আসামীদের স্বীকারোক্তির বরাত দিয়ে পুলিশ সুপারের তথ্য প্রকাশ
স্বামীগৃহ থেকে চলে যাওয়া স্ত্রী শর্ত দিয়েছিলেন পরকীয়া প্রেমিকা রোকসানা আক্তার মিষ্টিকে হত্যা করলে তিনি স্বামীর সংসারে ফিরবেন। স্ত্রীর শর্ত মানতে স্বামী আফসার স্ত্রীর সাথে মেয়েটিকে রাতে টিলায় নিয়ে স্ত্রীর সামনেই শেষ বারের মতো ধর্ষণ করে। এরপর স্বামী-স্ত্রী মিলে মেয়েটির গলায় ওড়না পেচিয়ে হত্যা করেন।

এসএম সুরুজ আলী ॥ চুনারুঘাটে স্ত্রীর শর্ত মানতে পরকীয়া প্রেমিকাকে হত্যা করে লাশ টিলায় ফেলে দিয়েছিল ঘাতক আফসার। স্ত্রীকে সাথে নিয়েই আফসর এই হত্যাকান্ড ঘটায়। শুধু তাই নয়, স্ত্রী রিপার সামনেই পরকীয়া প্রেমিকাকে শেষবারের মতো ধর্ষণ করে আফসার। দীর্ঘ ৭ মাস আত্মগোপনে থেকে এ হত্যাকান্ডের ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করলেও শেষ রক্ষা হয়নি আফসার ও তার স্ত্রী রিপার। পুলিশ ঘটনার রহস্য উদঘাটন করে ঘাতক স্বামী-স্ত্রীকে গ্রেফতার করেছে। গতকাল বুধবার তারা আদালতে হত্যার দায় স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। আদালতে ও পুলিশের কাছে ঘাতকদ্বয় নিষ্ঠুর এই হত্যাকান্ডের বিবরণ দিয়েছে। গতকাল সন্ধ্যায় নিজ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে তাদের জবানবন্দির বরাত দিয়ে সাংবাদিকদের কাছে রোকসানা আক্তার মিষ্টি (২২) হত্যার বিবরণ তুলে ধরেন পুলিশ সুপার মোহাম্মদ উল্ল্যা (বিপিএম-পিপিএম সেবা)।
পুলিশ সুপার বলেন, চলতি বছরের শুরুর দিকে একদিন ঘটনাচক্রে চুনারুঘাট উপজেলার পাচারগাঁও গ্রামের আব্দুল খালেকের ছেলে আফসার মিয়া ওরফে কাওছারের স্ত্রী রিপা বেগমের সাথে জনৈক শুকলা এবং নোয়াখালী জেলার চাটখিল উপজেলার কামালপুর গ্রামের বাসিন্দা খোরশেদ আলী মজুমদারের মেয়ে রোকসানা আক্তার মিষ্টির পরিচয় হয়। এদিকে, রোকসানা আক্তার মিষ্টি ও শুকলা থাকার জন্য মৌলভীবাজার শহরে ভাড়া বাসা খুঁজছিলেন। এ খবর জানতে পেরে ভিকটিম মিষ্টি ও শুকলাকে সাবলেট হিসেবে থাকার প্রস্তাব দেন রিপা বেগম (২৪)। প্রস্তাবে রাজি হয়ে শুকলা ও মিষ্টি মৌলভীবাজার শহরে জনৈক চাঁদ মিয়ার দুর্গামহল্লাস্থ রিপার ভাড়া বাসায় ওঠে বসবাস করতে থাকেন। একই বাসায় রিপার স্বামী আফসার মিয়া ওরফে কাওছার (২৮) থাকতেন। কিছুদিন পর শুকলা সেখান থেকে অন্যত্র চলে যান। এক বাসায় থাকার সুবাদে মিষ্টির সাথে রিপার স্বামী আফসার মিয়া ওরফে কাওছারের পরকীয়া প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে। তাদের মধ্যে দৈহিক সম্পর্ক চলতে থাকে। বিষয়টি আফসারের স্ত্রী রিপার নজরে পড়ে যায়। তিনি স্বামীকে পরকীয়া থেকে ফিরে আনার চেষ্টা