পরামর্শ
শাহ ফখরুজ্জামান
করোনাকালে আমরা অনেক নতুন শব্দের সাথে পরিচিত হয়েছি। কোয়ারেন্টিন, আইসোলেশন, লকডাউন, আরও কত কী! তবে সম্প্রতি সবচেয়ে বেশি চোখে পড়েছে যে শব্দটি, তা হলো ছবিবাজ। আলোচিত সাহেদ গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে শব্দটি বহুল ব্যবহৃত হচ্ছে। হবিগঞ্জেও সাহেদের মতো আলোচিত এক ছবিবাজ শাহ আফজাল আহমেদ। শেষপর্যন্ত পুলিশের হাতে বন্দি হয়ে এখন কারাগারে ঠিকানা হয়েছে। এই ছবিবাজরা কত ভয়ঙ্কর এবং ছবি দেখিয়ে কত বড় বড় অপকর্ম করেন, তাও মিডিয়ার কল্যাণে সবাই কমবেশি জেনে গেছেন। তবে ছবিবাজরা কিন্তু চাঁদাবাজ বা দাঙ্গাবাজের মতো অপরাধী হিসেবে পরিচিত হন না! যতক্ষণ না তাদের অপরাধের বিষয়টি সামনে আসে অথবা ধরাশায়ী হন।
ছবিবাজদের মতই ভয়ংকর আরও কিছু মানুষ আছেন। ফেস্টুনবাজ আর সেলফিবাজ। সেলফিবাজ এবং ছবিবাজ যদিও একই। এক সময় ছবি তোলার জন্য আমাদের কত সাধনা করতে হত। ফিল্মের ক্যামেরায় প্রত্যাশিত ছবির জন্য সাধনা করলেও যখন ডিজিটাল ক্যামেরা আসে তখন তা সহজ হয়ে যায়। কিন্তু যখন সেই ক্যামেরা চলে আসে স্মার্টফোনে তখন ছবি তোলা হয়ে যায় ডাল-ভাতের মতো। অবশ্য বিখ্যাত স্থানের অথবা বিখ্যাত ব্যক্তির সাথে ছবি তুলতে পারা এখনও আনন্দের। সেই ছবি শুধু আনন্দই দেয় না; বরং ছবির মাধ্যমে স্মৃতিও রক্ষা হয় অনেকাংশে। তবে সেই ছবি নিয়ে এখন সমাজে চলছে ধান্দাবাজিও।
বিখ্যাত ব্যক্তির সাথে যখন কোনো অখ্যাত ব্যক্তি ছবি তুলেন, তখন মানুষ সেই অখ্যাত ব্যক্তির যোগ্যতা ও অবস্থান যাছাই না করেই বিখ্যাত ব্যক্তি জ্ঞান করতে থাকে। আর বিখ্যাত ব্যক্তি বা ক্ষমতাবান হলে তার মাধ্যমে অনেক কাজ হাসিল করা সম্ভব এ ধারণা আমাদের সাধারণ লোকজনের। বিশেষ করে, যোগ্যতার চেয়ে বেশি কিছু অর্জন, শর্টকাটে কাজ আদায়, অনৈতিক সুবিধা নেওয়া, বিদেশে লোক পাঠানোসহ বিভিন্ন নিয়োগ ও তদবিরের জন্য সাধারণ লোকজন এ ধরনের লোকজনকে খোঁজে বেড়ান। আর এই সুযোগে আমাদের সমাজে তৈরি হয় সাহেদ ও আফজলের মতো ছবিবাজ। তারা ঠিকই বিখ্যাত ব্যক্তিদের সাথে ছবি তুলে তা ফেসবুকে প্রচার করে নিজেকে বিখ্যাত পরিণত করেন। আর সাধারণ লোকজনও টাকা নিয়ে সাহেদ ও আফজলের পেছনে ঘুরতে থাকেন।
মফস্বলের একজন গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে আমরাও মাঝে মাঝে সুযোগ পাই বিখ্যাত ব্যক্তিদের কাছে যাওয়ার। মাঝে মাঝে দুয়েকটা ছবিও তোলা হয়। হবিগঞ্জের কৃতিসন্তান ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা মরহুম স্যার ফজলে হাসান আবেদ মারা যাওয়ার আগে সর্বশেষ যখন তার নিজ এলাকা বানিয়াচং এসেছিলেন, তখন আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম এবং কয়েকটি ছবিও তোলা হয়। একটি ছবি ফেসবুকে আপলোড করার পর আমার স্কুল জীবনের এক বন্ধু ফোন নম্বর সংগ্রহ করে আমাকে ফোন দেয়। দীর্ঘদিন কোনো দেখা সাক্ষাৎ না থাকলেও তার পিতা আমার শিক্ষক হওয়ায় সহজেই চিনে ফেলি। তখন সে জানায়, সে ব্র্যাকে কর্মরত। তাকে হবিগঞ্জ থেকে সুনামগঞ্জ বদলি করা হয়েছে। আমার সাথে যেহেতু ব্র্যাকের চেয়ারম্যানের ভালো সম্পর্ক, তাই একটু তদবির করে তাকে যেন হবিগঞ্জ বদলি করার ব্যবস্থা করি। অর্থাৎ একটি ছবির মাধ্যমেই সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আমার সাথে স্যার ফজলে হাসান আবেদের ভালো সম্পর্ক। এভাবেই ছবিতে মানুষের বিশ্বাস সৃষ্টি হয়। আর এভাবেই সাহেদ আফজলরা এই ছবি ব্যবহার করে সাধারণ মানুষের সাথে প্রতারণা করে আসছেন।
