তিন চেয়ারম্যান পুরো চরের বন কেটে তাদের লোক বসিয়ে দখল করে নেয়
জালাল আহমেদ

নির্বাচনের ১১ দিন পর ২৩ জুন ১৯৯৬ আওয়ামী লীগ সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে। ১৯৭৫ এর দুঃখজনক বিয়োগান্তক ঘটনায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ গণতান্ত্রিক পন্থায় পুনরায় ক্ষমতায় আসতে সমর্থ হয়। ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে ক্ষমতায় আসা বিএনপি সরকারের পতনের কথা যদি আমরা মনে রাখি তাহলে জনতার মঞ্চের কথাও আমাদের মনে থাকবে। তখন থেকেই প্রশাসনে রাজনৈতিক প্রভাব লক্ষনীয়ভাবে বেড়ে যেতে থাকে। জেলা পর্যায়ে প্রশাসনে পরিবর্তন আসতে থাকে। অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আবদুস সোবহান সিকদার তৎকালীন চীফ হুইপের একান্ত সচিব হিসাবে বদলি হন।
জেলা প্রশাসক মশিউর রহমান বদলি হন। নতুন জেলা প্রশাসক হন একই ব্যাচের কে এম ডি আবুল কালাম যিনি ছিলেন প্রাক্তন ইন্ডাস্ট্রিয়াল ম্যানেজমেন্ট সার্ভিসের সদস্য। নতুন জেলা প্রশাসক চলে আসলেন কিন্তু এসে সার্কিট হাউসে অপেক্ষমান রইলেন। কারণ আগের জেলা প্রশাসক তালিকাভূক্ত এবং ফরমায়েশি ফেয়ারওয়েল নিয়ে ব্যস্ত। বেশ কয়েকদিন হয়ে গেল দায়িত্ব হস্তান্তরের কোন তারিখ হচ্ছে না। আমরাও বিব্রত বোধ করছি। এর মাঝেই একদিন ইনকিলাব পত্রিকায় খবর বের হল যে বিদায়ী জেলা প্রশাসকের বিদায় সংবর্ধনার জোয়ারে সার্কিট হাউসে বন্দী নবাগত জেলা প্রশাসক। এরপর কমিশনার অফিস থেকে তাগিদ ও নতুন জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব গ্রহন। এই ঘটনা ছিল শিক্ষামূলক। এর ছয় বছর পর আমি যখন জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব নিতে যাই তখন বিদায়ী জেলা প্রশাসক জেলা ত্যাগ না করা পর্যন্ত আমি যাইনি। আমার দ্বিতীয় জেলাতেও আমি একই পদ্ধতি অনুসরণ করেছি। উভয় জেলায় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে দায়িত্ব নিয়েছি আর বদলীর আদেশ পেয়ে ৭ দিনের মধ্যে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে দায়িত্ব দিয়ে জেলা ত্যাগ করেছি।
