জালাল আহমেদ
অধ্যক্ষ ড. আখতার হামিদ খানকে আমি আমার একজন মেন্টর বলে মনে করেছি

তিনি ছিলেন শুভবাদী, কর্মযোগী, কল্যাণময় পরিবর্তনের অন্বেষক, অতুলনীয় সংগঠক, শিক্ষক, পন্ডিত, কবি এবং কঠিন অথচ কৌতুকপ্রিয় দক্ষ প্রশাসক

বুনিয়াদী প্রশিক্ষণের অন্যতম অংশ ছিল গ্রাম সমীক্ষা, এজন্য আমাদের দুটো দলে ভাগ করা হয়, বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমী (BARD), কুমিল্লা এবং পল্লী উন্নয়ন একাডেমী (RDA), বগুড়া। আমি বগুড়া একাডেমীতে আগে যাইনি বলে বগুড়া যেতে চাচ্ছিলাম। পরে কাউকে স্থান সংকুলান করতে গিয়ে আমি কুমিল্লা’র দলে চলে আসি। কুমিল্লা একাডেমী’র কথা আমরা সবাই হয়তো জানি। এর প্রতিষ্ঠাতা আখতার হামিদ খান, যাকে আমি সবসময় আমার একজন মেন্টর বলে মনে করেছি। আখতার হামিদ খান একজন সাহসী মানুষের প্রতিচ্ছবি যিনি সারাজীবন জনকল্যাণে কাজ করেছেন। তাঁর জন্ম ১৯১৪ সালে, ১৯৩৪ সালে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে যোগদান করেন। তিনি ক্যামব্রিজ থেকে পড়ালেখা শেষ করে কুমিল্লায় শিক্ষানবিশকাল শুরু করেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালে বাংলায় মনুষ্যসৃষ্ট দুর্ভিক্ষের প্রতিবাদে ১৯৪৪ সালে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস থেকে পদত্যাগ করেন (সাহসটা চিন্তা করেন!)। পদত্যাগ করে কি করলেন? কারো ধারনাতেই আসবে না তিনি কি করেছিলেন! তিনি লিখেছেন, ‘So I resigned from the Civil Service and went to a village near Aligarh and tried to live a labourer and an apprentice locksmith. This Tolstoyan experiment lasted for two years’.
এরপর তিনি দিল্লী জামিয়া মিলিয়া (২০২০ সালে ভারতের শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়) তে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন এবং কথিত আছে যে নিজের বেতন নিজেই ঠিক করেন ১০০ টাকা (আইসিএস হিসেবে বেতন ছিল ৩০০০ টাকা)। তৎকালীন উপাচার্য আল্লামা মাশরেকী’র মেয়েকে বিয়ে করেন। ১৯৫০ সালে তিনি পাকিস্তানে চলে আসেন এবং শিক্ষানবিশকালে কুমিল্লা ভালো লেগেছিল বিধায় তিনি কুমিল্লাতে চলে আসেন ও ভিক্টোরিয়া কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৫৮ পর্যন্ত তিনি অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। এরমাঝেই তিনি কলেজ সময়ের পর সাইকেল নিয়ে কুমিল্লার গ্রামাঞ্চলে ঘুরে বেড়াতেন, মানুষের সঙ্গে কথা বলতেন, তাদের সমস্যা বুঝার চেষ্টা করতেন। তখন কুমিল্লা’র একটা বড় সমস্যা ছিল প্রতি বছর গোমতি নদীর বন্যা। ১৯৫৪-৫৫ সালে তিনি তৎকালীন আমেরিকান সাহায্যপুষ্ট গ্রামোন্নয়ন উদ্যোগ ভিলেজ এগ্রিকালচারাল এন্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট (ভিএইড-VAID) এর পরিচালকের দায়িত্বও পালন করেন। তখন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান এর চীফ সেক্রেটারী ছিলেন