আমি হবিগঞ্জে আসার পর এক মাসে তিনজন এসপি পেলাম
আতাউর রহমান কানন
২০ নভেম্বর ২০০৬, সোমবার। আজ তৃতীয়বারের মতো ১৪দলীয় জোটের অনির্দিষ্টকালের জন্য অবরোধ চলছে। নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন বিষয়ে কোনো উদ্যোগই কোনো আশা জাগাতে পারছে না। বিচারপতি এম এ আজিজ স্বেচ্ছায় পদত্যাগে অনড়। তিনি মনে হয় কোনো অদৃশ্য শক্তির ইঙ্গিতে জগদ্দল পাথর হয়ে বসে আছেন। আর দেশের আন্দোলন যেদিকে যাচ্ছে তাতে তাঁর পদত্যাগ ছাড়া কোনো সুরাহাও আপাতত দেখা যাচ্ছে না।
প্রধান উপদেষ্টা তাঁর উপদেষ্টাদের মধ্য থেকে মাহবুবুল আলম, এম আজিজুল হক ও সুলতানা কামালকে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের নিকট পাঠান। সারাদিন গলদগর্ম সভা করে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের বিষয়ে উপদেষ্টা মাহবুবুল আলম প্রেস মিডিয়াকে জানান যে, ‘দিয়ার ইজ অ্যা লাইট অ্যাট দ্য এন্ড অব টানেল’। কিন্তু এরপর আর সে আলো টানেলের বাইরের জগতে বিকশিত হয়নি। ১৪দলীয় জোট তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সক্ষমতা এবং নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। উপদেষ্টাদের মধ্যেও সমন্বয়হীতার অভাব পরিলক্ষিত হয়।
২১ নভেম্বর ২০০৬, মঙ্গলবার। সকাল ৯টায় অফিসে গিয়ে বসতেই হবিগঞ্জে নবযোগদানকৃত এসপি আবদুল মান্নান ফোন করে সালাম বিনিময়ের পর জানান যে, তিনি গতরাতে এসেছেন। আমার সাথে সাক্ষাতের জন্য আসতে চান। আমি তাঁকে ওয়েলকাম জানালাম। পনেরো মিনিটের মধ্যে তিনি এলেন। আমাদের মধ্যে সৌজন্যমূলক আলাপ থেকে হবিগঞ্জের আইনশৃঙ্খলা বিষয় নিয়ে আলোচনা হলো। এসপি সাহেবকে বেশ ভদ্র ও চটপটে মনে হলো। তিনি জেলা প্রশাসনকে সর্বপ্রকার সহায়তা করবেন বলে জানিয়ে চলে গেলেন। আমি হবিগঞ্জে আসার পর এই একমাসে তিনজন এসপি পেলাম। এই এসপি মান্নানের আগে এসপি ছিলেন মীর শহীদুল ইসলাম। তিনি চেয়ারে বসতে না বসতেই ২০ দিনের মাথায় তাঁকে কুমিল্লায় বদলি করা হয়।
ডিসি-এসপিকে কেন্দ্রীয় সরকারের গতিবিধি ও আদেশ-নির্দেশ অনুসরণ করে চোখ-কান খাড়া রেখে জেলা প্রশাসন চালাতে হয়। দেশের এই অস্থির অবস্থায় আমরাও অস্থির আছি। প্রশাসনের স্বাভাবিক কাজকর্মের পদেপদে ছন্দপতন ঘটছে। আশা করছি, রাজনৈতিক এই ঝড় সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়ের মতো একসময় থেমে সব স্বাভাবিক হবে।
আজ রাতের সংবাদে দেখা গেল, বিএনপির মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়া রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে মাঠ প্রশাসনের সরকারি কর্মকর্তাদের বদলির বিষয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। এছাড়া সংবিধানের বিরুদ্ধে গিয়ে কোনো কাজ না করার অনুরোধ জানান।
২২ নভেম্বর ২০০৬, বুধবার। সকালে অফিস হয়ে ১০টায় চুনারুঘাট উপজেলায় যাই। সেখানে পূর্বনির্ধারিত ইউএনও অফিস, এসি (ল্যান্ড) অফিস পরিদর্শন করে দুপুর সাড়ে ১২টায় নিজ অফিসে ফিরে আসি। অফিসে কয়েকজন ভিজিটর ছিলেন। তাঁদের সাক্ষাৎ দিয়ে তাঁদের সমস্যা শুনি। অফিসের কাজকর্ম শেষে বিকেল ৫টায় বাসভবনে ফিরে আসি। রাতে টেনিস মাঠে গিয়ে এসপির কাছে শুনলাম, টানেলের বাইরে আলোক রশ্মি দেখা দিয়েছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার জানিয়েছেন, তিনি দেশের রাজনৈতিক অচলাবস্থা অবসানের জন্য তিন মাসের ছুটিতে যেতে রাজি আছেন; তবে এ সময় তিনি দেশেই অবস্থান করবেন এবং প্রশাসনকে তাঁর নিরাপত্তার যাবতীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
