পইল এলাকায় এক লাশ দাফন নিয়ে দুইদলের মুখোমুখি পরিস্থিতি সৈয়দ সাহেবকে দিয়ে সামাল দিয়েছি

এক বংশ বা সমাজের অধীনস্থ গোরস্থানে অন্য বংশ বা সমাজের কোনো লাশ দাফন করতে গেলেই এমন বাঁধাবিপত্তির ঘটনা ঘটে। লাশ দাফন নিয়ে এমন ঘটনা আমি আগে অন্যকোনো এলাকায় দেখিনি বা শুনিনি। বংশ মর্যাদা ও সমাজের বিষয়ে এখানের লোকজন খুবই টনটনে।

আতাউর রহমান কানন

২৩ অক্টোবর ২০০৬, সোমবার। সকাল ৯টায় অফিসে যাই। দুপুর হতে না হতেই অফিস প্রায় ফাঁকা হয়ে যায়। আগামীকাল হতে ঈদুল ফিতরের ছুটি শুরু হতে যাচ্ছে। এবার ঈদের ছুটির ৩ দিনের শেষে সাপ্তাহিক ছুটি ২ দিন যোগ হয়ে মোট ছুটি দাঁড়িয়েছে ৫দিন। এ সুবিধায় আমার অফিসের কর্মকর্তারা প্রায় সবাই ছুটির আবেদন করেন। আমিও বিনা প্রশ্নে তাঁদের ছুটি মঞ্জুর করেছি। আগের ডিসি নাকি ছুটির বিষয়ে বেশ কড়া ছিলেন। আর কারণে-অকারণে সন্ধ্যার পর অফিসারদের বাসায় ডেকে এনে বসিয়ে রাখতেন। এসব বিষয়ে আমি উদার হওয়ায় তাঁরা আনন্দে আজই ছুটি কাটাতে যার যার গন্তব্যে রওনা হয়ে গেছেন।
আমি আমার মতো অফিসের কাজ শেষ করে বিকেলে বাসভবনে ফিরে আসি।
এখানে প্রসঙ্গত বলতে চাই যে, দুদিন আগে সন্ধ্যার পর আমি বাসভবনের অফিসকক্ষে কাজ করছিলাম। এমনি একসময় সালাম দিয়ে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ জাকীর হোসেন ঢুকেন। আমি তাঁকে বসতে বলে আসার কারণ জানতে চাইলে জাকীর বলল, স্যার, এমনিই এসেছি। তবে আগে তো প্রতিদিনই আমাদের আসতে হতো। এখন না আসাতে কেমন কেমন যেন লাগে। আর বাসা থেকে তো অন্যরকম কথা শুনাচ্ছে।
আমি জানতে চাইলাম, যেমন?
