ভূমিকা: মোঃ আতাউর রহমান ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দুই বছর হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক ছিলেন। হবিগঞ্জে দায়িত্ব পালনকালীন সময়ের প্রতিটি মুহূর্ত তিনি নিজের ডায়েরিতে লিখে রেখেছেন। তাঁর সেই ডায়েরিতে ফুটে উঠেছে হবিগঞ্জের বৈচিত্রময় চিত্র। দৈনিক হবিগঞ্জের মুখ পত্রিকার পাঠকদের জন্য তাঁর ডায়েরি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে-

সবকিছু দেখে আমি এসিল্যান্ডকে আটকের বিষয়ে আর কোনো বাঁধা দিলাম না

রাতে সেনা ইউনিটের সিও কর্নেল মনির টেলিফোন করে বাসায় আসেন। তিনি এসি ল্যান্ডের বিরুদ্ধে সংছৃহীত কিছু ডকুমেন্ট উপস্থাপন করেন। তাতে ব্যাংক স্টেটমেন্ট ও টাকা জমা দেওয়ার স্লিপও রয়েছে। তাঁর কর্মস্থলের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা হওয়া টাকার পরিমাণ প্রশ্নবোধক বটে

আতাউর রহমান কানন

১৩ ফেব্রুয়ারি ২০০৭, মঙ্গলবার। সকাল ৯টায় অফিসে গিয়ে এডিএম ও তাঁর অধীনস্থ ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ে বসি। কোর্ট পরিচালনা নিয়ে কিছু জরুরি বিষয় আলাপ করি। যৌথবাহিনীর অভিযানে বিভিন্ন ধরনের অপরাধীদের আটক করে কোর্টে সোপর্দ করা হচ্ছে। তাদের বিষয়ে কথা বলি। ম্যাজিস্ট্রেটদের নিরপেক্ষ ও সততার সাথে কোর্ট পরিচালনার জন্য পরামর্শ দিই। এরপর সকাল ১১টায় এডিসি জেনারেলসহ শিল্প-উদ্যোক্তাদের নিয়ে আয়োজিত বিসিকের কর্মশালায় যোগদান করি। দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত কর্মশালাটি উদ্বোধন করে অফিসে ফিরে আসি।
সাড়ে ১২টা থেকে আমার অফিসে হবিগঞ্জ ব্যবসায়ী সমিতির সাথে এক জরুরি সভায় মিলিত হই। সভায় এসপি ও সেনা ইউনিটের সিও যোগদান করেন। দেশে জরুরি অবস্থা জারির পর আইনশৃঙ্খলার প্রভূত উন্নতি সাধন হলেও নিত্যপণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী। বাজারে অভিযান চালিয়েও তেমন সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। আজ ব্যবসায়ীদের নিয়ে সভায় বসে বাজার স্বাভাবিক রাখার পন্থা উদ্ভাবনের আলোচনা করা হয়। আলোচনায় খুচরা ব্যবসায়ীগণ পাইকারদের, আর পাইকারগণ উৎপাদনকারী ও আমদানিকারকদের দোষারোপ করেন। এছাড়া পরিবহণ ব্যয়বৃদ্ধিও একটা বড় কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন। পরিবহণ ব্যয় বৃদ্ধির কারণ হিসেবে ব্যবসায়ী নেতারা জানান যে, আগে ৫ টনের ট্রাকে ১০-১২টন মাল টানা যেত, এখন সেনাবাহিনীর তৎপরতার কারণে তা আর সম্ভব না হওয়ায় পরিবহণ ব্যয় দ্বিগুণ পড়ে। সে ব্যয় গিয়ে পণ্যের ওপর পড়ায় আগের দামে আর পণ্য বিক্রি করা যাচ্ছে না। তবে আমাদের আজকের সভায় ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ ওয়াদা করেন যে, তাঁরা দ্রব্যমূল্য স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করবেন এবং আগের কেনা মাল আগের দামেই বিক্রি করবেন। অতিরিক্ত মুনাফার লোভে কোনো মাল মজুদ করে বাজারকে অস্থিতিশীল করবেন না।