১৯৯৬ সালেই হাতিয়াতে পুলিশের গুলিতে একজন নিহত হবার একটা ঘটনা ঘটে। ১৯৯৬ সাল আর ২০০৬ সালের মধ্যে অনেক পার্থক্য, আরো পার্থক্য তার সংগে ২০১৬ সালের! তখন একটা পুলিশ ফায়ারিং হলে তা জাস্টিফাই করার জন্য পুলিশের উদ্বেগ ছিল লক্ষনীয়। আরো ১০ বছর আগে যাই যদি! ১৯৮৬ সালে যখন মতলব এর সুলতানপুর ইউনিয়নের নির্বাচনে ম্যাজিস্ট্রেট আতাউল হকের উপস্থিতিতে পুলিশ গুলি করে তখন ম্যাজিস্ট্রেরিয়াল অর্ডার ছাড়া পুলিশের গুলি ছিল বিরল। আর গুলি করলে পুলিশ রেগুলেশন অফ বেঙ্গল (পিআরবি) অনুযায়ী তার যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠা ছিল আবশ্যকীয়। ২০০৫-২০০৬ এ যখন র‌্যাব এর ‘ক্রস ফায়ারে’ অনেক আসামী বা সন্দেহভাজন মারা যাচ্ছিল তখন এই যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠার বিষয়টি বুঝতে বুঝতেই অনেক সময় চলে যায়। পরবর্তীতে এ জন্য ঢাকা মহানগরীর প্রতিটি ক্রসফায়ার এর জন্য ফৌজদারী কার্যবিধি’র ১৭৬ ধারায় মৃত্যুর কারণ নির্ণয়ে তদন্ত করা হয়। উল্লেখ্য ঢাকা মহানগরীতে পিআরবি প্রযোজ্য নয়।
হাতিয়ার এই ঘটনায় দু’সদস্য বিশিষ্ট এক কমিটি গঠন করা হয় যেখানে আমার সংগে ছিল আমার ব্যাচমেট ও নোয়াখালীতে প্রতিবেশী, বাঁশখালী বাড়ি, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার অমূল্য ভূষন বড়ুয়া। আমরা দু’জনেই হাতিয়া যাই, তিন বা চারদিন থেকে এই তদন্ত সমাপ্ত করে সদরে ফিরে আসি। আগেই উল্লেখ করেছি বাগ্যারদোনা ঘাটের কথা। সে ঘাট থেকে জেলা পুলের ২৯ ফুট রেসকিউ বোটে চড়ে আমরা হাতিয়া যাই, তমরদ্দি ঘাটে নামি। তখন হাতিয়ার এমপি আওয়ামী লীগের ওয়ালী উল্যাহ। তাঁর ভাতিজা মহিউদ্দিন তখন সদর ইউপি চেয়ারম্যান। উপজেলার জীপে চড়ে যখন উপজেলা সদরে রেস্ট হাউসের কাছাকাছি আসি তখন রাস্তার ডান থেকে বামে দৌড়ে নেমে যায় একটা লম্বা ঝাঁকড়া চুলের কালো কুকুর। কালো কুকুরের যাত্রা নাস্তি’র কথা না ভেবে তখন মনে পড়ল যে সেইন্ট মার্টিনের মত হাতিয়াতেও ভালো জাতের ‘শিপ জাম্পার’ কুকুর পাওয়া যায়। চেয়ারম্যান মহিউদ্দিনকে বললাম যে আমার একটা ভালো জাতের কুকুর চাই।
যাই হোক, যে প্রসঙ্গে ছিলাম, পরদিন থেকে তদন্ত শুরু করি। ঘটনাস্থল সূর্যমুখী খাল পরিদর্শন করি। খালটা পূর্ব-পশ্চিমে লম্বালম্বি, যেহেতু সূর্য পূর্ব দিকে উদয় হয়ে পশ্চিমে অস্ত যায় তাই খালের নাম সূর্যমুখী খাল। আবারো স্মরণ করিয়ে দেই ১৯৯৬ সালেও দেশে প্রচুর চোরাচালানকৃত ৫৫৫ ব্রান্ডের সিগারেট ঢুকতো। তেমনই এক সিগারেটবাহী ট্রলার নিয়ে দু’দল চোরাকারবারির মধ্যে মেঘনা মোহনায় সংঘর্ষ হয়। কাছাকাছি হওয়ায় হাতিয়া পুলিশ এতে ইন্টারভেন করে। তারা ট্রলারের দখল নেয় এবং ট্রলার থানার ঘাটের কাছে না এনে সূর্যমুখী খালে ঢুকিয়ে রাখে যা তাদের অসদুদ্দেশ্য প্রকাশ করে। যুদ্ধ করে ট্রলার জয়ের খবর নোয়াখালী