হবিগঞ্জ শহর থেকে অপহৃত শিশু অর্ঘকে আজ পাওয়া যায়নি
‘আশরাফ জাহান কমপ্লেক্স’ শহরের প্রথম বহুতল আধুনিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ॥ হাওড়বেষ্টিত জনপদ আজমিরীগঞ্জকে বলা হয় ভাটি এলাকার রাজধানী
আতাউর রহমান কানন
১৮ অক্টোবর ২০০৬, বুধবার। সকাল ৯টায় অফিসে যাই। এরপর জেলা পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেসি, জেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটি, জেলা মাদক বিরোধী কমিটির সভা-সহ পরপর ৬টি নির্ধারিত মাসিক সভায় সভাপতিত্ব করি। এবারই আমার এ জেলায় যোগদানের পর এসব কমিটির প্রথম সভা। সভায় অনেক বিষয়ই আলোচনা হয়। আমার অনেক কিছুই জানার পাশাপাশি জেলার অনেকের সাথেই পরিচয় ঘটল। বেশ কিছুদিন আগে এ শহরের ‘অর্ঘ’ নামীয় এক শিশু অপহরণের পর যে এখনও তাকে পুলিশ উদ্ধার করতে পারেনি, সে বিষয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি মো. আবু জাহির জোরালো বক্তব্য রাখেন। আর জেলায় মাদক আসক্তির ভয়াবহ বিস্তারেরও একটি চিত্র পেলাম।
সভা ও অফিসের কাজকর্ম সেরে বিকেল ৪টায় বাসায় আসি। বাসায় ইফতার শেষে রাত ৮টায় জেলা উকিল বার কর্তৃক আয়োজিত বদলিকৃত জেলা জজ আজিজুল ইসলামের ফেয়ারওয়েল অনুষ্ঠানে যোগদান করি। সেখানে থেকে ডিনার শেষে রাত ১০টায় বাসায় ফিরি।
২০ অক্টোবর ২০০৬, শুক্রবার। আজ পবিত্র রমজান মাসের শেষ শুক্রবার বা ‘জুমাতুল আলবিদা’। রমজানের এ পর্যায়ে মনে হয় রোজাও বিদায় নিচ্ছে। মুসলিম জাতি পবিত্র ঈদুলফিতর উদযাপনের জন্য প্রস্তুত হন। এ উপলক্ষ্যে আমার সাথে ঈদ উদযাপনের জন্য আমার সহধর্মিণী পুত্র-কন্যা নিয়ে দুপুর ১২টায় ঢাকা থেকে হবিগঞ্জ আসে। আমার বাইরে আজ তেমন প্রোগ্রাম না থাকায় জুমার পর বাসাতেই অবস্থান করি।
সন্ধ্যার পর বাসভবনের অফিসে বসে কাজ করছিলাম। এমন সময় হবিগঞ্জ শহরের বিশিষ্ট ভদ্রলোক ও অন্যতম ধনাঢ্য ব্যক্তি মো. আশরাফ উদ্দিন আমার সাথে সাক্ষাতে আসেন। তিনি ‘আশরাফ লন্ডনী’ নামে এককথায় এলাকায় সুপরিচিত। শহরের প্রাণকেন্দ্রে ‘আশরাফ জাহান কমপ্লেক্স’ নামক প্রথম বহুতল আধুনিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের তিনি মালিক। এই ভবনে ‘সোনার তরী’ নামক আধুনিক সুবিধাদিসহ একটি আবাসিক হোটেলও রয়েছে। তিনি ইংল্যান্ড প্রবাসী। সে দেশের বার্মিংহামে তাঁর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বাংলাদেশ ও ইংল্যান্ডে তাঁর ঘনঘন আসা-যাওয়া