বিকেল ২টায় হবিগঞ্জ কেন্দ্রীয় ঈদগাহ কমিটির সভায় সভাপতিত্ব করি। সৈয়দ আহমদুল হক সাহেব কমিটির সেক্রেটারি। তিনি বিগত বছরের আয়-ব্যয়ের হিসাব উপস্থাপন করেন। এরপর ঈদগাহের উন্নয়ন কাজের অসমাপ্ত অংশ সমাপ্ত করার বিষয় তুলে ধরেন। আলোচনায় দেখা যায় যে, ঈদগাহের সঞ্চিত বাজেটে পর্যাপ্ত টাকা এ মুহূর্তে নেই। তবে কাজ ধরলে টাকার অভাব হবে না বলেও শাহ সাহেব জানান। ইতিমধ্যে প্রবাসী কয়েকজন নাকি কথা দিয়েছেন। আমি কাজ ধরার জন্য সভায় সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত দিলাম এবং আগামী ঈদের আগেই সংস্কার কাজ শেষ করার আশাবাদ ব্যক্ত করে সভা শেষ করি।
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৭, বৃহস্পতিবার। গতকাল বিকেলে ঢাকায় এসেছি। বর্তমান কেয়ারটেকার সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সাথে আজ তাঁর কার্যালয়ে সকাল ১০টায় দেশের সকল ডিসি-এসপিদের নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক সভা হয়। আমি সে সভায় যথাসময়ে যোগদান করি। সভা সাড়ে ১২টায় শেষ হলে বাসায় রওনা করি। পথিমধ্যে হবিগঞ্জের সেনা ইউনিটের সিও কর্নেল মুনির ফোনে জানান যে, মাধবপুরের এসি ল্যান্ডের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। তাকে এখন গ্রেফতার করা দরকার।
ফোনের সংবাদ আমার মনে ধাক্কা দিল। দেশে এখন শুদ্ধি অভিযান চলছে। দুর্নীতির অভিযোগে বিভিন্ন স্থানে রাজনীতিবিদ-ব্যবসায়ী-চাকরিজীবী গ্রেফতার হচ্ছেন। এসব গ্রেফতার প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সমানে প্রচার করছে। আমি আমার অধীনস্থ সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সর্বদাই সাবধান করে যাচ্ছি, তারপরও এমন ঘটনা আমার প্রশাসনের জন্য একটা খারাপ সংকেত বটে! আমি তাৎক্ষণিকভাবে কর্নেলকে বললাম, দরকার হলে অবশ্যই গ্রেফতার হবে। আমি ঢাকা থেকে ফিরে যা করার করব। তখন কর্নেল সাহেব বললেন, ওকে, তাই হবে।
১৭ ফেব্রুয়ারি ২০০৭, শনিবার। সকালে ঢাকা থেকে কর্মস্থলের উদ্দেশে রওনা করে মধ্যাহ্নে হবিগঞ্জের বাসায় এসে পৌঁছি। হবিগঞ্জের সীমানায় মাধবপুর উপজেলায় প্রবেশ করতেই আমার এসি ল্যান্ডের কথা মনে পড়ল। আমি ফিরে আসায় আজই হয়তো সেনা ইউনিটের সিও আমার সঙ্গে সাক্ষাতে এসে ওই এসি ল্যান্ডকে গ্রেফতারের অনুমতি চাইবেন। এটা নিঃসন্দেহে তাঁর কর্মতৎপরতার জন্য প্লাস পয়েন্ট আর আমার প্রশাসনের জন্য মাইনাস।
আমি সারাদিন বাসাতেই ছিলাম। আমার অফিসের এডিএম ও এডিসিদ্বয় এসে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে গেছেন। অফিসের কেউ এসি ল্যান্ডের দুষ্কর্মের বিষয় জানেন বলে মনে হল না। আমিও বিষয়টি নিয়ে কোনো কথা বলিনি।
রাতে সেনা ইউনিটের সিও কর্নেল মনির টেলিফোন করে বাসায় আসেন। তিনি এসি ল্যান্ডের বিরুদ্ধে সংগৃহীত কিছু ডকুমেন্ট উপস্থাপন করেন। তাতে ব্যাংক স্টেটমেন্ট ও টাকা জমা দেওয়ার স্লিপও রয়েছে। তাঁর কর্মস্থলের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা হওয়া টাকার পরিমাণ প্রশ্নবোধক বটে। এছাড়াও কিছু দুর্নীতির লিখিত অভিযোগ রয়েছে। সবকিছু দেখে আমি এসি (ল্যান্ড)কে আটকের বিষয়ে আর কোনো বাঁধা দিলাম না। দুর্নীতির পক্ষে তো আর দাঁড়ানো সম্ভব না। কর্নেল মনির চা খেয়ে বিদায় নিলেন। আমার কর্মকর্তার এ অবস্থা আমার মনকে বিষিয়ে দিল। ভেতরের মন বলে উঠল- তাহলে আমার এতদিন ধরে বিতরণকৃত সুবচন কি কোনো কাজেই লাগল না?। পরক্ষণে নিজের মনে প্রবোধ নিলাম- যে যতটুকু পানিতে নামবে, সে ততটুকু ভিজবে। রাতে বিভাগীয় কমিশনারকে টেলিফোনে বিষয়টি জানালে তিনি সব শুনে বললেন, সেনাবাহিনীর কোনো কাজে অযথা হস্তক্ষেপ করো না।
