চুন ব্যবসায়ী ঘাট থেকে চুনারুঘাট
মুড়ারবন্দ দরগাহ্ শরিফের ভগ্ন শিলালিপি ও স্থাপত্য কাঠামোর ধ্বংসাবশেষ অমূল্য প্রাচীন প্রতœসম্পদ নিদর্শন
আতাউর রহমান কানন
১৪ অক্টোবর ২০০৬, শনিবার। সারাদিন বাসাতেই অবস্থান করি। রাতে শহরের অন্যতম ভদ্রলোক আমার পূর্বপরিচিত ডা. তপন দাশগুপ্তের পুত্রের বউভাতের নিমন্ত্রণ রক্ষার জন্য যাই। এ শহরে এ ডাক্তারের বেশ সুখ্যাতি রয়েছে। এ দাওয়াতে হবিগঞ্জের গণ্যমান্য লোক কেউ বাদ যাননি। আমি সেখানে রাত দশটা পর্যন্ত থেকে বাসায় ফিরে আসি।
পরের দিন রবিবার, সকাল ৯টায় অফিসে গিয়েই কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। ১১টা থেকে ১২টা পর্যন্ত জেলা উন্নয়ন সমন্বয় সভায় সভাপতিত্ব করি। জেলার সকল অফিসের প্রধানদের সাথে বলা যায় আজই আমার আনুষ্ঠানিক পরিচয় ঘটে। ঘড়ি ধরে অফিসে আসা-যাওয়া এবং ঘড়ি ধরে সভা-সম্মেলন করা আমার আগেরই অভ্যাস। এখানে যোগদানের পরও সেভাবেই চলছে। ঢিলেঢালাভাবে চলা যাদের অভ্যাস তারাও এখন আমার সাথে তাল মিলিয়ে চলার চেষ্টা করছেন।
বিকেল ৩টায় সংবাদ পেলাম, হবিগঞ্জ শহর ও শহরতলী এলাকায় বাস বনাম ম্যাক্সি (টেম্পু) চালকদের মারামারি চলছে। এসপির সাথে কথা বলে আপডেট নিলাম। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। শ্রমিকদল ও শ্রমিকলীগ এ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছে। আমি নেতাদের ধরে এনে তাঁদের দিয়ে থামানোর কথা পুলিশ সুপারকে বললাম। তিনি ‘আচ্ছা আচ্ছা’ বললেন। আমি খোঁজ-খবর নিয়ে জানলাম, কতিপয় স্বার্থান্বেষী মহলের কারণেই এই ঘটনা। বেশ কদিন ধরেই রেষারেষি চলছিল। আজ ঘটনার বিস্ফোরণ ঘটেছে। মারামারি সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে। পুরো শহর থমথমে অবস্থা।
১৬ অক্টোবর ২০০৬, সোমবার। সকাল ১০টায় বাস ও ম্যাক্সি চালক সমিতির নেতাদের সাথে এসপিসহ আমার অফিসে এক সভায় মিলিত হই। মূল ইস্যু চাঁদাবাজি। সে চাঁদার ভাগ নাকি অনেকেই পায়। তবে সেটাকে পাশ কাটিয়ে বাসের রুটের সব যাত্রীদের নাকি রুট পারমিটবিহীন ম্যাক্সি টানা শুরু করেছে- এমন বিষয়ই সভার আলোচনায় প্রাধান্য পায়। যাক, রুট পারমিট ও ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সভায় সিদ্ধান্ত হয়। আর পক্ষদ্বয় দাঙ্গাহাঙ্গামা-মারামারি থেকে বিরত থাকবে বলে প্রতিশ্রুতি দেয়। বিরোধ নিষ্পত্তি হওয়ায় শহরের পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে।
বিকেল ২টায় আমার পূর্বনির্ধারিত চুনারুঘাট উপজেলার মতবিনিময় সভায় গিয়ে যোগদান করি। সভায় আমন্ত্রিত কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি ও উপজেলার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ প্রায় যথাসময়েই উপস্থিত হন। ইউএনও এএইচএম আবদুল করিমের সভাপতিত্বে সভা প্রায় দেড় ঘণ্টা চলে। অন্যান্য উপজেলার মতো এ উপজেলার অধিকাংশ ইউপি চেয়ারম্যান ও গণ্যমান্য বক্তিবর্গও আমার পূর্বপরিচিত। তাঁরা আমাকে স্বাগত ও শুভেচ্ছা জানিয়ে বক্তব্য রাখেন। তাঁদের বক্তব্যে অনেক অজানা তথ্য আমার জানা হয়ে যায়। এছাড়া ইউএনও করিম উপজেলার পটভূমি ও একনজরে চুনারুঘাট সম্পর্কিত তথ্যাদির একটি ফাইল আমার অবগতির জন্য সরবরাহ করেন। চা বাগান বহুল এই উপজেলার মানুষ মোটামুটি সচ্ছল। তবে উপজেলার বাল্লা বর্ডার এলাকায় চোরাচালান কর্মকান্ড এলাকার একটি সমস্যা বলে জানা যায়। চিনি, শাড়ি, বিড়ি, ফেনসিডিল আর গরু হলো ভারতীয় চোরাচালানির প্রধানপণ্য। আর বাংলাদেশ থেকে ইউরিয়া সার, ডিজেল, সয়াবিন তেল পাচার হয়ে থাকে।