করেন। এ নিয়ে স্বামী আফসার মিয়ার সাথে রিপার সম্পকের্র চরম অবনতি ঘটে। প্রায়ই এ নিয়ে স্বামী আফসার স্ত্রী রিপাকে মারধর করতেন। ঘটনার আগের দিনও স্বামী আফসার মিয়া স্ত্রী রিপাকে গালিগালাজ ও মারধর করলে রিপা মনের দুঃখে হবিগঞ্জ সদর উপজেলার ধুলিয়াখাল এলাকায় সৎ বাবার বাড়িতে চলে যান। ৬ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় আফসার মিয়া তার স্ত্রী রিপাকে ফোন করে দুঃখ প্রকাশ ও অভিমান ভাঙানোর চেষ্টা করেন। রিপা আক্তার স্বামীকে শর্ত দেন- মিষ্টিকে মেরে ফেললে স্বামীর কাছে যাবেন, অন্যথায় না। স্ত্রীর এ প্রস্তাবে রাজি হয় স্বামী আফসার। এরপর তারা মোবাইল ফোনে কথা বলে মিষ্টিকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। সে অনুযায়ী পরকীয়া প্রেমিকা মিষ্টিকে মৌলভীবাজার থেকে সাথে নিয়ে শায়েস্তাগঞ্জ নতুনব্রীজে আসেন আফসার। এরপর মিষ্টি ও রিপার স্বামী রিপাকে শায়েস্তাগঞ্জ নতুনব্রীজ এলাকায় আসার জন্য অনুরোধ করলে তিনি রাতে নতুনব্রীজ এলাকায় যান। সেখানে রিপা তার স্বামীকে মোবাইল ফোনে বলেন যদি তুমি মিষ্টিকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে পারো তাহলে আমি তোমার সংসার করবো। নতুবা কোনদিন আমি তোমার সংসারে ফিরে যাবো না। এমতাবস্থায় রিপার ক্রমাগত চাপে আফসার প্রেমিকা মিষ্টিকে মারতে সম্মত হয়। মিষ্টির আড়ালে তারা দু’জনে হত্যার পরিকল্পনা তৈরি করেন। এরই অংশ হিসেবে রিপার স্বামী আফসার নতুনব্রীজের ফুটপাত সংলগ্ন জনৈক পান বিক্রেতার নিকট থেকে কৌশলে একটি ধারালো কেঁচি (সিজার) সংগ্রহ করেন। কেঁচিটি কৌশলে প্যান্টের পকেটে লুকিয়ে গাড়িতে করে আফসার তার স্ত্রী রিপা ও পরকীয়া প্রেমিকা মিষ্টিসহ নিজের বাড়িতে যান। সেখানে খাওয়া দাওয়া শেষে পুনরায় মৌলভীবাজার শহরে তাদের বাসায় যাওয়ার কথা বলে স্বামী-স্ত্রী ভিকটিম মিষ্টিকে কৌশলে চুনারুঘাট উপজেলার রানীগাঁও ও চাটপাড়া গ্রামের মাঝামাঝি হাওরে যোগীর আসন টিলায় নিয়ে যান। পথে স্বামী এবং স্ত্রী ভিকটিম মিষ্টিকে মেরে ফেলার কথা ইশারা ইঙ্গিতে একে অপরকে আদান প্রদান করেন। টিলায় আসার পর প্রথমে স্ত্রী রিপা আক্তারের সহায়তায় স্বামী আফসার ভিকটিম মিষ্টিকে টিলার পাদদেশে ফেলে ধর্ষণ করেন। পরে স্বামী স্ত্রী মিলে ভিকটিম মিষ্টির পরনে থাকা ওড়না দিয়া তার গলায় ফাঁস লাগিয়ে তাকে হত্যা করেন। মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য আফসার তার সঙ্গে আনা ধারালো কেঁচি দিয়ে ভিকটিম মিষ্টির থুতনীর নিচে গলায় সজোরে ঘাঁ দেন। এরপর মৃত্যু নিশ্চিত করে আসামী আফসার নিহত মিষ্টির পরিচয় গোপন রাখার জন্য তার পরনের জিন্স প্যান্ট