পরের দিন সকাল ৯টায় বিকেজিসি সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগদান করি। ক্রীড়া প্রতিযোগিতা উদ্বোধন করে সেখান থেকে বানিয়াচং উপজেলায় যাই। সেখানে শিক্ষাভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে সাড়ে ১২টায় নিজ অফিসে ফিরে আসি। তখন এডিএম মোহাম্মদ জাকীর হোসেন আমার কাছে এসে বলেন, স্যার আপনার অপেক্ষায় ছিলাম। মাধবপুরের এসি(ল্যান্ড)কে সেনাবাহিনী গ্রেফতার করে সেনা ক্যাম্পে এনেছে। আপনি জানেন কি-না।
আমি বললাম, জানি। হাজতে পাঠানোর ব্যবস্থা নাও।
এডিএম কিছুক্ষণ নির্বাক থেকে কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারলেন না। আমার মানসিক অবস্থা অনুধাবন করে ‘স্যার, স্যার’ বলে চলে গেলেন। বিকেলের দিকে হবিগঞ্জের দুর্নীতি কমিশনের এফআইআর দায়েরের মাধ্যমে এসি(ল্যান্ড)কে গ্রেফতার দেখিয়ে কোর্ট থেকে জেল হাজতে প্রেরণ করা হয়। আর আমি সার্বিক বিষয় জানিয়ে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ে একটি রিপোর্ট প্রদান করি। রাতে এনটিভিসহ কয়েকটি চ্যানেলে এই গ্রেফতারের সংবাদ প্রচার করা হয়।
সন্ধ্যা ৭টায় নজরুল একাডেমির উদ্যোগে আয়োজিত আলোচনা সভা ও ভাষাসৈনিকদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগদান করি। এ অনুষ্ঠানে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী হবিগঞ্জের দুই ভাষাসৈনিক অ্যাডভোকেট চৌধুরী আবদুল হাই ও অ্যাডভোকেট সৈয়দ আফরোজ বখতকে সংবর্ধনা ও পদক প্রদান করা হয়। কবি জলিল উদ্দিন বর্ষীয়ান এই দুই ভাষাসৈনিকের জীবনী অনুষ্ঠানে পড়ে শোনান। এছাড়া হবিগঞ্জে ভাষা আন্দোলনের ওপর গ্রন্থ লেখক তরফদার ইসমাইল হোসেনকে বিশেষ সম্মাননা পদক প্রদান করা হয়।
১৯ ফেব্রুয়ারি ২০০৭, সোমবার। সকাল ৯টায় অফিসে যাই। এসি ল্যান্ডের গ্রেফতার হওয়ার কারণে আমার অফিসের অফিসারদের চেহারায় কেমন যেন একটা মলিনভাব বিরাজমান। আমি এনডিসির মাধ্যমে সকল অফিসারকে আমার অফিসকক্ষে ডেকে আনলাম। তাদের আজকে আবারও বলা যায় কিছুটা হেদায়েত করে মনোবল শক্ত রাখার কথা বললাম। যার যার ভালোমন্দ বুঝে তাদের চলার মেসেজ দিই। এরপর চা-নাশতায় আপ্যায়ন করে অফিসের সংক্ষিপ্ত সভা শেষ করি।
সকাল দশটায় সরকারি কর্মচারী ও তাদের সন্তানদের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা বিষয়ক সভা করি। এরপর হবিগঞ্জ সদর উপজেলা পরিষদ কার্যালয়ের মিলনায়তনে আয়োজিত ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের বেসিক কোর্সের উদ্বোধন করে সেখানে ক্লাস নিই। সেখান থেকে বাহুবল উপজেলা পরিষদ কার্যালয়ে যাই। সেখানে সাড়ে ১২টায় উপজেলা প্রশাসনের পৃষ্ঠপোষকতায় আয়োজিত ৪ দিনব্যাপী অমর একুশে বইমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগদান করি। ইউএনও মনিরুজ্জামানের সভাপতিত্বে এ উপলক্ষ্যে আয়োজিত আলোচনা সভা শেষে ফিতা কেটে বইমেলার উদ্বোধন করি এবং মেলার স্টলসমূহ ঘুরে দেখি। একটি উপজেলায় এত গোছানো ও জাকজমকপূর্ণ বইমেলা হতে পারে তা আমার জানা ছিল না। বাহুবল থেকে বিকেল সাড়ে তিনটায় নিজ অফিসে ফিরে আসি।