আমার স্মৃতির পাতায় মন্ত্রী আসম আব্দুর রব
জালাল আহমেদ
“পলিটিক্স মেইকস স্ট্রেঞ্জ বেডফেলোস” একটি জনপ্রিয় প্রবাদ। এর প্রমাণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের চার খলিফার একজন, আসম আব্দুর রব। আমি যখন চাঁদপুরে, ১৯৮৮ সালের সেই প্রধান বিরোধী দলসমূহের অনুপস্থিতিতে নির্বাচন করে আসম আব্দুর রব সংসদে বিরোধী দলের নেতা। বলা হত গৃহপালিত বিরোধী দল, আসলেন ফরিদগঞ্জ সফরে, মওলানা আবদুল মান্নানের সফরসঙ্গী হয়ে। অবাক হয়ে দেখলাম যিনি স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি এমন একজনের সফরসঙ্গী যিনি এই পতাকা খামচে ধরে নামানোর চেষ্টা করেছিলেন। সেই আসম আব্দুর রব আবার ১৯৯৬ সালের আওয়ামী লীগ সরকারের সহযোগী, মৎস্য ও পশুপালন মন্ত্রী। আসম আব্দুর রব এর বাড়ি লক্ষীপুর এর রামগতি। রাজনীতির রহস্যপুরুষ বলে খ্যাত সিরাজুল আলম খানের বাড়ি বেগমগঞ্জ উপজেলায় চৌমূহনী চৌরাস্তার কাছে। তাঁর ভাই আখতার আলম খান ছিলেন সিভিল সার্ভিসে।
সিরাজুল আলম খান ও আসম আব্দুর রবের বাড়ি হবার কারণে নোয়াখালী ও লক্ষীপুর জেলা ছিল বিশেষভাবে জাসদ প্রভাবান্বিত। আসম আব্দুর রবের বাবা ছিলেন নোয়াখালী জেলা পুলের গাড়িচালক এবং সেই সুত্রে নোয়াখালীর জাহাজমারা মৌজায়ও তাঁর বাড়ি ছিল। সোনাপুর থেকে এখনকার সুবর্ণচর উপজেলায় যাবার প্রধান সড়কের পশ্চিম পাশে ছিল এই জমি। রব সাহেবের এক ভাই ছিল আলাউদ্দিন যিনি নোয়াখালীতে তাঁর স্বার্থ রক্ষা করতেন। তিনি একদিন আসলেন যে জাহাজমারা মৌজায় তাঁর জমিতে ধান কাটতে পারছেন না, সাহায্য প্রয়োজন। নোয়াখালীর চরে ধান কাটার মৌসুমে এটা ছিল সাধারণ ঘটনা। আর স্বাভাবিক প্র্যাকটিস ছিল বিরোধ থাকলে এই ধান চেয়ারম্যানের জিম্মায় দিয়ে দেয়া। চেয়ারম্যান ধান কেটে জিম্মা রাখতেন পরে মালিকানা ঠিক হলে ধান দেয়া হত। আমি আগে উল্লেখ করেছি যে নোয়াখালী শহরের সম্পন্ন ব্যক্তিরা হাজার একর জমির মালিক। সোনাপুর পার হলে বাগ্যারদোনা পর্যন্ত ৪০ কিলোমিটার সড়কের দু’পাশে মাইলের পর মাইল সমতল উর্বর চরের জমি। ফলে একটি আঁতাতের মাধ্যমে ধান কাটার মৌসুমে ভূমিহীনের ফসল জোতদারের গোলায় চলে আসতো।
আমি আমার প্রথম মৌসুমেই একটি মৌলিক নিয়ম অনুসরণ করা শুরু করি “যে ধান লাগিয়েছে সে ধান কাটবে”। আমার পুরো তিন বছরে আমি ধান জিম্মা দেইনি। যদি খতিয়ানে ভিন্ন মালিক থাকে তবে তার অধিকার এক-তৃতীয়াংশে।