পীর আহসানুদ্দিন, ১৯৩৪ ব্যাচ আইসিএস, তিনি আখতার হামিদ খানকে ডাকলেন, দায়িত্ব দিলেন গোমতির বন্যা ও এর প্রতিকার নিয়ে একটি সমন্বিত প্রতিবেদন দিতে। আখতার হামিদ খান ফিরে এসে এর সঙ্গে গ্রামীন দারিদ্র্যকেও জুড়ে নিলেন এবং তাঁর প্রতিবেদন জমা দিলেন। তখন সিদ্ধান্ত হয় যে পাকিস্তান সরকার কুমিল্লাতে একটা পল্লী উন্নয়ন একাডেমী স্থাপন করবেন এবং ১৯৫৮ সালে আখতার হামিদ খান এর প্রথম পরিচালক নিযুক্ত হন।
তিনি এখানে কাজ করেন ১৯৭১ পর্যন্ত। তখন সিএসপি অফিসাররা এই একাডেমীতে ৩ মাসের পল্লী উন্নয়ন বিষয়ক প্রশিক্ষণ নিতেন। কুমিল্লা কো-অপারেটিভ বা দ্বিস্তর বিশিষ্ট সমবায় পদ্ধতি এখান থেকেই শুরু হয় এখন যা আমরা বিআরডিবি পরিচালিত সমবায় হিসেবে চিনি। আগে এর নাম ছিল ইন্টিগ্রেটেড রুরাল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (আইআরডিপি)। এহেন আখতার হামিদ খানকে আমি তাঁর দুর্দান্ত সাহস আর উদ্যোগের কারণেই আমার মেন্টর হিসেবে মেনে নিয়েছিলাম। তাঁর সঙ্গে আমার একবার দেখা হয় ১৯৭৯ সালে, তখন বগুড়া পল্লী উন্নয়ন একাডেমী প্রতিষ্ঠার কাজ চলছে, আখতার হামিদ খান ছিলেন তাঁর পরামর্শক। তিনি বাংলাদেশে আসলেন, আইবিএতে আসবেন, একটি লেকচার দেবেন। আমার কানে আসা মাত্র, আইবিএ’র ছাত্র না হওয়া সত্ত্বেও অনুমিত নিয়ে সেই লেকচার শুনতে লেকচার হলে বসে যাই এবং বক্তৃতা শেষে হাত মেলাতে সক্ষম হই। প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ খান সারওয়ার মুরশিদ তাঁর ছাত্র ছিলেন। তিনি তাঁর প্রিয় শিক্ষক সম্পর্কে বলছেন, “ভিক্টোরিয়া কলেজের অধ্যক্ষদের মধ্যে ক’জন উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন। তাঁদের মধ্যে উজ্জ্বলতম নক্ষত্রটি ছিলেন ডঃ আখতার হামিদ খান। তিনি ছিলেন শুভবাদী, কর্মযোগী, কল্যাণময় পরিবর্তনের অন্বেষক, অতুলনীয় সংগঠক, শিক্ষক, পন্ডিত, কবি এবং কঠিন অথচ কৌতুকপ্রিয় দক্ষ প্রশাসক। কৃচ্ছ্রতা ও আদর্শবাদ ছিল তাঁর চিরসঙ্গী”।
আমরা বার্ডে আসি মার্চ মাসে। তখন একাডেমীর মহাপরিচালক বাংলাদেশের একজন খ্যাতনামা কথাসাহিত্যিক ১৯৬৫ ব্যাচের প্রাক্তন সিএসপি হাসনাত আবদুল হাই। প্রথম ব্রিফিং এর সময়ই তাঁর গোমড়া মুখের জন্য তাঁকে অপছন্দ করি এবং যে তিন সপ্তাহ ছিলাম তাতে অপছন্দ বেড়েছেই। এর কারণ ছিল আমি টেনিস খেলতাম, বাংলাদেশ একাডেমী ফর রুরাল ডেভেলপমেন্ট এ গিয়েও টেনিস খেলতাম। আমরা হয়তো খেলছি, ডিজি সাহেব আসলেন, এসে খেলার মধ্যেই একদিকে ঢুকে পড়লেন। একজন আউট হয়ে বসে পড়ল, তিনি খেলা শেষ করলেন, আবার হেঁটে বাংলোর দিকে চলে গেলেন। কোন বাক্য ব্যয় নাই। তাঁর এই অভদ্র আচরণের জন্য তাঁর আর যত গুনই থাকুক, তিনি আমার পছন্দের ছিলেন না। বার্ড এ আমাদের গ্রাম উন্নয়ন সম্পর্কে ধারনা দেয়া হল, বার্ড এর মডেল টোটাল ভিলেজ ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম অবহিত করা হল আর আমাদের ছোট ছোট দল করে গ্রাম সমীক্ষা’র জন্য এলাকা ভাগ করে দেয়া হল। আমার দলের ভাগে পড়লো কালীরবাজার ইউনিয়ন এর যশপুর গ্রাম।
