কেয়ারটেকার সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর আইনশৃঙ্খলার প্রভূত উন্নতি ঘটেছে, তবে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণহীন

“বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠের আওয়াজ আমার কর্ণে ভেসে এলো- স্যার, আমার পরিবারকে দেখবেন, আস্সালামু আলাইকুম”

আতাউর রহমান কানন

১২ এপ্রিল ২০০৭, বৃহস্পতিবার। গতকাল বিকেলে ঢাকার বাসায় এসে অবস্থান নিয়েছি। আজ সকাল ১০টায় শিল্প মন্ত্রণালয়ে গিয়ে সার বিতরণ ব্যবস্থা সম্পর্কিত সভায় যোগদান করি। সরকারি কাজে ঢাকা এসে বোনাস হিসেবে সাপ্তাহিক ছুটির দুদিন ঢাকায় কাটানোর সুযোগ হয়েছে। পরদিন প্রথম বেলা বাসাতেই কাটাই। বিকেলে স্ত্রী ও কন্যাকে নিয়ে বের হই। আগামীকাল বাংলা নববর্ষ। তাই তাদের জন্য বসুন্ধরা শপিং মলে গিয়ে কিছু কেনাকাটা করি। এরপর গাজীপুরের প্রাক্তন ডিসি ম. ফজলে রাব্বীর লালমাটিয়াস্থ বাসায় বেড়াতে যাই। আমি গাজীপুর থেকেই পদোন্নতি ও রিলিজ নিয়ে হবিগঞ্জ এসে যোগদান করেছি। তখন তিনি গাজীপুরেরই ডিসি ছিলেন। এর কিছুদিন পর তিনি সচিবালয়ের গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে যুগ্মসচিব হিসেবে যোগদান করেন। তিনি ও ভাবি বেশ অমায়িক ও অতিথিপরায়ণ। তাঁদের সাথে সময় কাটিয়ে রাত ১০টায় বাসায় ফিরে আসি।
পরের দিন বাংলা নববর্ষ উপলক্ষ্যে আমার নানা শ্বশুরালয়ে আত্মীয়স্বজনের একটা সমাবেশ ঘটে। আমিও সপরিবারে সেখানে যোগ দিই এবং দুপুরে খাওয়াদাওয়া করে বিকেলে হবিগঞ্জের উদ্দেশে রওনা করি। সন্ধ্যায় হবিগঞ্জ পৌঁছে বাসাতেই অবস্থান করি। বিগত তিনটা দিন পরিবারের সঙ্গে ঢাকায় অবস্থান করে নিজেকে বেশ সতেজ মনে হতে থাকে।
১৬ এপ্রিল ২০০৭, সোমবার। সকাল-সন্ধ্যা নিয়মিত অফিস করে যাচ্ছি। বর্তমান কেয়ারটেকার সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর আইনশৃঙ্খলার প্রভূত উন্নতি ঘটেছে, তবে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণহীন। সরকার থেকে নানামুখী কর্মসূচি গ্রহণ করে পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। ঢাকায় ‘অপারেশন ডালভাত’ কর্মসূচি বিডিআর কর্তৃক পরিচালিত হচ্ছে। সারা দেশে অনুরূপ কর্মসূচি চালানোর নির্দেশনা এসেছে। হবিগঞ্জ জেলাতেও যৌথবাহিনীর সাথে আলোচনা করে একটা পদক্ষেপ গ্রহণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ পরিপ্রক্ষিতে আজ সকাল ১১টায় আমার অফিসের সম্মেলনকক্ষে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে জেলার ব্যবসায়ীদের সাথে মতবিনিময় সভা করি। সভায় জেলার শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীগণ, পুলিশ সুপার, জেলায় কর্মরত সেনা ইউনিটের অধিনায়ক (সিও), সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও সাংবাদিক-সুধীজন উপস্থিত ছিলেন। কোনো মধ্যস্বত্বভোগী ছাড়াই প্রাথমিকভাবে শহরের ৪টি পয়েন্টে সয়াবিন তেল, মসুর ডাল, আটা ও আলু ক্রয় করে বিক্রি করা হবে। পরবর্তীতে সারা জেলায় এর প্রসার ঘটানো হবে। এ জন্য ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দদের মধ্য থেকে একটি কমিটিও গঠন করে দেওয়া হয়। উৎপাদন পয়েন্ট থেকে বর্ণিত পণ্যসমূহ ক্রয় করে সরাসরি বিক্রয়কেন্দ্রে পৌঁছানো এবং যৌথবাহিনীর সরাসরি সহযোগিতায় তা বিনা লাভে বিক্রির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
