ঘাতকদের বিচারের অপেক্ষায় প্রহন গুনছেন জেরিনের মা, বাবা
এসএম সুরুজ আলী ॥ এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হওয়ার পর যে পরিবারটিকে উল্লাসে মেতে থাকার কথা ছিল। সেই পরিবারে বইছে কান্নার রুল। পরীক্ষার রেজাল্ট বের হওয়ার কথা শুনেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছেন হবিগঞ্জ সদর উপজেলার ধল গ্রামের বাসিন্দা রিচি উচ্চ বিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রী ঘাতকদের হাতে নিহত মদিনাতুল কোবরা জেরিনের পরিবার। কেউ থামাতে পাড়ছেন না জেরিনের মা, বাবা ও বোনের কান্না। তাদের কান্নার আহাজী দেখে অনেকে নিস্তব্দ হয়ে পড়ছেন। তাদের চোখে টলমল করছে অশ্রু। আর মধ্যে চা লকর এই মামলাটি কোন অগ্রগতি বলেও জেরিনের পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে।

নিহত স্কুল ছাত্রী জেরিনের চাচাত ভাই শিক্ষানুবিশ আইনজীবি আব্দুল মবিন মিজান জানান, গতকাল ৩১ শে মে সারা দেশে একযোগে এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হয়েছে। যারা এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন, সবাইকে অভিনন্দন ও মোবারকবাদ জানাই। ফলাফল প্রকাশের পর অনেকের পরিবারের খুশির বন্যা বইছে। আজকের এই দিনে আমাদের পরিবার ও আনন্দে উৎসাহে থাকার কথা ছিল। কিন্তু আজ আমরা বেঁচে আছি কষ্টের সাগরে প্রিয়জন হারানোর দুঃখ আর কান্নার মাঝে। আমাদের পরিবারের সবার প্রিয় ছোট বোন মদিনাতুল কুবরা জেরিন হবিগঞ্জ সদর উপজেলার রিচি উচ্চ বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগের দশম শ্রেণির মেধাবী ছাত্রী যার রোল নং ১ ছিল। আজ অন্যান্য শিক্ষার্থীদের সাথে জেরিনের এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ হওয়া কথা ছিল। জেরিন এসএসসি পরীক্ষার জন্য সকল ধরণের প্রস্তুতি নিয়েছিল। পরীক্ষার জন্য সে প্রতিটি বিষয়ে ১০ বার করে রিভিশন দিয়েছিল। তিনি আরো বলেন-জেরিন ভাটপাড়া শিশুবিকাশ কিন্ডারগার্টেনের মেধাবী ছাত্রী ছিল। সেখান থেকে সমাপনী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়। জেএসসিতে জেরিন গোল্ডেন জিপিএ ৫ পেয়ে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়েছিল। জেরিন আমাদের পরিবারের সবার স্বপ্ন পূরণের পথ আরো বৃদ্ধি করে দিয়েছিল। আমার চাচা, চাচী স্বপ্ন ছিল জেরিন একদিন ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হবে। ঘাতকরা তাদের স্বপ্ন পূরন হতে দিল না ঘাতকেরা। ১৮ জানুয়ারী জেরিন বাড়ি থেকে বের হয়ে এসএসপি পরীক্ষার চুড়ান্ত প্রস্তুতির জন্য কোচিংয়ে উদ্দেশ্যে রিচি স্কুলে যাওয়ার জন্য রওয়ানা দেয়। কিন্তু পূর্ব থেকে উৎপেতে থাকা ধল গ্রামের দিদার হোসেন ছেলে জাকির ও তার সহযোগী সিএনজি চালক ঘাতক নুর-আলম, হৃদয় ও অন্য সঙ্গী সাথীদের নিয়ে জেরিনকে সিএনজি অটোরিক্সা তুলে অপহরণ চেষ্টা করে। জেরিন এ বিষয়টি অবগত হয়ে যখন চিৎকার দিচ্ছিল তখন ঘাতকেরা জেরিনকে ধাক্কা দিয়ে রাস্তায় ফেলে দেয়। গুরুতর আহত অবস্থায় জেরিনকে প্রথমে হবিগঞ্জ জেলা সদর আধুনিক হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্মরত চিকিৎসক আশংকাজনক