আছে। প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গেই তিনি সুপরিচিত। আমার জানামতে, কর্মকর্তাদের তিনি ইংল্যান্ডে পেলে বেশ সমাদর করেন। এক যুগ আগে এ জেলায় আমার চাকরিসূত্রে তাঁর সাথে প্রথম পরিচয় ঘটেছিল। তখন থেকেই তিনি অনেকের মতো আমারও সুহৃদ বনে যান। নিজের বয়সকে বলা যায় তিনি বিশেষ কোনো ক্ষমতায় ধরে রেখেছেন। তাঁকে একযুগ আগেও যেমন দেখেছি, আজও তিনি তেমনই আছেন। নিরহংকারী, সংস্কৃতিমনা ও সুদর্শন এই ব্যক্তি সব বয়সিদের সাথেই অবলীলায় মিশতে পারেন।
আমার এ জেলায় আগমনের আগে থেকেই তিনি ইংল্যান্ডে অবস্থান করছিলেন। দেশে এসেই আজ দেখা করতে এসেছেন। আমরা পুরানো দিনের স্মৃতি রোমন্থন থেকে বর্তমান অনেক বিষয় নিয়েই আলাপ করলাম। আমি হবিগঞ্জে ডিসি হিসেবে আসায় তিনি হ্যাপি বলে জানালেন, আর আমিও তাঁর মতো শুভাকাক্সক্ষী পেয়ে খুশি বলে জানালাম। কথায় কথায় রাত বাড়ে। একসময় তিনি বিদায় নিয়ে চলে যান।
২২ অক্টোবর ২০০৬, রবিবার। সকাল ১০টায় আজমিরীগঞ্জ উপজেলার উদ্দেশে রওনা করি। বানিয়াচং থানার ঘাট থেকে আমি ও আমার সফরসঙ্গী সবাই লাইফ জ্যাকেট পরে স্পিডবোটে উঠি। স্পিডবোটটি ভোঁ-ভোঁ চিৎকার তুলে চলতে থাকে। বর্ষা-শরৎকাল পেরিয়ে হেমন্ত শুরু হওয়ায় হাওড় এখন পড়ন্ত যৌবনা। পানি অনেকটাই নিচে নেমেছে। এই সময়টাতেই জেলেদের মাছ ধরার মোক্ষম মৌসুম। মাছধরার সুবিধার্থে হাওড়ের বিলসমূহে বাঁশের ঘের বা বেড়া দেওয়া। জেলেরা সঙ্গীসাথি নিয়ে মাছ শিকারে ব্যস্ত। মৃদু ঢেউখেলা শান্ত পানিতে দেশি-পরদেশি নানা আকার ও বর্ণের পাখিদের ডোবাডুবি-ওড়াউড়ি আর ভেসে বেড়ানোর দৃশ্যাবলি মুহূর্তে নয়ন ও মনকে উদাস করে ভিন্ জগতে নিয়ে যায়। আমাদের স্পিডবোটটি একটানা ভোঁ-ভোঁ চিৎকারে চলছিল কিন্তু সে শব্দ কখন যে কর্ণসহা হয়েছে টেরও পেলাম না। আমি মাছরাঙা পাখিদের সাথি হয়ে অনেকক্ষণ যেন মৎস্যশিকারে ব্যস্ত ছিলাম। চলতি পথে একসময় চোখে পড়ল- ভরা বর্ষায় ডুবে যাওয়া হিজল গাছেরা মলিন দেহে জেগে উঠেছে। সেসব গাছে পরিশ্রান্ত পাখিরা বিশ্রাম নিচ্ছে। হাওড়বাসীর অনেকে আবার জেগে ওঠা টিলাভূমিতে দেশি হাঁসের খামার করেছে। সেসব দেশি হাঁসেরা দল বেঁধে ঝাঁকেঝাঁকে হাওড়ের জলে ভেসে বেড়াচ্ছে।
আজমিরীগঞ্জ উপজেলার প্রায় পুরোটাই হাওড়। সেই হাওড়ের মধ্যেখানে এক চিলতে টিলা শ্রেণির ভূমিতে উপজেলা সদরদপ্তর ও বাজার। বর্ষায় এই উপজেলা সদর ও এর গ্রামগুলো বিচ্ছিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপের মতো দেখায়। এলাকার মানুষ মূলত মৎস্যজীবী। বোরো ধান তাদের প্রধান কৃষি ফসল।
