিয়ার মা সুন্দর বানু বলেন, যারা আমার ছেলেকে হত্যা করেছে তাদের ফাঁসি চাই। আমার চারজন নাতি-নাতনি এতিম হয়ে গেল। এখন তাদের মুখে ভাত দেওয়ার কেউ রইল না।
নিহত সিরাজ মিয়ার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় সবাই মিলে আহাজারি করছেন। ১০ বছরের মেয়ে মার্জিয়া বিছানায় লুটোপুটি খেয়ে বলছে, এখন আমি কাকে বাবা ডাকব? আমাদের কে আদর করবে।
অপর নিহত সিএনজি-অটোরিকশা চালক কাদির মিয়ার বাড়িতেও একই দৃশ্য। বাড়ির উঠোনে কাদির মিয়ার ১ বছর বয়সী সন্তানকে কোলে নিয়ে তার মা আহাজারি করে বলেন, দুপুরের মধ্যে আমার কাদির দুই তিনবার তার সন্তানদের দেখতে বাড়িতে আসত। বাপের জন্য তারা অপেক্ষায় থাকত সবসময়। এখন এরা কার জন্য অপেক্ষা করবে? এদেরকে কারা দেখে রাখবে?
নিহত লিলু মিয়ার চাচাত ভাই খলিল মিয়া বলেন, বদরুল আলম বদির অনেকদিন ধরে আমাদের সঙ্গে ঝগড়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। গতকাল সামান্য বিষয় থেকে পরিকল্পনামাফিক হামলা চালিয়ে আমাদের ৩ জন মানুষকে হত্যা করেছে তারা।
স্থানীয় ইউপি সদস্য সোহেল মিয়ার ভাই বাবুল মিয়া বলেন, আমার ভাইয়ের কাছে নির্বাচনে পরাজিত হয় বদরুল আলম বদির। এরপর থেকে বদির ও তার লোকজন আমাদের সঙ্গে ঝগড়ার পরিকল্পনা নিচ্ছিল। গতকাল তুচ্ছ বিষয়কে কেন্দ্র করে মুহূর্তের মধ্যে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আমাদের ওপর হামলা চালিয়েছে। আমরা নিজেদের আত্মরক্ষার জন্য প্রতিরোধ করতে চেয়েছি। এর মধ্যে তারা আমাদের ৩ জনকে মেরে ফেলে। বিকেলে গ্রামের কবরস্থানে একই সাথে পাশাপাশি কবরে ৩ জনকে দাফন করা হয়।
উল্লেখ্য, বৃহস্পতিবার বানিয়াচং উপজেলার আগুয়া গ্রামে সিএনজি অটোরিক্সাতে যাত্রী উঠানোকে কেন্দ্র করে দুইপক্ষের লোকজন সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে । এতে ৩ জন নিহত হন। নিহতরা হলেন, লিলু মিয়া (৪০), সিএনজি চালক কাদির মিয়া (৩০) ও সিরাজ মিয়া (৫০)।