অতিথি সাংবাদিকের কলাম…
এস কে শাহীন
১৯৯৫ সাল। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার দিনগুলো। একজন সিনিয়র ভাইয়ের মাধ্যমে অস্থায়ীভাবে গেস্ট হিসেবে সুযোগ হলো এক কলেজ হোস্টেলে থাকার। সময়টা শুধু পরীক্ষা চলাকালীন, মাত্র দু’মাস। পুরোনো বিল্ডিংয়ের দ্বিতীয় তলায় ৪০৩ নম্বর কক্ষ। হালকা স্যাঁতস্যাঁতে দেয়াল, জানালার পাশে শীতল বাতাসে কাঁপা পর্দা। হোস্টেলে এর আগে কখনো থাকা হয়নি, তাই সবই নতুন-অচেনা, অজানা, আবার কেমন যেন আত্মীয় মনে হয়। ডাইনিংয়ে রান্না করতেন এক মমতাময়ী দিদি। তার একটা ছোট মেয়ে ছিল। চোখে চঞ্চল দীপ্তি, মুখে সারল্য। হালকা পাতলা ডাল, সবজি, মাছ আর মাঝে মাঝে মাংস। খাবারে খুব বৈচিত্র্য ছিল না, কিন্তু মমতা ছিল উপচে পড়া।
দিদির মেয়েটা কেন জানি ‘মামা’ বলে ডাকত। অপ্রত্যাশিত সে ডাকটি কেমন যেন বুকের কোথাও এসে গেঁথে যেত। আমি ওকে আদর করতাম, গল্প করতাম, খাওয়ার সময় দিদি যতœ করে পাতে তুলে দিত একটু বেশি ডাল, একটু নরম ভাত। দুই মাসে গড়ে উঠেছিল এক নীরব আত্মীক সম্পর্ক। দিদির প্রতি ছিল শ্রদ্ধা, তার মেয়ের প্রতি ছিল অকৃত্রিম স্নেহ। আমি কেবল একজন গেস্ট ছিলাম, কিন্তু সবার মাঝে আপন হয়ে উঠেছিলাম। দু’মাসের মেয়াদ শেষে চলে যাওয়ার সময় এসে গেল। সেদিন রাতে দিদিকে জানালাম- ‘দিদি, আগামীকাল আমি চলে যাচ্ছি।’
শুনে যেন মাথার উপর থেকে আকাশটা ভেঙে পড়ল তার। চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন, আমি থমকে গেলাম। মেয়েটাও কাঁদছে, আঁকড়ে ধরছে আমাকে। মানুষ মানুষকে যে এতটা ভালোবাসতে পারে- এই প্রথম বুঝলাম। চোখের জল আর আটকে রাখতে পারলাম না। রাতে ব্যাগ গুছিয়ে রাখলাম। ভাবলাম, সকালে দিদির মেয়েটাকে কিছু দিয়ে যাব। কিন্তু সকাল হলে- ডাইনিং ফাঁকা, রান্নাঘর নীরব, দিদি আর তার মেয়ে-দুজনেই অনুপস্থিত। আমি নীরবেই হোস্টেল ছেড়ে চলে এলাম। কিন্তু রেখে এলাম জীবনের এক টুকরো হৃদয় সেই ৪০৩ নম্বর কক্ষে।
আজ ২৯ বছর পেরিয়ে গেছে…
দিদি এখন কোথায়, মেয়েটা কেমন আছে- জানি না। কোনোদিন দেখা হয়নি আর তাহার সাথে। কিন্তু আজও দিদির চোখের জল চোখে ভাসে। মেয়েটার ‘মামা’ ডাকা এখনো কানে বাজে।