দেশের হাজারও তৃণমূল নেতাকর্মী আজীবন রাজনীতি করেও বঙ্গভবন কিংবা গণভবনে প্রবেশ করতে পারেন না। কিন্তু সাহেদের মতো ব্যক্তিরা কীভাবে সেখানে অবাধে প্রবেশ করে ছবি তুলে তাদের কার্য হাসিল করেন, তা নিয়ে কিন্তু এখনই চিন্তা করতে হবে। সাহেদরা ছোট থেকে শুরু করে একপর্যায়ে মহিরুহতে পরিণত হন। তখন যারা তাদের শুরুর দিকটা জানে তারাও ভয় পান সত্য প্রকাশ করতে। ফলে তাদের অপকর্ম চলে নির্বিঘেœ।
হবিগঞ্জ সদর উপজেলার আউশপাড়া গ্রামের সাবেক মেম্বার আব্দুল হেকিমের ছেলে শাহ আফজাল হোসেন লেখাপড়া তেমন একটা করতে পারেননি। হাইস্কুলের গন্ডি অতিক্রম করতে না পারা সেই যুবক চাকুরি নিয়েছিলেন আনসারে। কিন্তু দুর্নীতির অভিযোগে বহিষ্কার হন কিছুদিন যেতেই। পরে হবিগঞ্জ জেলা বিএনপির সাবেক এক সাধারণ সম্পাদকের বাসায় পিয়নের কাজ নেয়। পরে আরেক বিএনপি নেতার সাথে কাজ করে। এরপরই তিনি বেছে নেন ছবিবাজির পথ।
বিচারপতি, মন্ত্রী, এমপি, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার, নৌবাহিনীর কমোডরের সাথে ছবি তুলে ফেসবুকে প্রচার করেন নিজেকে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে। মন্ত্রীর বেডরুমের ছবি দেওয়ার পর মানুষের বিশ্বাস আরও বেড়ে যায়। ভিআইপিদের সাথে ছবি দেখিয়ে এলাকায় প্রচার করেন বঙ্গভবন, গণভবন ও সচিবালয়ে তার অবাধ যাতায়াতের সুযোগ রয়েছে। যে কোন কাজ তিনি করে দিতে পারেন। অবার কোনো কোনো স্থানে তিনি নিজেকে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবেও প্রচার করেছেন।
সিলেট থেকে ঢাকায় ডমেস্টিক ফ্লাইটে ভ্রমণ করে সেই ছবিও মাঝে মাঝে পোস্ট দিয়ে নিজের অবস্থান জানান দেন আফজাল। সাধারণ লোকজন এই ছবি দেখে বিশ্বাস করেন শাহ আফজালের মাধ্যমে সব কাজই সম্ভব। ফলে বিভিন্ন লোকজন ঠিকাদারি কাজ, চাকুরি, নিবন্ধন পরীক্ষায় পাস, স্থানীয় নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন এবং বিদেশের ভিসা পেতে লাখ লাখ টাকা দেন তাকে। কিন্তু টাকা দেওয়ার পর কোনো কাজই না করে টাকা হাতিয়ে নেন। টাকা ফেরত চাইলে পাল্টা হুমকি দিয়ে বলেন, বিচারপতি তার আত্মীয়। বড় বড় কর্মকর্তা তার পকেটে। বাড়াবাড়ি করলে তিনি ফাঁসিয়ে দেবেন। ফলে প্রতারিত হয়েও কেউ মুখ খুলেননি তার বিরুদ্ধে। তবে শেষ রক্ষা হয়নি ওই প্রতারকের। প্রতারণার অভিযোগে পুলিশের হাতে এ ছবিবাজ।