আমাদের স্পিডবোটটি একসময় উপজেলার ঘাটে ভিড়ল। সেখানে থেকে ইউএনও এস.এম. আলম আমাকে রিসিভ করে তাঁর অফিসে নিয়ে যান। হালকা ফ্রেশ হয়ে ইউএনও’র সাথে সৌজন্য কথাবার্তা বলে জানলাম, তিনি এ উপজেলায় এক বছর ধরে কর্মরত কিন্তু ঢাকায় বসবাসকারী তাঁর পরিবারের সদস্যরা কেউ এখানে আসেন না। একরকম নির্বাসনের মতোই তিনি জীবন কাটান। তবে এমন নিরিবিলি জীবন তাঁর খারাপ না লাগলেও তিনি চলে যাওয়ার জন্য একপায়ে খাড়া।
হাওড়বেষ্টিত ভাটি বাংলার একটি জনপদ এই আজমিরীগঞ্জ। একে ভাটি এলাকার রাজধানীও বলা হয়ে থাকে। এর পশ্চিম পাশ ঘেঁষে বয়ে গেছে সুরমা-কুশিয়ারার মিলিত স্রোত কালনি-কুশিয়ারা-ভেড়ামোহনা। অধিকাংশ এলাকা বছরের অর্ধেক সময় জলমগ্ন থাকে। আজমিরীগঞ্জের উত্তরে সুনামগঞ্জ জেলার শাল্লা উপজেলা, পূর্বে ও দক্ষিণে বানিয়াচং উপজেলা এবং পশ্চিমে কিশোরগঞ্জ জেলার ইটনা উপজেলা। এর আশেপাশের সবগুলো উপজেলাই হাওড়ে অবস্থিত। ইউএনও সাহেব আমার জন্য তথ্যসমৃদ্ধ ‘একনজরে আজমিরীগঞ্জ’ প্রস্তুত করে একটি ফোল্ডারে দিয়েছেন। আমি তাতে নজর বুলিয়ে উপজেলা প্রশাসন কর্তৃক আয়োজিত আজকের মতবিনিময় সভায় গিয়ে যোগদান করলাম। ইউএনও এস.এম আলমের পরিচালনায় সভা আরম্ভ হলো। উপস্থিত সবার সাথে পরিচিত হয়ে তাঁদের বক্তব্য শুনতে লাগলাম। এলাকার আমন্ত্রিত গণ্যমান্য ব্যক্তিদের অধিকাংশই এলাকার নানাবিধ ইতিহাস-ঐতিহ্যের বর্ণনা ও সমস্যার কথা তুলে ধরেন। আর আমি সেসব শুনতে শুনতে ইউএনও’র প্রদত্ত ফোল্ডারের তথ্যাদিও দেখতে থাকি।
১৯০৭ সালে আসাম সরকারের অধীনে আজমিরীগঞ্জ থানায় পরিণত হয়। ১৯৮৩ সালে আজমিরীগঞ্জ থানাকে উপজেলায় রূপান্তর করা হয়। বর্তমানে পাঁচটি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত এই উপজেলার আয়তন ২২৩.৯৮ বর্গ কিলোমিটার, আর লোক সংখ্যা প্রায় ১ লাখ ১৫ হাজার। এই শহরটিতে কাঠামোগত দিক দিয়ে বেশ কয়েকটি দৃষ্টিনন্দন নির্মাণশৈলীর বাড়ি রয়েছে। ত্রিপুরার মহারাজার অর্থায়নে ১৮০০ সালের আগে এই বাড়িগুলো নির্মাণ করা হয়েছিল।
এই উপজেলার নামকরণ নিয়ে বেশ চমৎকার তথ্য রয়েছে। এক সময়ের ‘আযদাম’ বিবর্তনের ধারায় সর্বশেষে ‘আজমিরীগঞ্জ’ রূপ ধারণ করে। যেমন:- আযদাম>আজমার্দীন>আয়েজমাদাম>আবদাবাদ এবং পরিশেষে আজমিরীগঞ্জ। তবে এছাড়াও আজমিরীগঞ্জ নামকরণ নিয়ে রয়েছে ঐতিহাসিক কাহিনি।
(চলবে…)