২৩ নভেম্বর ২০০৬, বৃহস্পতিবার। সকালে পত্রিকার পাতা উল্টাতেই দেখা গেল প্রধান নির্বাচন কমিশনারের ছুটিতে যাওয়ার বিষয়টি পত্রিকায় প্রাধান্য পেয়েছে। আমি বুঝতে পারলাম দেশের রাজনৈতিক হতাশার বরফ গলতে হয়তো আর বেশি সময় নেই। সারাদিন অফিসে এসব নিয়েই আলোচনা চলে। আমি অফিস শেষে বাসায় এসে টিভি নিউজে দেখলাম, নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি মাহফুজুর রহমান নির্বাচন কমিশনের সভা ডেকে নিজেকে অথোরাইজড প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালনের ঘোষণা দিয়েছে। অপরদিকে নানারকম সমালোচনা ও হতাশাজনিত কারণে ৫ জন উপদেষ্টা- ড. আলি আকবর খান, মাহবুবুল আলম, সিএম শফি সামি, লে. জেনারেল হাসান মশহুদ চৌধুরী (অব.) ও সুলতানা কামাল অফিস করা থেকে বিরত রয়েছেন।
পক্ষান্তরে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা আপাতত জনগণের একটি বিজয় হয়েছে জানিয়ে অবরোধ স্থগিত করেন। তবে ২৭ ও ২৮ নভেম্বর বঙ্গভবন ও নির্বাচন কমিশনের সামনে ১১ দফা দাবি পূর্ণ বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা অবস্থান ধর্মঘট চালিয়ে যাবেন।
২৪ নভেম্বর ২০০৬, শুক্রবার। রাতের সংবাদে জানা যায়, এদিন সন্ধ্যা রাতে বিএনপি সরকারের সাবেক জ্বালানী উপদেষ্টা মাহমুদুর রহমানের উত্তরার অফিসে সাবেক ও বর্তমান ৪০ জন সিভিল সার্ভেন্ট এক গোপন সভায় মিলিত হন। মিডিয়া-চ্যানেলের লোকজন সেখানে গেলে পড়িমড়ি করে অনেকেই বেরিয়ে যাওয়ার সময় ক্যামেরায় ধরা পড়েন। বিষয়টি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রশাসনকে সমালোচনার মুখে ফেলে।
পরের দিন শনিবার। সকালে আমার অফিসের এডিসিগণ আমার বাসভবনের অফিসে আসেন। তাঁরা কথায় কথায় গতকালের উত্তরা কেলেঙ্কারীর কথা তুলেন। নির্বাচনের এই ক্রান্তিকালে এমন ঘটনা ১৪দলীয় মহাজোটের অগ্নিগর্ভ আন্দোলনে আরও ঘি ঢেলে দিবে বলে মন্তব্যও করা হয়।
কিছুক্ষণ পরে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের এক কর্মকর্তা টেলিফোনে জানান যে, নির্বাচনি সামগ্রী মাঠ পর্যায়ে পাঠানো শুরু হয়েছে। ভারপ্রাপ্ত সিইসি (প্রধান নির্বাচন কর্মকর্তা) জানিয়েছেন, শিগগিরই নির্বাচনি তফসিল ঘোষণা করা হবে।
টেলিফোন ছাড়ার পরপরই আমি জেলা নির্বাচন কর্মকর্তাকে টেলিফোন করে বিষয়টি জানিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিলাম।
২৬ নভেম্বর ২০০৬, রবিবার। সকালে অফিসে গিয়ে এডিসিগণ ও জেলা নির্বাচন কর্মকর্তাকে নিয়ে বসে নির্বাচনি কাজকর্মের প্রস্তুতি পর্যালোচনা করলাম। বিকেলে টিভি নিউজে দেখলাম, মহামান্য রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পদ গ্রহণ করায় তার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্ট ডিভিশনে তিনটি রিট পিটিশন দায়ের হয়েছে। এ ছাড়া রাজনীতির খেলায় টানাপোড়েনে থাকা জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ তাঁর পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য জিএম কাদেরকে পার্টি থেকে বহিষ্কার করেছেন। চলবে…