আমাদের ইঞ্জিনচালিত বড় সাইজের বজরা নৌকা পানি ভেঙে ভটভট শব্দে এগিয়ে চলে

আতাউর রহমান কানন

১ জানুয়ারি ২০০৭, সোমবার। শুভ নববর্ষ ও পবিত্র ঈদুল আজহার শুভেচ্ছা। কুঁয়াশার চাদরে ঢাকা হাঁড়কাঁপানো শীতের সকাল। দশ ফুট দূরের মানুষকেও চেনা যায় না। সে কুঁয়াশার চাদর ভেদ করেই ছেলেকে সঙ্গী করে হবিগঞ্জ কেন্দ্রীয় ঈদগাহে গিয়ে গাড়ি থেকে নামলাম। সকাল আটটার জামাত আধঘণ্টা পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমি প্রথানুযায়ী উপস্থিত মুসল্লিদের উদ্দেশে পবিত্র ঈদের শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখি। নামাজ শেষে আবার কুঁয়াশার চাদর কেটেই বাসায় ফিরে কোরবানি করি। দুপুরের দিকে সূর্যের হাসিমাখা মুখের দেখা মেলে। শীতের তীব্রতা কমে। সারা দিন বাসাতেই কাটাই। তবে দুপুরের দিকে একফাঁকে জেলা কারাগারে প্রবেশ করে বন্দিদের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করি এবং তাদের জন্য আয়োজিত খাবার দর্শন করি।
রাতে আমার বাসায় আমন্ত্রিত সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা ও শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের আপ্যায়ন করি। ঈদ উপলক্ষ্যে ঢাকা থেকে আমার স্ত্রী-কন্যা-পুত্র দুদিন আগেই আমার কর্মস্থলে আসে। তাদের নিয়ে আমার দিনটি বেশ আনন্দেই কাটে।
২ জানুয়ারি ২০০৭, মঙ্গলবার। সকাল সাড়ে ১১টায় লাখাইয়ের উদ্দেশে নৌপথে পুলিশ সুপার, সেনা ইউনিটের সিও ও আমি সপরিবারে রওনা করি। আমাদের তিন পরিবারের জন্য নৌভ্রমণ ও লাখাইয়ের স্বজনগ্রামের হাওড় এলাকার নির্জন হিজলবনে পিকনিকের আয়োজন করেন পুলিশ সুপার আবদুল মান্নান। আজ আকাশে ঝলমলে রোদ থাকায় শীতের তেমন তীব্রতা ছিল না। আমাদের ইঞ্জিনচালিত বড় সাইজের বজরা নৌকা পানি ভেঙে ভটভট শব্দে এগিয়ে চলে। আমরা বজরার ছাদে ও খোলা জায়গায় বসে যার যার মতো শীতের মিঠে রোদ গায়ে মাখিয়ে চানাচুর-বাদাম-চিপস্ চিবোতে চিবোতে গল্পগুজব আর চারদিকের গ্রামীণ সৌন্দর্য অবলোকন করতে থাকি। শীতের এসময় হাওড় আর হাওড় নেই। পানি নিচে চলে গেছে। এখন চারদিকে শুধু সদ্য রোপিত সবুজাভ ধানের খেত। এর মাঝেই স্থানে স্থানে বিল-জলাভূমি; সেখানে জেলেরা মাছধরায় ব্যস্ত। আর নানা জাতের দেশি ও পরিযায়ী পাখিদের মৎস্যশিকার ও ওড়াউড়ি চমৎকার মনোহারি এক পরিবেশ! মুহূর্তে যে কাউকে নিয়ে যায় কল্পনার রাজ্যে। আমরা এসব উপভোগ করতে করতে স্বজনগ্রামের হিজলবনে গিয়ে নামতে নামতে সূর্য হেলে ২টা বেজে যায়। সেখানে আগে থেকেই লাখাই থানার ওসি সব ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। আমরা বনের ভেতর কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে বনের শোভা উপভোগ করি। ছোট্ট দ্বীপের এ বন তেমন আহামরি না হলেও দেখার মতো চোখ দিয়ে দেখলে কমই বা কীসে? সেখানে আমরা নানাভাবে ছবি তুললাম। এরপর পিকনিকের খাওয়াদাওয়া শেষে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে বজরায় গিয়ে ওঠলাম।
এবার আমাদের ফেরার পালা। যে পথে আসা সেপথেই ফেরা। বজরা এগিয়ে চলে। সূর্য নিচে নেমে তেজ হারিয়ে ডিমের কুসুমের মতো দেখাচ্ছে। চারধার কেমন যেন জনমানব শূন্য বিরান বিরান লাগছে। নীড়েফেরা পাখিরা অনেকেই দলবেঁধে নীড়ের দিকে ধাবমান। তাদের দলবলের শৃঙ্খলাও দেখার মতো! সুর্যটা এক সময় পশ্চিমাকাশে নিজের পাটে বসে হারিয়ে যায়। পক্ষান্তরে প্রায় মাথার ওপরে শুক্লপক্ষের একাদশির চাঁদ মুক্তোঝরা দাঁতে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। সে এক অপূর্ব নৈসর্গিকতা! নয়নজুড়ানো এমন পরিবেশ মনেপ্রাণে উদাসী ঢেউ খেলে যায়।