৪২৭ বর্গ কিলোমিটারের এই উপজেলায় প্রায় ৩ লাখ লোক বাস করেন, যারমধ্যে পুরুষ অপেক্ষা মহিলার সংখ্যা কিছুটা বেশি। শিক্ষার হার প্রায় ৫৫%। প্রাচীনকালে এ এলাকা ত্রিপুরা সামন্ত রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং মুসলিম বিজয়ের আগে এই তরফের শেষ রাজা ছিলেন গৌড়ের সম্রাট গোবিন্দের শ্যালক আছক নারায়ণ। এ রাজ্যের রাজধানী ছিল বাল্লা সীমান্তের কাছে বর্তমান টেকারঘাট গ্রামে। হযরত শাহজালাল (র.) ও তাঁর ৩৬০ আউলিয়ার সহায়তায় ১২০৩ সালে বাংলার সুলতান শামসুদ্দীন ফিরোজ শাহের নির্দেশে সিপাহসালার সৈয়দ শাহ নাসির উদ্দিন (র.) মাদানী কর্তৃক রাজা আছক নারায়ণের বাহিনী পরাজিত হলে এই তরফ রাজ্যে মুসলিম শাসন আরম্ভ হয়। এই এলাকার শাসনভার সুফী সাধক সিপাহসালার সৈয়দ শাহ নাসির উদ্দিন এর ওপর ন্যস্ত হয়। চুনারুঘাটের মুরারবন্দ এলাকায় তাঁর ইহলোকের পর সেখানে দরগাহ শরিফ প্রতিষ্ঠিত হয়। এই দরগাহ শরিফে সিপাহসালার সৈয়দ শাহ নাসির উদ্দিনের কবরখানা পূর্ব-পশ্চিমে। মুসলিম ধর্মীয় রীতির বাইরে এ কবর নিয়ে প্রচলিত আছে যে, সিপাহসালার সৈয়দ শাহ নাসির উদ্দিন দেহত্যাগের আগে নাকি এভাবেই কবরস্থ করতে বলেছিলেন। কিন্তু তাঁর কথামতে কবরস্থ না করে ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী তাঁকে উত্তর-দক্ষিণেই কবরস্থ করা হয়। তবে কবর কার্য সমাপ্ত করে তাঁর ভক্ত-মুসল্লিগণ ৪০ কদম দূরে যাওয়ার সাথে সাথে কবরটি নাকি এভাবে ঘুরে যায়। বর্তমানে এই দরগাহ শরিফের বিশাল প্রাঙ্গণজুড়ে রয়েছে বারোমাসি সুমিষ্ট জাম গাছ। আর তাঁর ছায়াতলে সিপাহসালার সৈয়দ শাহ নাসির উদ্দিনের আশেপাশে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন তাঁর সঙ্গী ১২০ আউলিয়া-ভক্তকুল। এ দরগাহ শরিফ আমার চেনা। আমি পূর্বে হবিগঞ্জে চাকরিকালে কৌতূহলবশত সেখানে কয়েকবার গিয়েছি। এর আঙিনা আগের চেয়ে অনেক উন্নত হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রতিবছর শীতকালে ১৩-১৫ জানুয়ারি এখানে তাঁর ভক্তকুলেরা উরসের আয়োজন করে থাকেন। এ উপলক্ষ্যে বিশাল এলাকাজুড়ে মেলা বসে। এখানে ধর্মীয় ফায়দা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও ব্যবসা-বাণিজ্যের ফায়দা কিন্তু কম নেই। মুড়ারবন্দ দরগাহ্ শরিফের ভগ্ন শিলালিপি ও স্থাপত্য কাঠামোর ধ্বংসাবশেষ অমূল্য প্রাচীন প্রতœসম্পদ নিদর্শন।
তৎকালে এ এলাকায় খোয়াই নদী ছাড়া যোগাযোগের অন্যকোন বিকল্প পথ ছিল না। সেসময় খোয়াই নদীর পশ্চিম তীরে বড়াইল মৌজায় একটি নৌঘাট ছিল। এই নৌঘাট দিয়েই নদী পথে জনসাধারণ চলাচল করত এবং চা বাগান সমৃদ্ধ এ এলাকার উৎপাদিত চা ও অন্যান্য মালামাল পরিবহণেও এই নৌঘাটটি ব্যবহৃত হত। জনশ্রুতিমতে এ ঘাটের পার্শ্বে একজন বিখ্যাত চুন ব্যবসায়ী ছিলেন। যাঁর চুনের ব্যবসা সমগ্র তরফ রাজ্যে বিস্তৃত ছিল। তখন এই এলাকা চুন ব্যবসায়ী ঘাট নামে পরিচিতি লাভ করে এবং পরবর্তীকালে এলাকাটি চুনারুঘাট হিসেবে অভিহিত হয়।