স্যার, সে তো নানারকম কথা। তবে মূলকথা হলো, বর্তমান ডিসি সাহেব মানে আপনি নাকি আমাদের দরকার মনে করছেন না।
আমি জাকীরের দিকে তাকিয়ে রইলাম। এরপর তাঁকে শুধু বললাম, ভাবিদের জানানো দরকার যে, অফিস টাইমে কাজ আর বাকিটা সময় পরিবারের জন্য।
জাকীর আমার দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবছিল। আমি তাঁর ভাবনায় বিঘœ ঘটিয়ে বললাম, জাকীর, আমি চাকরিতে যোগদানের পর মাঠ প্রশাসনে সহকারী কমিশনার-ম্যাজিস্ট্রেট-এনডিসি-ইউএনও-এডিসি পদে মোট ১৬ জন ডিসির অধীনে কাজ করেছি। এঁদের মধ্যে ১৬ রকম বৈশিষ্ট্য দেখেছি। আর আমি ডিসি হিসেবে নিজেও একরকম বৈশিষ্ট্যের। আমার মূল্যায়ন তোমাদের কাছে, এটা আমি জানি।
আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে জাকীর বলল, তা ঠিক স্যার।
আমি নিয়মিত ডায়েরি লিখি। ওইসব ডিসিদের বিষয়ও আমার ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ আছে। আমার যেহেতু বই লেখার অভ্যাস আছে, আমার স্মৃতিকথা বইতে তাঁদের বৈশিষ্ট্যের বিষয়াদি বাদ যাবে না।
তাই নাকি স্যার? সেতো খুবই ভালো হবে।
জাকীর আমার সাথে ঘণ্টাখানেক সময় কাটিয়ে চলে যায়। আমি বলে দিলাম- তোমাদের জন্য আমার বাসা অবারিত দ্বার। আর দরকার হলে অবশ্যই ডাকব।
পাঠক, এই বইয়ের ঠিক আগে আমার ডায়েরি নির্ভর ‘মেঘ জোছনার দিনগুলি’, ‘ইউএনও সাহেবের আয়না’ ও ‘জীবন নদীর বাঁকে’ তিনটি বই প্রকাশ হয়েছে। এসব বইয়ে ওই ১৬ জন ডিসির বৈশিষ্ট্য স্থান পেয়েছে।
২৫ অক্টোবর ২০০৬, বুধবার। আজ পবিত্র ঈদুল ফিতর। সকালে ছেলেকে নিয়ে হবিগঞ্জ কেন্দ্রীয় ঈদগাহে যাই। আমি জেলা প্রশাসক হিসেবে পদাধিকারে ঈদগাহের সভাপতি। আটটায় জামাত শুরুর আগে প্রথা অনুযায়ী জামাতে উপস্থিত মুসল্লিদের উদ্দেশে ‘ঈদ শুভেচ্ছা’ বক্তব্য রাখি। নামাজ শেষে বাসাতে এসে পরিবারের সদস্যদের সাথেই সময় কাটাই। বিকেল দুটায় এসপি মিলি বিশ্বাস ও দায়িত্বপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন গোলাম রাজ্জাক চৌধুরীসহ জেলা হাসপাতাল ও জেলা কারাগার পরিদর্শন করি। ঈদ উপলক্ষ্যে হাসপাতালে অবস্থানকারী রোগী এবং কারাগারের বন্দিদের শুভেচ্ছা জানাই ও তাদের মাঝে পরিবেশনকৃত উন্নত খাবারের মান প্রত্যক্ষ করি। এরপর বাসায় ফিরে রেস্ট নিই।
রাতে আমার বাসভবনে জেলায় অবস্থানরত জেলা জজ, এসপি-সহ সকল অফিসার ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সৌজন্যে এক ডিনারের আয়োজন করি। এতে প্রায় সবাই সপরিবারে অংশ নেন। একটি আনন্দঘন পরিবেশে ঈদের আনন্দ সবার মধ্যেই ঢেউ খেলে যায়।
ঈদের ঠিক পরদিন সকাল ১০টায় এসপি ফোনে জানান যে, পইল এলাকায় এক লাশ দাফন দেওয়া নিয়ে দুইদল মুখোমুখি। সংবাদ পেয়ে পুলিশ পাঠানো হয়েছে কিন্তু মানানো যাচ্ছে না। তিনি একজন ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগদানের অনুরোধ জানিয়ে কীভাবে কী করবেন, আমার পরামর্শ চান।