সারাদিনের আনন্দভ্রমণ শেষে ফুরফুরে মন নিয়ে সূর্যডোবার প্রায় দুঘণ্টা পর বাসায় ফিরে আসি। আজ সারাদিনে দেশের কোনোপ্রকার সংবাদই মনের ভেতর উদয় হয়নি। রাতের টিভি সংবাদে দেখলাম, আজ রাজধানীর সাংবাদিকগণ ঈদের আমেজ কাটতে না কাটতেই রাজনৈতিক জোট-মহাজোটের পেছনে ছোটাছুটি করে শীতের দিনেও রীতিমত গলদগর্ম। চ্যানেলগুলো একটু পরপর নানারকম সংবাদ আপডেট দিয়ে যাচ্ছে। ঘুমাতে যাওয়ার আগেও রাতের সংবাদ-আপডেটে জানলাম, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট নিজেদের ভেতর সভার পর সভা করে যাচ্ছে- তারা আগামী ২২ জানুয়ারির নির্বাচনে যাবে কি যাবে না। আমি আমার সারাদিনের আনন্দভ্রমণের অনুভূতিকে আজ আর মাটি হতে না দিয়ে টিভি বন্ধ করে ঘুমের রাজ্যে চলে গেলাম।
৩ জানুয়ারি ২০০৭, বুধবার। ঈদের ছুটির পর আজ প্রথম অফিস। আমি সকাল ৯টায় যথরীতি অফিসে যাই। কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ আমার সাথে ঈদ-উত্তর শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। আমার অফিসের কর্মকর্তারা যারা ছুটিতে গিয়েছিলেন, তারাও সব ফিরে এসেছেন। তবে সেবা প্রত্যাশী লোকজনের তেমন একটা ভিড় নেই। নির্বাচনের আর মাত্র ১৯ দিন বাকি। রিটার্নিং অফিসার হিসেবে আমার কাজ আমাকে করে যেতে হচ্ছে। তবে নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে এখনও ধোঁয়াশা না কাটায় মনের ভেতর একটা অস্বস্তির কাঁটা মাঝেমাঝেই খুঁচিয়ে যাচ্ছে।
আজ এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে মহাজোটের পক্ষে শেখ হাসিনা নির্বাচন বয়কট ও প্রতিরোধের ঘোষণা দিয়ে বলেন- বর্তমান প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার মূলত বিএনপি-জামাতের ছায়া সরকার হিসেবে কাজ করছে। এদের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন করা সম্ভব না। মহাজোটের দাবি অনুযায়ী এখনও ভোটার লিস্ট ত্রুটিমুক্ত করা হয়নি এবং পুরো প্রশাসন এখনও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবান্বিত। নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে মহাজোটের দেওয়া পূর্বের দাবিসমূহ পূরণ করে নতুন নির্বাচনি তফসিল ঘোষণার জন্য দাবি জানান।
মহাজোটের দাবির প্রতিক্রিয়ায় ৪দলীয় জোটের পক্ষে বিএনপির মহাসচিব আব্দুল মান্নান ভূঁইয়া হাওয়া ভবনে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন যে, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে নির্ধারিত ৯০ দিনের ভেতরেই নির্বাচন হতে হবে। এছাড়া ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি মাহফুজুর রহমানও ঘোষিত তফসিল অনুযায়ীই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে জানান।
ফলশ্রুতিতে, ৩৯৩৫ নির্বাচনি প্রার্থীর মধ্যে ১৪দলীয় মহাজোটের ২৩৭০ প্রার্থী তাঁদের নমিনেশনপত্র প্রত্যাহার করে নেন। এতে উপদেষ্টাদের মধ্যে অস্থিরতা বেড়ে যায়; তাঁরা সমস্যা সমাধানের জন্য দৌড়ঝাঁপ করতে থাকেন। তাঁদের অনেকেই মিডিয়ার কাছে অসহায়ত্ব প্রকাশ করে আশা ব্যক্ত করেন যে, মহাজোট নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে, তবে তাঁদের কাছে মহাজোটকে নির্বাচনে ফেরানোর কোনো কৌশল জানা নেই বলেও একরকম হতাশা প্রকাশ করেন। উপদেষ্টাগণ শেষ চেষ্টা হিসেবে মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বঙ্গভবনে গিয়ে এ বিষয়ে আলোচনার প্রচেষ্টা নিয়েও ব্যর্থ হন।
আজ রাতে আমার নিজের মধ্যেও কেমন যেন একটা অস্থিরতা দেখা দেয়। এতদিনের নির্বাচনি কাজকর্ম সবই কি শেষ পর্যন্ত ভেস্তে যাবে? আমি অনেকক্ষণ নিজের সাথেই নিজে বিতর্ক করি। রাত গভীর হয়। আমার ঘুম আসে না। আমি গতকালের আনন্দভ্রমণের অনুভূতি অনুভবের প্রচেষ্টা চালাই। শেষমেশ নিজের ভেতরে একটা বুঝ আসে যে, আমি তো প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী বৈ কিছু না- এসব ভাবনা তো আমার সাজে না। তবে ঝড় ওঠলে ঝড়ও থামে। দেশের ঝড়ও একসময় থেমে স্বাভাবিক হবে। আমি একরকম বুঝ নিয়ে ঘুমাতে গেলাম। (চলবে…)