বীর মুক্তিযোদ্ধা-সাংবাদিক-কালেক্টরেট স্টাফ এই তিন গ্রুপের চাপের মুখে আমি নমনীয় হলাম না
জালাল আহমেদ
এর আগে উল্লেখ করেছি যে নোয়াখালী জেলা দীর্ঘদিন ছিল ভাঙ্গন কবলিত। এজন্য স্টেশন হিসেবেও নোয়াখালী পছন্দের ছিল না। মিঃ এ জে ড্যাশ যখন ১০/১২/১৯১৮ তারিখে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে আসলেন তখনো জেলা সদর ছিল ভাঙ্গনের সম্মুখীন। নোয়াখালী পোস্টিং হয়ে তাঁর মন খারাপ। ১৯১৯/২০ সালে ঐ ভাঙ্গনের সময়েই খুলনাতে সাইক্লোন হয়। তাঁকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা করে খুলনাতে সাইক্লোন ডিউটিতে পাঠিয়ে দেয়া হলে তিনি ১৬/১০/১৯১৯ তারিখে খুলনা চলে যান। খুব খুশী তিনি, নোয়াখালীর ভাঙ্গন থেকেতো বাঁচা গেল। কিন্তু ৬ মাস খুলনায় দায়িত্ব পালনের পরও দেখা গেল যে তাঁর নোয়াখালী পোস্টিং বহাল। তখন তিনি হোম লিভ নিয়ে বিলাতে চলে যান। মাঝখানে বাবু হরেন্দ্র কুমার ঘোষ দুই মাস ও মিঃ রায় রমণী মোহন দাস বাহাদুর এক বছরেরও বেশি সময় জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এর দায়িত্ব পালন করেন।
মিঃ ড্যাশ যখন ০২/০২/১৯২০ তারিখে আবার ভারতে ফিরে আসলেন তখন তাঁকে নোয়াখালীতেই আসতে হল আরো ৭ মাসের জন্য। ইতোমধ্যে তাঁর পুরনো বাংলো নদীগর্ভে। সোনাপুরে হরিনারায়নপুরের জমিদারদের হুকুমদখল করা জমিতে নতুন বাংলো নির্মিত হয়েছে। তিনি এসে সেই নতুন বাংলোতে উঠলেন। এই সময়েই চৌমূহনীতে ৬০০ একর জমি জেলা সদরের জন্য হুকুম দখল করা হয়। চৌমুহনী বাজার এলাকা সেই হুকুমদখলকৃত জমির উপরেই। কিন্তু পরবর্তীতে ১৯৪৮/৪৯ সালে যখন জেলা সদর সরানোর প্রশ্ন আসলো তখন তা আর চৌমুহনীতে নেয়া সম্ভব হল না। তখন নতুন করে মাইজদী এলাকায় ৪০৩ একর জমি জেলা সদরের জন্য হুকুমদখল করা হয়। নোয়াখালী জেলা সদর সেই হুকুম দখলকৃত জমির উপর।
আমি যখন ১৯৭৫ সালে প্রথম নোয়াখালীতে যাই তখন দেখি যে প্রধান সড়কের দুই পাশে যত দোকানপাট সব টিনসেড ঘরে। এমন একটি জেলা সদর যেখানে পাকা দোকানপাট নাই। ভালো কিছু বাজার করতে গেলে চৌমুহনীতে যেতে হয়। ২০ বছর পর ১৯৯৫ সালে যখন পোস্টিং পেয়ে যাই, প্রধান সড়কের দুই পাশে তখনো প্রায় একই অবস্থা। প্রধান সড়কের দুই পাশের এই পিডাব্লিউডি’র জমি। প্রতি নির্বাচনের সময় রাজনৈতিক অঙ্গীকার থাকে যে এই জমি স্থায়ী বন্দোবস্ত করে দেয়া হবে। কিন্তু এখনো তা হয়নি বলেই জানি। যে কারণে নোয়াখালী জেলা সদরের মাঝখানেও ধানক্ষেত চোখে পড়তো। সার্কিট হাউসের পাশ দিয়ে যে রাস্তা দক্ষিণ দিকে চলে গিয়েছে তার পূর্ব পাশে ছিল লইয়ার্স কলোনী, পশ্চিম পাশে ফাঁকা জমি আর ধানক্ষেত।
এই জমি ছিল সরকারি হুকুমদখলকৃত। কেউ একজন বুদ্ধি বের করলো যে এই জমি বন্দোবস্ত নেয়া যায়। বুদ্ধিমান লোক এবং তার সহযোগীদের অভাব নাই। আর এমন সহযোগী বের হয়ে গেল নিজেদের মধ্যেও। তাই বীর মুক্তিযোদ্ধা-সাংবাদিক-কালেক্টরেট স্টাফ এই তিন গ্রুপ মিলে গিয়ে তালিকা প্রনয়ন, বন্দোবস্ত নথি সৃজনসহ যা যা করার তা’ করতে লাগলো। এদিকে আগের ডিসি বদলী হয়ে গিয়েছেন, নতুন ডিসি আসবেন ও পরে আসছেন। সব নথি তৈরী হয়ে আমার কাছে আসতে লাগলো স্থায়ী বন্দোবস্তের প্রস্তাবাকারে ভূমি মন্ত্রণালয়ে প্রেরণের জন্য। আমি স্বভাবতই রাজী হলাম না। এই তিন স্পর্শকাতর শ্রেণী যতভাবে সম্ভব আমার উপর চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করলো কিন্তু আমি তাদের চাপের মুখে নমনীয় হলাম না।