আলাউদ্দিনকে জিজ্ঞেস করলাম ধান আপনারা লাগিয়েছেন কি না? জবাব, না। আমি বললাম, যে ধান লাগিয়েছে সে কাটবে। স্বভাবতঃই এই কথা জেনে মন্ত্রী আসম আব্দুর রব অসন্তুষ্ট। কথা বলার জন্য ঢাকা থেকে আমাকে খুঁজছেন, খুঁজে পেলেন সার্কিট হাউজের নীচতলার ডাইনিং রুমে। সেখানেই কথা বললেন টেলিফোনে এবং যখন আমি তাঁর ফরমায়েশ শুনছি না তখন চিৎকার করছেন। আমি খুব ঠান্ডা মাথায় উত্তেজিত না হয়ে কথা বললাম, কিন্তু তাঁর কথা মত কাজ হবে না এটা তিনি বুঝতে পারলেন। কয়েকদিন পর জেলা প্রশাসক কে এমডি আবুল কালাম আমাকে বললেন লক্ষীপুর যেতে, আসম আব্দুর রবের সংগে কথা বলার জন্য। তিনি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তৎকালীন ইকবাল হলে ছিলেন তখন আসম আব্দুর রব তাঁর নেতা ছিলেন।
আমার ব্যক্তিগত অনাগ্রহ সত্ত্বেও আমি লক্ষীপুরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। মাঝপথে চন্দ্রগঞ্জ বাজারের সেতুর উপর আমার গাড়ি থামালো বিপরীত দিক থেকে আসা আসম আব্দুর রবের একান্ত সচিব, আমার ব্যাচমেট এওয়াইএম একরামুল হক। বললো যে মন্ত্রীর মেজাজ ভালো না, আমি যেন তর্ক না করি। কারণ সে আমাকে জানতো যে মন্ত্রীর অনুরোধ অসঙ্গত হলে আমি তা শুনবো না। লক্ষীপুর সার্কিট হাউজে যখন মন্ত্রীর রুমের সামনে গেলাম তখন মন্ত্রী রুম থেকে বের হয়ে আসছিলেন, বললেন যে চলেন আমরা নাস্তা করবো এক সংগে। আমরা গেলাম লক্ষীপুর খ্যাত আবু তাহেরের বাসায়। নাস্তা করে আবার মন্ত্রী বেরিয়ে যাবেন, সবাই বেরিয়ে গেছেও। নোয়াখালী’র সাংবাদিক মনিরুজ্জামান চৌধুরী বললেন যে আপনি এখন কথা শেষ না করলে সারাদিন আপনাকে সংগে নিয়ে ঘুরবে দেখানোর জন্য যে নোয়াখালী’র এডিসি তাঁর পেছনে ঘুরছে! আমি মন্ত্রীকে বললাম যে স্যার, কি জন্য ডেকেছেন? কারণ আমি এখান থেকে ফিরে যাবো, কাজ রেখে এসেছি।
তিনি আবার ফিরে বাসার ভেতরে এলেন, কেবল আমি আর মন্ত্রী, আর কেউ নেই। তিনি প্রথমেই রাগত স্বরে বললেন যে কেন আমি তাঁর পৈত্রিক জমি থেকে ধান কাটতে সাহায্য করছি না! আমি বললাম যে স্যার, আপনার তো বাড়ি আছে ওখানে একটা? তিনি বললেন যে, হ্যাঁ। কতটুকু জমি? পাঁচ একর। আপনার পৈত্রিক জমি কতটুকু? বললেন যে পাঁচ একর! তাহলে তো আপনার পাঁচ একর আপনার আছেই। তিনি বললেন যে জরিপে নির্ধারিত হয়েছে যে ঐ পাঁচ একর জমি তাঁর পৈত্রিক। আমি বললাম স্যার তাহলে আপনার বাড়ি ছেড়ে ঐ পাঁচ একরে চলে যান তাহলেই হয়। তিনি ক্ষেপে গেলেন এবং আমাকে দেখে নেবেন বলে বেরিয়ে গেলেন। আমি নোয়াখালী ফিরে এলাম। বিষয় পরিস্কার, জাহাজমারা মৌজায় তাঁদের ৫ একর জমি ছিল, নদীতে ভেংগে যায়, আবার সেখানে চর জাগে। যখন চর জাগে তখন পুরনো মালিকেরা সবাই পারষ্পরিক বুঝাপরায় নিজ নিজ জমির দখলে নিয়ে নেন। তাঁরাও ৫ একর জমি দখলে নিয়ে বসবাস করতে থাকেন। দিয়ারা জরিপের পর পুরনো দাগ যেখানে পড়ে সে জমিও তিনি চাচ্ছিলেন পৈত্রিক দাবী করে। ৫ একরের জায়গায় ১০ একর, আবার এ নিয়ে বড় গলাও! সত্যি বিচিত্র এই দেশের নির্লজ্জ এই নেতা!