আমরা গ্রামে চলে গেলাম, একটা বাড়ির নবনির্মিত বাংলাঘর (আউটহাউস) হলো আমাদের ৭ জনের আস্তানা। কাজি সালাহউদ্দিন আকবর, মনীন্দ্র দত্ত আর নিতাই সেন ছিল বলে মনে পড়ছে। চৌকি, তাঁর উপর আমাদের বিছানা পাতলাম। ঘরের মেঝে এবং ভিত সম্পূর্ণ হয় নাই, ফাঁক ছিল তাই দিনরাত মুক্তবাতাস ছিল অবারিত। খাবার ব্যবস্থা হল কয়েকশো মিটার দূরের এক ভূমিহীন বর্গাচাষীর বাড়িতে। তাঁর সঙ্গে প্রথম চুক্তি হল কোন মাংস হবে না, শাক আর দুই রকম মাছ। প্রশ্নাবলী নিয়ে আমাদের তথ্য সংগ্রহ শুরু করলাম, বিকেলে বাজারে আড্ডা, আড্ডা’র মাধ্যমেও তথ্য সংগ্রহ। খাবার সময় হলে আমরা খাবার বাড়িতে যেতাম। সাধারণ একটি ঘরে দুটো চাটাই, আসলে ধারি যাতে ধান রোদে দেয়া হয়, বিছিয়ে দিয়ে খাবার দিতো সে। তাঁর বাড়ির সামনের একটা পুকুর ইজারা নিয়ে সে মাছ চাষ করতো। সেই পুকুরের মাছ খেয়েছি প্রতিদিন আর বাজার থেকে ছোট মাছ, তাঁর খেতের শাক, সব মিলিয়ে খুব উপাদেয় খাবার।
বিকেলে বিকেলে স্কুল মাঠের সামনের কাঁচা সড়কে ব্রিজের রেলিং এ বসে গ্রামবাসীদের সাথে গল্প করেছি। তাঁরা বলে যে আখতার হামিদ খান সাহেব এই স্কুলের মাঠে তাঁদের নিয়ে বসে কথা বলতেন। আমি বললাম যে উনার আত্মবিশ্বাস ছিল যা আমাদের নেই। আমরা পদ পদবী না থাকলে অসহায় অনুভব করি কিন্তু আখতার হামিদ খানেরা নিজেদের চিনতে পারেন বলে, নিজেদের ক্ষমতা জানেন বলে অনায়াসে আইসিএস এর চাকুরী ছেড়ে দিনমজুরের কাজ করার জন্য গ্রামে চলে যেতে পারেন। আমাদের সবার জন্য এই আত্মশক্তিকে জাগ্রত করা, নিজেকে জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যেন নিজেদের সীমাবদ্ধতা এবং নিজেদের ক্ষমতাকে জানি এবং তদনুযায়ী কাজ করি।
গ্রামে ৭ দিন কাটিয়ে আবার বার্ডে ফিরে আসি। ২৬ মার্চ, স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস আমরা বার্ডে, সেখানেই বিভিন্ন দিবসের অনুষ্ঠানে অংশ নিলাম। আমি অংশ নিলাম মিনি ম্যারাথনে, ১৫০০ মিটার এর মত, বার্ড এক চক্কর এবং নিজেকে অবাক করে দিয়ে দ্বিতীয় হয়ে গেলাম! বিএমএ’র মাইল টেস্টে সেকেন্ড হওয়া যে ‘আতকা’ ছিল না তাও বোঝা গেল। বার্ড এ তিন সপ্তাহ কাটিয়ে আমরা আবার বিপিএটিসিতে ফিরে এলাম। আমরা যখন বার্ড এ তখন বিআরডিবি’র সহকারী পল্লী উন্নয়ন কর্মকর্তাদের একটি দলেরও বেসিক ট্রেনিং চলছিল। সে দলে আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের ক্লাশমেট রহিমা বেগম রুমা ছিল। তাঁর মাধ্যমে ওই দলের কয়েকজনের সংগেও পরিচয় হয়। নীলফামারী বাড়ি এক অফিসার মালেকা পারভিন ঝুমুর এর সঙ্গে পরিচয় হয়। তাঁর সঙ্গে আবার দেখা হয়েছিল দিনাজপুর এর বিরামপুর এ তাঁর কর্মস্থলে। বার্ড থেকে ফিরে আসার পর মূলতঃ মূল্যায়ন কেন্দ্রীক কাজ, পরীক্ষা, বুক রিভিউ ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ততা শুরু হল।