বিকেল ৩টায় হবিগঞ্জ ইসলামিক ফাউন্ডেশন কার্যালয়ে যাই। সেখানে ‘মসজিদ ভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা’ কার্যক্রমে নবীগঞ্জ-আজমিরীগঞ্জ উপজেলার ২০০৬ শিক্ষাবর্ষের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে পুরস্কার বিতরণ করি। ফাউন্ডেশনের উপপরিচালক নিরহঙ্কারী সজ্জন মাওলানা মুহাম্মদ হাবিবুল আউয়াল অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন। এই মাওলানা সাহেব তাঁর প্রতিষ্ঠানের যেকোনো অনুষ্ঠানেই আমাকে পেতে চান। আর তাঁর বদাণ্যতা ও মুগ্ধ ব্যবহারে আমি সবসময়ই তাঁকে সময় দিয়ে থাকি।
পায়ের ব্যথা এখনো পুরোপুরি না সারায় টেনিস মাঠে আর যাচ্ছি না। আজ টিভি সংবাদে দেখলাম, এবার বেগম খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোকে দুর্নীতির দায়ে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আর বড় ছেলে তো আগেই বন্দি হয়েছেন।
১৮ এপ্রিল ২০০৭, বুধবার। আমি যথাসময়ে অফিস করে যাচ্ছি। দেশের চলমান শুদ্ধি অভিযান নিয়ে মানুষের কোনো সমালোচনা নেই। সবাই নিরাপদ থাকতে চাচ্ছেন। দুর্নীতিবাজ, কালোটাকার মালিক আর কালোবাজারিগণ হিসাব-নিকাশ করে নিঃশ্বাস ফেলছেন।
বিকেল ৩টায় আমার অফিসের সম্মেলনকক্ষে জেলার পরিবহণ মালিক-শ্রমিক ও যৌথবাহিনীর সমন্বয়ে এক মতবিনিময় সভায় সভাপতিত্ব করি। এই পরিবহণ সেক্টরের অনিয়ম ও ঝঞ্ঝাট নিয়ে খোলামেলা আলোচনা হয়। অনিয়ম ও ঝঞ্ঝাট দূর করার জন্য যৌথবাহিনীর পক্ষ থেকে যাবতীয় সহায়তাদান ও পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে বলে সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
সংবাদ ছড়িয়ে পড়েছে- বিদেশ সফররত শেখ হাসিনাকে আর দেশে ঢুকতে দেওয়া হবে না। পক্ষান্তরে বেগম খালেদা জিয়াকেও দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা হচ্ছে। কেউ কেউ বলছেন- ‘মাইনাস টু ফরমুলা’র পরিকল্পনা হচ্ছে।
২৩ এপ্রিল ২০০৭, সোমবার। সকাল ১০টায় সিলেট বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে পৌঁছে মাসিক সভাসমূহে অংশগ্রহণ করি। কমিশনারের বাংলোতে ডিসিদের জন্য লাঞ্চের ব্যবস্থা ছিল। সেখানে লাঞ্চ শেষে আমি সিলেট বেতার কেন্দ্রে যাই। আমার জন্য আজ রেডিয়ো টক নির্ধারিত ছিল। আমি তাতে অংশ নিয়ে ৬টায় হবিগঞ্জ ফিরে আসি।
২৪ এপ্রিল ২০০৭, মঙ্গলবার। আজ সদর দপ্তরের বাইরে কোনো প্রোগ্রাম ছিল না। প্রথমবেলা একটানা অফিসেই ছিলাম। লাঞ্চের পর জালাল স্টেডিয়ামে গিয়ে ওয়েস্টার ইউনিয়ন জাতীয় যুব ফুটবল প্রতিযোগিতার উদ্বোধন করে পূর্ণ সময় খেলা উপভোগ করি। সন্ধ্যার পর সুরবিতান ললিতকলা একাডেমির পরিচালনা কমিটির সভায় সভাপতিত্ব করে ৯টায় বাসায় ফিরেছি মাত্র, এমন সময় মোবাইলে একটি ফোন আসে। আমি কল রিসিভ করার সঙ্গে সঙ্গে সালাম দিয়ে কলদাতা বললেন, স্যার, আমি আতাউর রহমান সেলিম, হবিগঞ্জ যুবলীগের সভাপতি।
আমি তাঁর কুশলাদি জিজ্ঞেস করলে, তিনি জানান- স্যার, ভালো নাই। বড়ই বিপদে আছি।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, বিপদ কীসের?
-স্যার, চারমাস ধরে ঘরছাড়া। এভাবে আর কত দিন থাকতে হবে? আমি কি স্যার, ঘরে ফিরতে পারব না?
-আপনার অসুবিধা থাকলে না ফিরাই ভালো।
-আমি তো স্যার জানি না আমার কি অপরাধ।
-আমার কাছেও তো তেমন কোনো রিপোর্ট নাই।
-কিন্তু স্যার, আর্মি তো মাঝে মাঝেই বাসায় হানা দিচ্ছে।
-ওদের কাছে আমার অজানা গোপন অভিযোগ থাকতে পারে।
-আমি কী করব স্যার, আপনি বলে দেন! আপনি যা বলবেন তাই করব।
-আপাতত বাতাস বুঝে চলেন। আর কিছু বলবেন?
বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠের আওয়াজ আমার কর্ণে ভেসে এলো- স্যার, আমার পরিবারকে দেখবেন, আস্সালামু আলাইকুম।
পাঠক, রাজনীতি এমনই যে, আতাউর রহমান সেলিমকে কেয়ারটেকারের পুরো সময়টাতেই আত্মগোপনে থাকতে হয়েছে। পরে তাঁর দল ক্ষমতায় আসে। তিনিও নিশ্চিন্তে রাজনীতি করেন। সচিবালয়ে আমার সাথে সাক্ষাৎ হয়। বর্তমানে তিনি হবিগঞ্জ পৌরসভার মেয়র। (চলবে…)