সদরে জানানো হয় নাই। এদিকে রাতে হাতিয়ার লোকজন, এতে চোরাচালানীদের দুই দলের লোকজনও থাকতে পারে, সিগারেট বোঝাই ট্রলার আক্রমণ করে। ওদিকে কেউ কেউ হয়তো সিগারেটের দরদামে ব্যস্ত ছিল। এক মাস্টার কার্টুন সিগারেট তখন আশি হাজার থেকে এক লক্ষ টাকা। ট্রলার পাহারায় নিয়োজিত পুলিশের লুটপাট ঠেকানোর কোন উপায় ছিল না। এক পর্যায়ে পুলিশ গুলি চালায়, একজন নিহত হয়।
পুরো ঘটনায় ওসি হাতিয়ার অসদুদ্দেশ্য স্পষ্ট ছিল। ফিরে এসে প্রতিবেদন চূড়ান্ত করছি, এরমধ্যে ওসিকে বান্দরবান জেলায় সংযুক্ত করা হয়েছে। সে আসলো আমার সঙ্গে দেখা করতে এবং আমাকে প্রলুব্ধ করার চেষ্টাও করে। পরে প্রতিবেদন তৈরী করলে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার অমূল্য ভূষন বড়ুয়া বিনা পরিবর্তনেই তাতে স্বাক্ষর করেন এবং চূড়ান্ত তদন্তে সংশ্লিষ্ট ওসি চাকুরীচ্যুত হন। আর কিছুদিন পর হাতিয়া থেকে একটা ক্রসব্রিড কুকুর পাই, লালচে সাদা রঙের সেই কুকুর ছিল এক অসাধারণ পোষা প্রাণী।
হাতিয়া উপজেলায় আমার এই প্রথম সফরে হাতিয়ার যোগাযোগের সমস্যাটা চোখে পড়ে। বাগ্যারদোনা ঘাট থেকে জোয়ারের সময় ছাড়া সি ট্রাক বা বোট ছাড়তে পারে না। আর প্রায় এক ঘন্টা সময় সাবধানে ধীরগতিতে চালিয়ে এই খাল থেকে বের হয়ে মেঘনার মূল ধারায় পড়তে হয়, তারপর নদী পাড়ি। চর বাগ্যা তখনো বন সৃজন ও ভূমি সংরক্ষণের জন্য বন বিভাগের অধীনে। ফিরে আসার পর আমি এই চর খাস দখলে নিয়ে আসা অথবা কম্যুনিটি ফরেস্ট্রী’র জন্য ইজারা দেবার চেষ্টা করি। বাগ্যারদোনা খালের উপর বেইলী ব্রীজ নির্মাণ করে চরের উপর দিয়ে মেঘনার মোহনা পর্যন্ত রাস্তা নির্মাণের লিখিত প্রস্তাবও করি।
আমার ব্যাচমেট জহিরউদ্দিন খন্দকার তখন ডিএফও নোয়াখালী, তিনি এর প্রচন্ড বিরোধিতা করেন। ফলে এই প্রস্তাবনা নিয়ে খুব বেশিদূর আগানো যায়নি। ফলতঃ যা হল আমি ১৯৯৮ সনে বদলী হয়ে আসার কিছুদিন পর চরবাটা’র চেয়ারম্যান, রামগতি’র চেয়ারম্যান ও হাতিয়া’র তমরউদ্দিন (তমরদ্দি) এর চেয়ারম্যান পুরো চরের বন কেটে তাদের লোক বসিয়ে দখল করে নেয়। পরে চরে রাস্তাও হয় এবং এখন মূল নদীর উপর চেয়ারম্যান ঘাট হতে হাতিয়া যাওয়া সহজতর হয়েছে। তবে আমি এডিসি থাকাকালেই এটা দেখা যায় যে হাতিয়ার উত্তরাংশ ভেঙ্গে ভেঙ্গে যেমন দক্ষিণে সরে গিয়েছে তেমনি সুধারামের দক্ষিণে নতুন চর জেগেছে। ফলে চর ব্যগ্যা বাস্তবে হাতিয়ার অংশ, সেই অর্থে হাতিয়া, তমরদ্দি ইউনিয়ন এখন মেইনল্যান্ডেও আছে।