শিল্পায়ন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে পরিবেশ এবং মানুষ-প্রাণীকূলের জীবন ॥ ড. শাকিল
স্টাফ রিপোর্টার ॥ হবিগঞ্জ জেলার ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে দুপাশে গড়ে ওঠা শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর অপরিশোধিত বর্জ্য জেলার পুরো নদীব্যবস্থাপনা ও খাল-বিলের পানি দূষিত করছে। গত ৮ নভেম্বর দিনব্যাপী বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন বাপা’র একটি প্রতিনিধিদল মাধবপুর উপজেলার বেজুড়া খাল, খড়কির খাল ও সুতাং নদীর বিভিন্ন পয়েন্ট পরিদর্শন করে এসব খাল, নদী ও জলাশয়ে কালো কুচকুচে আলকাতরার মতো পানি প্রবাহিত হতে দেখে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
কারখানাগুলো থেকে পার্শ্ববর্তী খাল ও নদীতে পরিশোধন ছাড়া বর্জ্য ফেলায় পরিবেশ ও প্রতিবেশ হুমকীর পাশাপাশি এলাকার মানুষের জীবন-জীবিকার উপরও প্রভাব পড়ছে। একসময় প্রাকৃতিক মাছের আধার এসব খাল ও নদ-নদীর পানি দূষিত হওয়ায় এসব এলাকায় দেশী মাছের আকাল দেখা দিয়েছে। তিন ফসলী কৃষি জমির বিস্তীর্ণ এলাকার বুক চিড়ে এসব খাল ও নদ-নদী দূষিত বর্জ্য নিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় স্থানীয় কৃষকরা চাষাবাদেও সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। এলাকার অনেকেই চর্মরোগ ও শ্বাসকষ্টসহ নানাবিধ অসুখ বিসুখে আক্রান্ত হচ্ছেন। বাপা প্রতিনিধিদল জানান, এসব শিল্প প্রতিষ্ঠানের বর্জ্যসমূহ বেজুড়া খালের মাধ্যমে খাস্টি নদী হয় মেঘনা নদীতে ও সুতাং নদী হয়ে মেঘনা ও হবিগঞ্জ-কিশোরগঞ্জের হাওরে পড়ছে। অবিলম্বে এসব প্রতিষ্ঠানে ইটিপির ব্যবহার নিশ্চিত করার আহবান জানান বাপা নেতৃবৃন্দ।
পরিদর্শনকালে প্রতিনিধিদলে ছিলেন বাপার কেন্দ্রীয় আজীবন সদস্য ও সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জহিরুল হক শাকিল, বাপা হবিগঞ্জের সাধারণ সম্পাদক ও খোয়াই রিভার ওয়াটারকিপার তোফাজ্জল সোহেল, বাপা সদস্য ডাঃ আলি আহসান চৌধুরী ও ডাঃ মইনুদ্দিন সাঁকু।
বাপার কেন্দ্রীয় আজীবন সদস্য ও সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জহিরুল হক শাকিল বলেন, একটি দেশের উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য শিল্পায়নের বিকল্প নেই। কিন্তু এর চেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ আমাদের পরিবেশ ও প্রতিবেশ। পরিবেশ বিপর্যয় ঘটলে একসময় মানবিক বিপর্যয় ঘটবে। মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। মানুষের জীবনই যদি না থাকে শিল্প দিয়েই কী হবে? আর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দিয়েই কী হবে? শিল্পায়ন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে পরিবেশ এবং মানুষ ও প্রাণীকূলের জীবন। কমনওয়েলথ স্কলারশীপ নিয়ে লন্ডনে পরিবেশ বিপর্যয় নিয়ে পিএইচডি করা অধ্যাপক ড. জহিরুল হক শাকিল আরো বলেন, হবিগঞ্জের মাধবপুর থেকে অলিপুর হয়ে সিলেটর শেরপুর পর্যন্ত ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের দুপাশকে সরকার শিল্প এলাকা ঘোষণা না করা স্বত্ত্বেও এখানে দেশের বৃহৎ শিল্প-কারখানাসমূহ গড়ে উঠেছে। হবিগঞ্জের প্রাকৃতিক সম্পদ, কাঁচামাল, গ্যাস-বিদ্যুত ও যোগাযোগ ব্যবস্থার সুবিধা থাকায় মূলতঃ এসব শিল্প কারখানা গড়ে উঠেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কৃষি জমিতে শিল্প স্থাপনের নির্দেশনা দিলেও হবিগঞ্জে তিন ফসলি জমিগুলোতে শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার পাশাপাশি আরও অনেক জমিতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড ঝুলছে যেখানে অচিরেই শিল্প কারখানা স্থাপন হবে। এসব প্রতিষ্ঠান খরচ বাচাঁতেই সার্বক্ষনিক ইটিপি চালু রাখে না। অনেক কারখানার নিষ্কাশিত ধোয়া ও দূষণমূক্ত না করে নির্গত করা হচ্ছে। এলাকার লোকজনকে নাক টিপে চলাফেরা করতে হয়। বায়ু ও পানি দূষনের প্রভাব পড়ছে পুরো পরিবেশ ও প্রতিবেশ ব্যবস্থায়।
বাপা হবিগঞ্জের সাধারণ সম্পাদক ও খোয়াই রিভার ওয়াটারকিপার তোফাজ্জল সোহেল বলেন, কোনভাবেই কোন শিল্প প্রতিষ্ঠান অপরিশোধিত বর্জ্য পরিশোধন নিশ্চিত না করে কারখানার বাইরের এলাকায় যে কোন উপায়ে কিংবা কারখানার অভ্যন্তরে ভূগর্ভস্থ পানি দূষণ করতে পারে না, এটি দেশের প্রচলিত আইন ও বিধি ব্যবস্থার পরিপন্থী। আমরা ইতিপূর্বে এধরনের শিল্প-কারখানার ‘উৎসে বর্জ্য পরিশোধন’ ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ এবং সুষ্ঠু শিল্পায়নে প্রয়োজনীয় ও সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সরকারকে আহবান জানিয়েছি। বিগত বছরগুলোতে এই শিল্পায়ন পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে মারাত্মক পরিবেশ দূষণ ঘটিয়ে আসছে। যত্রতত্র কৃষিজমি, খাল, ছড়া এবং নদীসহ সকল প্রকার জীবন ও জীবিকা শিল্পদূষণের শিকার হয়েছে। এতে কোন কোন এলাকায় হাঁস-মোরগ, গৃহপালিত পশুর মৃত্যুসহ নানা রোগ জীবাণু ছড়িয়ে পড়ছে। যা কৃষিজমি ধ্বংস ও ফসলের ক্ষতি, নিরাপদ পানির অভাবসহ মারাত্মক মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করছে। এটি আজ প্রমাণিত পরিবেশবিমুখ শিল্পায়ন দেশের উন্নয়ন নয় বরং ধ্বংস ডেকে আনছে। অপরিকল্পিত শিল্পকারখানা গড়ে ওঠার চলমান প্রক্রিয়া বন্ধ না হলে ব্যাপক পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য বিপর্যয়ের মুখোমুখি হবে। অতএব পরিবেশ দূষিত করার এসকল কর্মকান্ড এখনই বন্ধ করতে হবে।