ঈদের আনন্দের রেশ না কাটতেই এ কী নিরানন্দের ঘটনা! এ জেলায় আমার পূর্ব কর্মঅভিজ্ঞতার আলোকে এসপিকে বললাম, পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে এ ধরনের সমস্যা সমাধান সহজতর হবে না। পইল এর চেয়ারম্যান সৈয়দ আহমদুল হক সাহেবকে কাজে লাগাতে হবে। তাঁকে আপনি বলতে পারেন, না হয় আমিই বলব।
এসপি সৈয়দ সাহেবকে বলতে আমাকেই অনুরোধ জানান। আমি ‘ঠিক আছে’ বলে এসপিকে বললাম, পুলিশ যেন আগ বাড়িয়ে কোনো অ্যাকশনে না যায়।
আমার বাসভবন অফিসের সিএ বীরেশ্বর সিংহ সৈয়দ সাহেবকে অনেক খোঁজাখুঁজির পর টেলিফোনে মিলায়ে দিলেন। আমি তাঁর সাথে বিষয়টি নিয়ে কথা বলে দ্রুত লাশ দাফনের অনুরোধ জানালে, তিনি ঘটনাস্থলে যেতে রাজি হলেন। আর জানালেন, এ এলাকায় এমন সমস্যা নাকি হরহামেশাই হচ্ছে। এক বংশ বা সমাজের অধীনস্থ গোরস্থানে অন্য বংশ বা সমাজের কোনো লাশ দাফন করতে গেলেই এমন বাঁধাবিপত্তির ঘটনা ঘটে। ঘণ্টা দুই পরে সৈয়দ সাহেব টেলিফোনে আমাকে জানালেন- সমস্যা আপাতত সমাধান হয়েছে। তবে এ ব্যাপারে আমার সাথে বসে একটা স্থায়ী সমাধান বের করবেন।
লাশ দাফন নিয়ে এমন ঘটনা আমি আগে অন্যকোনো এলাকায় দেখিনি বা শুনিনি। বংশ মর্যাদা ও সমাজের বিষয়ে এখানের লোকজন তথা সিলেটিরা খুবই টনটনে- এ বিষয়ে আমি কমবেশি জানতাম কিন্তু লাশ দাফনের বিষয়ে এবারই জানলাম। আমার মনে পড়ে পূর্বে আমি যখন এ জেলায় উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কর্মরত ছিলাম, তখন দুটি বিষয়ে আমার কোর্টে মামলা গ্রহণের আবেদন পড়েছিল।
এর প্রথমটি হলো- জনৈক অ্যাডভোকেট সাহেব তাঁর নামের শেষে চৌধুরী বংশের না হয়েও চৌধুরী লিখছিলেন। তখন চৌধুরী বংশের লোকজন একজোট হয়ে অচৌধুরীরকে তা না লিখতে বারণ করা সত্ত্বেও তিনি তা না শোনায় এলাকায় আইনশৃঙ্খলার অবনতির আশংকায় তাঁর বিরুদ্ধে মিস্ মামলা হয়। আর দ্বিতীয়টি হলো- জনৈক ব্যক্তি মাদরাসায় একটি আলমারি প্রদান করে আলমারির গায়ে দাতা হিসেবে তাঁর নামের পর ঠিকানায় ‘বড়বাড়ি’ লিখেছিলেন; তাই নিয়ে ঝগড়াঝাটি হয়ে বিষয়টি কোর্ট পর্যন্ত গড়ায়। আমি আবেদন দুটি নিয়ে মহা মুশকিলে পড়েছিলাম। কোয়াসি জুডিসিয়াল এ মামলায় কী আদেশ দেব ভেবে না পেয়ে পরপর কয়েকদিন শুনানী নিয়ে ধীর গতিতে চলি। এলাকায় বিষয়টি একরকম ‘টক অব দ্য টাউন’ হয়ে গেল।
আমি প্রথম মিস্ মামলাটি নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত উভয়পক্ষের প্রতি শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য অন্তর্বর্তী আদেশ প্রদান করে চৌধুরীপক্ষকে তাঁরা কবে থেকে, কীভাবে চৌধুরী হয়েছেন তা লিখিতভাবে জানানোর জন্য নির্দেশ দিই। আর অচৌধুরী অ্যাডভোকেটকে বললাম, তাঁর চৌধুরী টাইটেল লাগানোর ইচ্ছে কেন হলো, তা জানাতে। (চলবে…)