অবস্থায় তাকে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করেন। কিন্তু পরদিন অর্থাৎ গত ১৯ জানুয়ারি জেরিন সেখানে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে। প্রথমে এ ঘটনাটি দুঘর্টনা হিসেবে প্রচার হলেও পরবর্তীতে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হবিগঞ্জ (সদর সার্কেল) মোঃ রবিউল ইসলাম পিপিএম এর নেতৃত্বে হবিগঞ্জ সদর মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ মাসুক আলীসহ অন্যান্য পুলিশ সদস্যরা তদন্ত করে এ ঘটনা মূল রহস্য উদঘাটন করেন এবং ঘটনা নায়ক জাকির হোসেনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। গ্রেফতারকৃত ঘাতক জাকির হোসেন হবিগঞ্জ সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সুলতান উদ্দিন প্রধানের আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি প্রদান করেছে। পরবর্তীতে ময়না তদন্তের জন্য জেরিন লাশ কবর থেকে উত্তোলন করা হয়। জেরিনের বাবা আব্দুল হাই কান্না জড়িত কণ্ঠে বলেন, আমার মেয়ে কোন পরীক্ষায় ফেল করেনি। সকল পরিক্ষায় ভাল রেজাল্ট করেছে। রবিবারের এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলে ভাল রেজাল্ট করতো। যেখানে আমাদের এই দিনটি আনন্দে উৎসাহে কাটানো কথা ছিল। সেই দিনে আমাদের পরিবারের লোকজন কান্না কাটি করছে। যে জেরিন পরিবারটিকে আলোকিত করে রাখতো, তা না থাকায় আমরা চোঁখে অন্ধকার দেখছি। আমাদের চোঁখের আলো ঘাতকেরা কেড়ে নিয়েছে। তিনি বলেন-আমরা আমাদের মেয়ে হত্যাকারী ঘাতকদের বিচার দেখে যেতে চাই। কিন্তু মামলার কোন অগ্রগতি আমরা দেখতে পারছি না। তিনি জেরিন হত্যা মামলাটি দ্রুত বিচারের আওতায় আনার জন্য প্রশাসনের কাছে দাবি জানান। এ ব্যাপারে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হবিগঞ্জ সদর সার্কেল মোঃ রবিউল ইসলাম জানান, জেরিন হত্যা মামলাটি তদন্ত চলছে। আশাকরি খুবই শ্রীঘই তদন্ত কাজ শেষ হবে। তিনি বলেন-পুলিশ এ মামলাটি নিয়ে আন্তরিক ভাবে কাজ করছে।
উল্লেখ্য, গত ১৮ জানুয়ারি সকালে জেরিন স্কুলে কোচিং করার জন্য বাড়ি থেকে বের হয়ে পরিবহনের জন্য রাস্তায় অপেক্ষা করে। এ সময় পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী জাকিরের সহপাঠী সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালক নূর আলম তার সিএনজিতে জেরিনকে কৌশলে তুলে নেয়। অটোরিকশাটি কিছু দূর যাওয়ার পর জাকির ও হৃদয় মিয়া নামে আরও একজন যুবককে তোলে নূর আলম। অটোরিকশাটি জেরিনের স্কুলের সামনে যাওয়ার পরও তাকে না নামিয়ে চলে যাচ্ছিল। এ সময় জাকির ও হৃদয় মিয়া জেরিনকে জোর করে ধরে রাখে। ওই সময় জেরিন জোরে চিৎকার করলে তাকে অটোরিকশা থেকে ফেলে দেওয়া হয়।
এ ঘটনার প্রতিবাদে রিচি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা হবিগঞ্জ-লাখাই সড়ক অবরোধ করে আন্দোলন করে। এ সময় পুলিশ ঘটনার সাথে জড়িতদের গ্রেপ্তারের আশ্বাস দিলে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন স্থগিত করে।
এ ঘটনায় জেরিনের বাবা আব্দুল হাই হবিগঞ্জ সদর মডেল থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলা দায়েরের পর সদর উপজেলার ধল গ্রামের জাকির হোসেনকে গ্রেফতার করে পুলিশ।