ডা: মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহাব

প্রায়শই ফেইস বুকে কিছু কিছু লিখার অভ্যাস থাকলেও বিগত দুই আড়াই মাস যাবত ফেইস বুক করোনাক্রান্ত হওয়ায় এবং বিভিন্ন টকশো’তে নন মেডিকেল করোনা বিশেষজ্ঞদের আধিক্য ও অতিপাণ্ডিত্যের কারণে কোনকিছু লিখতে সাহস হয়নি। জাতীয় পত্রিকায় ‘হার্ড ইমিউনিটি বা শক্ত ইমিউনিটির পথে দেশ’ অথবা ‘জানালায় রোগীর দিকে তাকিয়ে করোনা শনাক্ত সম্ভব’ এমনিতর অনেককিছু অবলোকন করে লিখার সাহস একজন মেডিকেল পার্সন হিসেবে থাকার কথাও নয়। তাছাড়া করোনা মোকাবেলায় আমাদের বা দেশের এমত লেজেগোবরে অবস্থায় কোন মন্তব্য কতটুকু সমীচিন বুঝে উঠা কঠিন। আবার আমজনতার পক্ষে তা উপলব্ধি করাও হবে অনেকটা জগাখিচুরির মতই।
যা বলছিলাম, হার্ড ইমিউনিটি মানে Hard বা শক্ত ইমিউনিটি নয়। এটা হল Herd immunity. Herd শব্দের অর্থ হল একদল প্রাণী বা মানুষ, একটা বিশেষ গ্রুপ বা সমষ্টি। কোনো দলের বা দেশের জনগোষ্ঠীর যদি শতকরা কমপক্ষে ৭০ থেকে ৮০ভাগ জনসাধারণ রোগাক্রান্ত হয়ে শরীরে এন্টিবডি তৈরি হয় অথবা ঐ রোগের বিরুদ্ধে কার্যকরী টীকা প্রদান করে এমন হারে ইমিউনিটি বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করে ফেলা যায় তখন ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাকি জনগণ এমনিতেই রোগের প্রকোপ থেকে বেঁচে যান। পোলিও, হাম, জলবসন্ত এসব রোগ জীবনে একবার হয়ে গেলে সাধারণত আর হয়না, তথাপি এদের বিরুদ্ধে কার্যকরী টীকা প্রদান করেও হার্ড ইমিউনিটি তৈরি করতে কয়েক বছর লেগেছে।
আর আজ বৈশ্বিক মহামারি ‘কোভিড-১৯’ এর ব্যাপারে হার্ড ইমিউনিটির কথা ভাবছেন? তা শুধু বাংলাদেশ কেন, এ রোগের নানাবিধ বৈশিষ্ট্যের কারণে বিশ্বের কোন দেশেই আপাতত তা সম্ভব নয়। আমি আবারো বলছি এটা শুধুমাত্র এক অলীক কল্পনা মাত্র।

ব্যাখ্যা অতীব সহজ…
এক) কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে হার্ড ইমিউনিটির চিন্তা পোষণ করলে দেশের কমপক্ষে ৭০% জনগণকে আক্রান্ত হতে হবে, অর্থাৎ ১৭ কোটি জনসাধারণের মাঝে কমপক্ষে প্রায় ১২ কোটি জনগণকে করোনা দেবীর সাক্ষাৎ লাভ করতে হবে।

দুই) যাদের হবে তথা এ ১২ কোটি মানুষের শরীরেই কোভিডের বিরুদ্ধে স্থায়ী এন্টিবডি তৈরি হতে হবে এবং যা এ রোগের বৈশিষ্টে এখনো পাওয়া যায়নি। একজনের বার কয়েক হয়েছে এমন উদাহরণ বিশ্বে অনেক রয়েছে। কারণ এখন পর্যন্ত যতটুকু দেখা গেছে শরীরে কোভিডের বিরুদ্ধে যে এন্টিবডি তৈরি হয় তার স্থায়িত্বকাল সাময়িক, কয়েকদিন বা মাস মাত্র।