খুলে ফেলেন এবং মিষ্টির সাথে থাকা মোবাইল ফোন ও ভ্যানিটি ব্যাগ নিয়ে যান। মিষ্টির জুতাসহ অন্যান্য কাপড় ঘটনাস্থলে ফেলে রেখে চলে যান তারা। এছাড়াও হত্যাকা-ে ব্যবহৃত রক্তমাখা কেঁচি (সিজার) ঘটনাস্থলে ফেলে যান। এরপর তারা দু’জনে ওই রাতেই মৌলভীবাজার শহরে ফিরে যান। ভিকটিমের মোবাইল ফোনটি আসামী আফসার মৌলভীবাজার শহরে এক অজ্ঞাত ব্যক্তির কাছে বিক্রি করে দেন।
৬ ফেব্রুয়ারি রাতে পুলিশ স্থানীয়দের মাধ্যমে খবর পেয়ে রিপার মরদেহ উদ্ধার করে অজ্ঞাত হিসেবে দাফন করে। পরে ৮ ফেব্রুয়ারী পুলিশ বাদি হয়ে অজ্ঞাত আসামীদের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা দায়ের করে। গত ২০/২৫ দিন পূর্বে এ মামলার ঘটনাস্থলের পাশর্^বর্তী এলাকা করাঙ্গী নদীর তীরে একজন অজ্ঞাত লোক জনৈক ফারুক নামের এক লোককে ঢাকা থেকে এনে হত্যার উদ্দেশ্যে ছুরিকাঘাত করে। উক্ত ঘটনার তদন্তকালে পুলিশ জানতে পারে পাচারগাঁও গ্রামের এক লোক তার পরিচয় গোপন করে কাওছার নামে সদর আধুনিক হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণ করেছে। পুলিশ কাওছারের প্রকৃত পরিচয় জানতে পারে। পরে পুলিশ তথ্য পায় কাওছারের প্রকৃত নাম আফসার এবং তিনি অত্র মামলার ঘটনার দিন রাতে তার স্ত্রী রিপা বেগমসহ একটি অপরিচিত মেয়েকে নিয়ে পাচারগাঁওয়ে নিজ বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন। পরে কাওছারের মাকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করলে এক পর্যায়ে তিনি জানান ঘটনার দিন রাতে ছেলে আফসার, তার স্ত্রী ও জিন্স প্যান্ট পরিহিত একটি মেয়েসহ বেড়াতে এসেছিল। পুলিশ উক্ত হত্যাকা-ে আফসারের জড়িত থাকার বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার পর তাকে গ্রেফতার করতে তৎপর হয়। এক পর্যায়ে মহিলা পুলিশ আফসারের সাথে প্রেমের অভিনয় শুরু করেন। প্রেমিক আফসার তার প্রেমিকার সাথে দেখা করতে এলে তিনি পুলিশের জালে ধরা পড়েন। পুলিশ হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদে তিনি হত্যাকা-ের দায় স্বীকার করেন। নিহত মেয়েটির নাম মিষ্টি বলে জানালেও আফসার তার প্রকৃত পরিচয় জানেন না। তবে মেয়েটি মৌলভীবাজার শহরে ডিটারজেন্ট কোম্পানীর বিক্রয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করতেন বলে আফসার পুলিশকে জানিয়েছেন। সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান হবিগঞ্জের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ উল্ল্যা।
গতকাল অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আনোয়ার হোসেন, চুনারুঘাট থানার ওসি শেখ নাজমুল হক, ওসি তদন্ত চম্পক দাম।