ব্রিটিশ আমলে তৎকালীন আসাম সরকারের ১০ আগস্ট ১৯১৪ সালের ৪৭ নম্বর জি স্মারকে সিলেট জেলার হবিগঞ্জ মহকুমাধীন খোয়াই নদীর তীরে মুছিকান্দিতে প্রশাসনিক থানা প্রতিষ্ঠা করা হয়। কিন্তু মুছিকান্দিতে যাতায়াতের অসুবিধার দরুণ ১৯২২ সালে চুনারুঘাট এলাকার বর্তমান স্থানে থানা সদর স্থানান্তর করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৮৩ সালে প্রেসিডেন্ট এইচ.এম. এরশাদের সামরিক শাসনকালে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকীকরণের সময় চুনারুঘাট থানা উপজেলায় মানোন্নীত হয়। প্রথম টিএনও (ইউএনও) ছিলেন এম. হাবিব উল্লাহ।
এ উপজেলায় দর্শনীয় স্থানসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:-
১. বধ্যভূমি স্মৃতিস্তম্ভ: ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় নলুয়া চা বাগানে এক মর্মান্তিক গণহত্যা সংঘটিত হয়। এখানের বধ্যভূমিটি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন। বর্তমানে স্বাধীনতা যুদ্ধে শহিদদের স্মরণে চুনারুঘাটে একটি স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপিত হয়েছে। এসব এখন এলাকার অন্যতম দর্শনীয় স্থান।
২. রেমা-কালেঙ্গা অভয়ারণ্য: হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলার অন্তর্ভুক্ত এই অভয়ারণ্যটি শ্রীমঙ্গল উপজেলার খুব কাছে এবং ভারতের ত্রিপুরা সীমান্ত সংলগ্ন। এটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সংরক্ষিত প্রাকৃতিক বনভূমি ও বন্যপ্রাণির অভয়ারণ্য। বনাঞ্চলটি শুকনো ও চিরহরিৎ বন।
রেমা-কালেঙ্গা অভয়ারণ্য ১৯৮২ সালে প্রতিষ্ঠালাভ করে এবং পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে এটির আরও সম্প্রসারণ করা হয়। বর্তমানে এই অভয়ারণ্যের আয়তন ১৭৯৫.৫৪ হেক্টর। বাংলাদেশের যে কয়েকটি প্রাকৃতিক বনভূমি এখনো মোটামুটি ভালো অবস্থায় টিকে আছে, রেমা-কালেঙ্গা তার মধ্যে অন্যতম। তবে নির্বিচারে গাছ চুরির কারণে এ বনভূমির অস্তিত্ব বর্তমানে হুমকির মুখে। জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ এই বনভূমিতে বিভিন্ন জাতের বন্যপ্রাণিরা নিরাপদে স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়ায়। এখানে আছে- বিরল প্রজাতির ৩৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ১৬৭ প্রজাতির পাখি, ৭ প্রজাতির উভচর, ১৮ প্রজাতির সরীসৃপ ও ৬৩৮ প্রজাতির গাছপালা-লতাগুল্ম। বিভিন্ন বিরল প্রজাতির পাখির জন্য এই বন সুপরিচিত এবং এদের মধ্যে রয়েছে ভীমরাজ, টিয়া, পাতি ময়না, লালমাথা কুচকুচি, সিপাহি বুলবুল, রাজ ধনেশ, শকুন, কালো মথুরা, লাল বনমোরগ, প্যাঁচা, মাছরাঙ্গা, ঈগল, চিল প্রভৃতি। এছাড়া এ বনে তিন প্রজাতির বানর ও পাঁচ প্রজাতির কাঠবিড়াল বাস; বানরগুলো হল- উল্টোলেজি বানর, লাল বানর ও নিশাচর লজ্জাবতী বানর। আর কাঠবিড়ালগুলোর মধ্যে মালয়ান বড় কাঠবিড়াল একমাত্র এ বনেই পাওয়া যায়। বন্যপ্রাণির মধ্যে উল্লেখযোগ্য আরও রয়েছে মুখপোড়া হনুমান, চশমাপরা হনুমান, উল্লুক, মায়া হরিণ, মেছোবাঘ, দেশি বন শুকর, গন্ধগোকুল, বেজি, সজারু ইত্যাদি। শঙ্খচূড়, দুধরাজ, দাঁড়াশ, লাউডগা প্রভৃতি সহ এ বনে আঠারো প্রজাতির সাপের দেখা মেলে।
৩. সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান: চুনারুঘাাট উপজেলার রঘুনন্দন পাহাড়ে…(চলবে)