সর্বশেষ হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসকের বাংলোতে বন্ধুদের নিয়ে গোপনে প্রবেশ করে ফেসবুকে ছবি পোস্ট করে ধরা পড়েন আফজাল। জেলা প্রশাসকের বাসভবনকে তিনি ফেসবুকে তার একটি আড্ডার স্থান হিসেবে প্রচার করেন সাধারণ মানুষের মাঝে। ধুম্রজাল সৃষ্টি করার চেষ্টা করেন। অবশ্য নিজের কোনো পদ-পদবি না থাকলেও সরকারি বিভিন্ন কর্মসূচিতে তার নামে কার্ড ইস্যু হয়। বিশেষ অনুষ্ঠানগুলোতে মাঝে মাঝে হাজিরও হন। শেষে বিষয়টি জানতে পেরে জেলা প্রশাসকের তৎপরতায় তার চেম্বারে এসে তিনি নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং ফেসবুকে ভুল স্বীকার করে একটি পোস্ট দেন। এই পোস্ট দেখে লোকজন এসে ভিড় জমান জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে। পরে দুটি মামলা দায়ের হলে পুলিশ গ্রেফতার করে আফজালকে। একটি মামলার বাদী মোহাম্মদ টিপু অভিযোগে উল্লেখ করেন, সিলেট শহরে বড় ধরনের কাজ পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে ছয় লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন প্রতারক আফজাল। ফারুক মিয়া তার মামলার অভিযোগে উল্লেখ করেন, প্রতারক আফজাল তার স্ত্রীকে হাইস্কুলের নিবন্ধন পরীক্ষায় পাস করিয়ে দেবে বলে চাল লাখ টাকা হাতিয়ে নেন। এক নারী মামলায় অভিযোগ করেন তার জমির মাঠ পর্চা সিলেট জোনাল সেটেলম্যান্ট অফিস থেকে শুদ্ধ করে এনে দিবে।
অভিযোগ রয়েছে জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার গৌর প্রসাদ রায়ের কাছ থেকে আফজাল পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরে চাকুরি নিয়ে দেবে বলে তিন লাখ টাকা হাতিয়ে নেন। মৌলভীবাজার সদর উপজেলার মল্লিখ সরাই গ্রামের হাশিম মিয়া নামে এক ব্যক্তির কাছ থেকে ইংল্যান্ড পাঠাবেন বলে চুক্তি করে ১২ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন। হবিগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি শফিউল্লাহর কাছ থেকে পিস্তলের লাইসেন্স করে দেবে বলে নেন ৬০ হাজার টাকা। এভাবে বহু লোকের সাথে প্রতারণা করেছেন আফজাল।
শাহ আফজাল গ্রেফতার হওয়ার পর হবিগঞ্জের টপ টপিক হিসেবে আলোচিত হচ্ছে এ বিষয়টি। ফেসবুকেও চলছে ব্যাপক আলোড়ন, সমালোচনা। তবে আফজালের এই পরিণতির পরও যদি আমাদের ঘুম না ভাঙে তাহলে আরও বিপদ। আর যারা তার সাথে ছবি তুলে এই অপকর্মের সুযোগ করে দিয়েছেন, তাদের নতুন করে ভাবতে হবে। ছবিবাজদের পাশাপাশি ফেস্টুনবাজরাও বিভিন্ন দিবসে বা উপলক্ষে বড় নেতার সাথে নিজের ছবি জুড়ে দিয়ে তা দৃশ্যমান স্থানে স্থাপন করেন। অনেক সময় দিবসের পরও যাতে সেগুলো নষ্ট না হয়, তার জন্য মজবুত করে তা স্থাপন করেন। ফেস্টুনে এমনও হয়, যেখানে দেখা যাবে, অমুখ নেতার পক্ষে শুভেচ্ছা।
অনেক সময় যিনি ফেস্টুন দিচ্ছেন, তিনি তার নিজের অবস্থানের উপরের প্রতিটি ধাপের নেতৃবৃন্দের ছবি দিচ্ছেন। এতে করে যারা ফেস্টুন দিচ্ছেন, তাদের সম্পর্কেও সাধারণ মানুষ উচ্চ ধারণা পোষণ করেন। অনেক সময় ছবি, ফেসবুকে পোস্ট, ফেস্টুন দিয়ে কার্য হাসিল করারও খবর পাওয়া যায়। আমার ঘনিষ্ঠ কয়েকজনের মাধ্যমে জানতে পেরেছি কয়েকজন সাংবাদিক বিভিন্ন ব্যক্তির পক্ষে প্রশংসামূলক পোস্ট দিয়ে টাকাও নিয়ে থাকেন।
এক সময় হবিগঞ্জে বিভিন্ন ধরনের তদবির বাজের নাম মুখে মুখে ফিরত। কিন্তু আফজাল সবাইকে অতিক্রম করেছে। সবকিছু মিলে এখন সময় হয়েছে আমাদের ছবিবাজ, সেলফিবাজ, ফেস্টুনবাজ ও ফেসবুকবাজ থেকে সাবধান থাকার। সাবধান হোন।
লেখক: সাংবাদিক ও আইনজীবী