জেলা প্রশাসক চলে যেতে হলো বন্দোবস্ত নথি ভূমি মন্ত্রণালয়ে না পাঠিয়েই। এর মূল্য আমাকে দিতে হয়েছে সামান্যই। দুই বছর তাঁর ঢাকার অফিসে মাসে কমপক্ষে একবার করে গিয়েছি দুই বছরের বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদনের জন্য। তখন আমিও সচিবালয়ে চলে এসেছিলাম বলে এই ২৪+ কাপ চা খাবার সুযোগ হয়েছিল। পরবর্তী জেলা প্রশাসককে কেউ বুদ্ধি দিল এক সনা বন্দোবস্ত দেবার জন্য কিন্তু আমাকে পার হতে হবে তো। আমাকে বদলে দেবার জন্য ঢাকা থেকেও চাপ ছিল তাই সহজ হল আমাকে বদলে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক রাজস্ব থেকে সার্বিক করে দেয়া। আমার পরবর্তী অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক রাজস্ব এই জমি পূর্বে উল্লিখিত তিন শ্রেণীর আবেদনকারীদের নামে একসনা বন্দোবস্ত নথি সৃজন করে জেলা প্রশাসকের কাছে পাঠিয়ে দেন। পরবর্তীতে ২০০২-০৪ সময়কালে আমার ব্যাচমেট জেলা প্রশাসক মোস্তফা কামাল হায়দার যথেষ্ট সাহসিকতার সংগে জেলা সদরে, পাঁচ বাংলো’র সন্নিকটে এই একসনা বন্দোবস্তকৃত ভূমি থেকে এর দখলকারদের উচ্ছেদ করেন।
আমাদের চাকুরীতে নির্বাচন পরিচালনা করা ছিল তখন একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। আর নির্বাচনের মধ্যে সবচেয়ে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হল ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন। নোয়াখালীতে কর্মরত থাকাকালে তেমনই এক ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন পরিচালনা করতে হয়। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন পরিচালনায় রিটার্নিং অফিসার থাকেন উপজেলা পর্যায়ের একাধিক দপ্তর প্রধান। উপজেলা নির্বাহী অফিসার মূলত আইন শৃংখলা পরিস্থিতি রক্ষা করেন। অতিরক্ত জেলা প্রশাসক হিসাবে আমার দায়িত্ব ছিল জেলাব্যাপী পুরো নির্বাচনের সমন্বয়। ১৯৯৭ এর শুরুর দিকে হয়তো এই নির্বাচন হয়েছিল কারণ এরপরের নির্বাচন করেছি আমি জেলা প্রশাসক ফরিদপুর হিসাবে ফেব্রুয়ারি ২০০৩ সালে। ইউপি নির্বাচনের সুবিধা হল এতে পুরো জেলা ঘুরা হয়ে যায়।
প্রত্যেকটা উপজেলার প্রত্যেকটা ইউনিয়নে যেমন যাওয়া হয়েছে তেমনই হাতিয়া গিয়েও ৪/৫ দিন থেকে নির্বাচন করে এসেছিলাম। হাতিয়া উপজেলার প্রত্যেক চেয়ারম্যান ছিলেন আত্মীয়তাসূত্রে আবদ্ধ, প্রাক্তন এমপি অধ্যাপক ওয়ালী উল্যাহ এর পরিবারের। অধ্যাপক ওয়ালী উল্যাহ বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে এমপি ছিলেন কিন্তু যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় তখন বিএনপি থেকে হাতিয়া’র এমপি হয়েছিলেন তৈরী পোষাকখাতের প্রথম দিকের একজন উদ্যোক্তা প্রকৌশলী ফজলুল আজিম। বেগমগঞ্জ উপজেলার নির্বাচনের দিন রাত ৮টার দিকে খবর আসে যে একটি সেন্টারে স্থানীয় লোকজন তিন সেন্টারের মালামাল ঘেরাও করে রেখেছে। বিজিবি স্ট্রাইকিং ফোর্সের দায়িত্ব ছিল ভোট শেষে একাধিক সেন্টারের ভোটের মালামাল একত্র করে প্রিসাইডিং অফিসারদেরসহ ফিরে আসা। খবর পেয়ে রিজার্ভ স্ট্রাইকিং ফোর্স নিয়ে আমি যাই, পথে রাস্তা কেটে দেয়া ছিল তা মেরামত করে গাড়ি চলাচলের উপযোগী করতে হয়। রাত ১০টার দিকে বুহ্য ভেংগে পোলিং কর্মকর্তাসহ ভোটের মালামাল নিয়ে রাত ১১টার দিকে ফিরে আসি।