তিন) কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে এখনো কোন টীকা আবিষ্কার হয়নি। ত্বরিত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য পরিবর্তনকারী এ রোগের বিরুদ্ধে কার্যকরী টীকা সহসা বাজারজাত হয়ে যাবে এবং আমরা ১২কোটি জনসাধারণকে এর আওতায় আনতে পারব তা আপাতত ‘দিল্লি দূর অস্ত’ বা দূর পরাহত বলা চলে।

চার) দেশের ১২ কোটি জনগণকে আক্রান্ত হতে হলে সরকারি বিশ্বাসযোগ্য হিসেব মতেই ১২কোটি ×১.৪%= ১৬.৮০ লক্ষ অর্থাৎ প্রায় ১৭লক্ষ লোককে আত্মাহুতি দিতে বা মৃত্যুবরণ করতে হবে মাস মাস বা বছর জুড়ে । আর চিমিয়ে ধরা এ মৃত্যুহার এথ্থেকে কমানোর কোনই সুযোগ নেই যহেতু এর বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত সর্বজন সীকৃত কোন কার্যকরী বৈদ্যি তৈরিই হয়নি।

অতএব আবারও বলছি, হার্ড ইমিউনিটির কথা মাথা থেকে একেবারেই বাদ দিতে পারেন। তা শুধু বাংলাদেশ কেন, পৃথিবীর কোন উন্নত দেশেও আপাতত সম্ভব নয়। খোদ ইংল্যান্ডও এ অলীক কল্পনা থেকে ফিরে এসেছে।

বড়বড় পুস্তক অধ্যয়নকারী দেশের বিশিষ্ট এবং মেধাবী এপিডেমিওলজিস্ট, ভাইরোলজিস্ট ও চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের নিয়ে গঠিত টেকনিক্যাল কমিটির মতামতকে উপেক্ষা করার কোন সুযোগ নেই বলেই আমি মনে করি।
জীবনের জন্যই জীবিকা। এ উভয় মূল্যবান বিষয়কে গুরুত্ব এবং অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনায় রেখে সমন্বয় সাধন করে এগুতে হবে। আমেরিকা, ইংল্যান্ড আর ব্রাজিলকে উপমা হিসেবে নয় বরং শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভিয়েতনাম, নিউজিল্যান্ড এদেরকেও উদাহরণ মনে করে এ মহাবিপদ থেকে উত্তরণের পথ খুঁজুন।
আমজনতাকে ফাঁকি দিয়ে কোভিড মহামারি থেকে উন্নতি বা পরিত্রাণ লাভকারী দেশে কয়জনইবা চার্টার্ড বিমানে পালিয়ে যেতে পারবেন?
আবারো বলছি, জনগণ বাঁচলেই দেশ বাচবে এবং জনগণই মূল সম্পদ যা অদূরবর্তী চীন উপলব্ধি করতে পেরেছে। ইতিমধ্যে আমরা অনেক মূলবান ব্যক্তিবর্গকে হারিয়েছি। এসব মহামূল্যবান বুড়ো অভিজ্ঞদের তৈরি হতে দেশ ও জাতিকে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে বৈ কি।
এবং আবারো বলছি, যদি উপলব্ধি করে থাকেন হার্ড ইমিউনিটির অলীক বা অবাস্তব কল্পনা থেকে বেড়িয়ে আসার এখনো সময় আছে। নচেৎ আমাদেরকে আত্মহত্যা বা গনহত্যার এ নিষ্ঠুরতম পন্থাকেই আলিঙ্গন করতে হবে।
অচিরেই আমাদের এ শুভ বুদ্ধির উদয় হোক।।

ডা. এম, এ, ওয়াহাব
এফসিপিএস(রেডিওলজি এন্ড ইমেজিং)
ব্যাচ -১৪
সিওমেক।