পাঠকের কলাম——
অ্যাডভোকেট মুহাম্মদ মখলিছুর রহমান
‘মরার আগে মর’। জ্ঞানী-গুণী, মণীষীদের গবেষণালব্ধ এই আধ্যাত্মিক বাণীটি সর্বক্ষণ স্মরণ রাখা আমাদের অবশ্য কর্তব্য বটে। কারণ, মরণের আগে এই জীবদ্দশায় প্রেম-ভালোবাসা, মানবতা, মনুষ্যত্ববোধ, মান-অভিমান, ঝগড়া-বিবাদ, ভালো-মন্দ, যা কিছু করবে ওসব কিছুই মরণের পরে তোমার ফেলে আসা জীবনের স্মৃতির মানসপটে অম্লান হয়ে থাকবে। মৃত্যুর সমার্থক কয়েকটি প্রতিশব্দ যেমন, মরণ, মহাপ্রয়াণ, শেষ নিঃশ্বাস, সলিল সমাধি, প্রয়াত, পটলতুলা, ছকরাতুলমউত, শেষ বিদায়, চীরবিদায়, ইন্তেকাল, পরলোকগমণ ইত্যাদি। মৃত্যুকে আদর-আহ্লাদ করে যে নামেই ডাকা হোক না কেন মৃত্যু কিন্তু তোমার পিছু ছাড়বেই না। মৃত্যুকে তার স্বরুপ কিংবা গতিপথ পরিবর্তনে কিছু চেষ্টা-তদবির করা যেতে পারে মাত্র। যেমন ‘রাস্তায় পড়ে ধরবে যদি তারে চলো মুর্শিদের বাজারে’। এই বাজার বলতে লন্ডনের স্বর্ণের বাজার কিংবা বাংলাদেশের মুদ্রার বাজার বুঝায় না। এই বাজার বলতে আধ্যাত্মিক সাধনার অলৌকিক অদৃশ্য মারিফতির বাজার বুঝায়।
যাই হউক মরণের পর-পরই কী একজন মানুষ জানতে পারবে কী উপলব্ধি করতে পারবে যে, সত্যি-সত্যিই তার মৃত্যু হয়েছে? হঠাৎ করে যে কোনো মুহূর্তে মৃত্যুর পরোয়ানা আপনার হাতে এসে পৌঁছতে পারে। কাজেই সর্বক্ষণ প্রস্তুতি নিয়ে থাকতে হবে মৃত্যুকে স্বাগতম বা আলিঙ্গন জানানোর জন্য। দার্শনিকদের অভিমত, ‘প্রয়োজনে যে মরতে পারে বাঁচার অধিকার একমাত্র তাহারই’। জীবন মৃত্যুর প্রহেলিকাময় সন্ধিক্ষণে আমরা সবাই অপেক্ষমান ভয়ার্ত চিত্তে যেন মরিচিকার আলো-আঁধারের আবেশে।
ভোগ-বিলাসিতার মধ্যে, রাজকীয় রাজপ্রাসাদের মধ্যে কোনো সুখ নেই, কোনো আরাম-আয়েশ নেই, ত্যাগ-তিতীক্ষার মধ্যেই প্রকৃত সুখ ও প্রকৃত শান্তি নিহিত। আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব এবং ভূখা-নাঙ্গাকে অর্থ ও বুদ্ধি দিয়ে যতোবেশী ভালোবাসবেন, যতোবেশী সাহায্য-সহযোগিতা করবেন আপনার অন্তর, আপনার হৃদয়মন ততোবেশী প্রশান্তিময় হয়ে উঠবে। নিজেকে উজার করে মানুষকে ভালোবাসতে পারলে একদিকে যেমন আপনার জীবন স্বার্থক হবে তেমনই অন্যদিকে মরণের পরেও পৃথিবীতে যুগের পর যুগ, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে একজন পরীক্ষিত ভালো মানুষ হিসাবে অমরত্ব লাভে আপনি সমর্থ হবেন। কোটি-কোটি টাকার বস্তা, প্রাচুর্য্যপূর্ণ স্বর্ণালংকার, সুরম্য অট্টালিকা পৃথিবীতে ওসব রেখে যাওয়ার মাঝে কোনো আত্মতৃপ্তি বা স্বার্থকতা নেই। স্বার্থকতা আছে শুধু দানশীলতার মাঝে, ত্যাগ-তিতীক্ষার মাঝে।
মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, মগজ খাটিয়ে, রাত-দিন পরিশ্রম করে অর্জিত টাকা-পয়সা, খাদ্য-শস্য ইত্যাদি দিয়ে হতদরিদ্র মাতৃ-পিতৃহারা অনাথ শিশুকে, সহায় সম্বলহীন বৃদ্ধাশ্রমে, আশ্রায়ণে শয্যাশায়ী অশীতিপর বৃদ্ধা মা- জননীকে সাহায্য করতে পারলে নিশ্চিতভাবে স্বার্থক জীবনের, আলোকিত জীবনের সন্ধান পাওয়া যাবে। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, ফেঞ্চুগঞ্জ হতে ঢাকা যাওয়ার পথে পারাবত এক্সপ্রেসে ১৫ বৎসর বয়সী কিশোর এক ছেলে ৯৫ বৎসর বয়সী স্ট্যান্ডিং টিকেটধারী একজন বৃদ্ধকে দেখে নিজের সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়াল এবং বর্ষীয়ান মুরুব্বীকে সেই সিটে বসিয়ে দিল। কিশোর ছেলের এই অসামান্য সেক্রিফাইজ, শ্রদ্ধা ও ত্যাগটুকু উদাহরণ হয়ে থাকবে জনম-জনম ভরে এই অবাক পৃথিবীর নিষ্ঠুর উদ্যানে।
কলেরা, বসন্ত, যক্ষ্মা, ক্যান্সার ও করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের সেবা-শ্বশ্রুষা দূরে থাক সংস্পর্শেও সহসা কেউ যেতে চায় না মরণের ভয়ে। কিন্তু না; যেতে হবে বীরদর্পে তাঁদের মৃত্যুশয্যা পাশে এবং যেতে হবে তোমাকেই। ‘মরণের আগেই হউক না মরণ’ মৃত্যু ভয়কে উপেক্ষা করে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অন্যকে সাহায্য করার মধ্য দিয়েই, ভালোবাসার মধ্য দিয়েই স্বার্থক জীবনের, সুন্দর জীবনের আলোকবর্তিকার পরম আস্বাদ পাওয়া যাবে। রাজধানীর গলিপথে, রাজপথে, পথে-প্রান্তরে সড়ক-দুর্ঘটনায় আহত রক্তমাখা দেহ, রক্তেরঞ্জিত সারাশরীর ভয়ার্ত নীরব দর্শক শতাধিক কিন্তু প্রাণের ভয়ে কেউ এগিয়ে আসছে না। কিন্তু তুমি অবশ্যই এগিয়ে যাবে মরণাপন্ন মানুষটিকে রিক্সাযোগে পৌছে দিবে হাসপাতালে স্বদেশ মাতৃকার দুঃসাহসী সন্তান হিসেবে, স্বদেশ মাতৃকার বীরোত্তম প্রজন্ম হিসেবে।
২৫০ শয্যা বিশিষ্ট বিশাল বড় আধুনিক হাসপাতালের বারান্দায়, করিডোরে পড়ে রক্তশূণ্যতায়, রোগ-যন্ত্রণায় ছটপট করছে, কাতরাচ্ছে তোমারই এক অচেনা কিশোরী বোন। পাষাণ প্রাণের টাকার লোভী ডাক্তাররা চিকিৎসা না করে বরং এড়িয়ে যাচ্ছেন। একমাত্র তুমিই পারবে তোমার নিজের শরীরের রক্ত দিয়ে মেয়েটাকে বাঁচাতে কারণ মৃত্যুকে যে ভয় করে না এদেশের সেই তুমিই এক গর্বিত, কৃতি সন্তান। নিজের রক্ত দিয়ে, নিজের শক্তি দিয়ে যে মানুষকে ভালোবাসে তার কোনো দিন মরণ হয় না। মরণের পরেও সে অমর হয়ে থাকে এই ধরাধামে, এই ধরিত্রী নগরে। ‘মানুষ মরণশীল’ এই শাশ্বত সত্যটিকে মনে প্রাণে স্বীকার করে নিয়ে ঘুষ-দুর্নীতি, প্রতারণা, জ্বালিয়াতি ইত্যাদি পরিহার করে আপাদমস্তক শুদ্ধ হতে হবে তবেই প্রশান্ত মহাসাগরের মতো প্রশান্তিময় হয়ে উঠবে তোমার জীবন, তোমার মরণ।
লেখক-আইনজীবী ও কলামিস্ট, মোবাঃ ০১৬৮৬-৭৩৫৮০৪
© স্বত্ব দৈনিক হবিগঞ্জের মুখ ২০১৯
ওয়েবসাইটটি তৈরী করেছে ThemesBazar.Com