পাঠকের চিঠি
এম এ মজিদ

একজন মানুষের মৃত্যুর সংবাদ লিখতে কয়বার কাঁদা যায়, আমি জানি না। লিখতে গিয়ে বারবারই চোখে পানি চলে আসছে। আপাদমস্তক একজন ভাল মানুষ ছিলেন হবিগঞ্জ জেলা অ্যাডভোকেট সমিতির সিনিয়র সদস্য আলহাজ্ব মোঃ নজরুল ইসলাম। হঠাৎ করে তাঁর মৃত্যুর সংবাদটি পুরো আদালত পাড়ায় শোকের ছায়া নেমে আসে। বিজ্ঞ বিচারক, বিজ্ঞ অ্যাডভোকেট, কোর্টগুলোর পেশকার, সেরেস্তাদার, মোহরার, আইনজীবী সমিতির স্টাফ, কোর্টগুলোর স্টাফ, অনেক বিচার প্রার্থী প্রায় সবার মধ্যেই শোক বিরাজ করছে। অনেককে কোর্টের ভেতরেই কাঁদতে দেখেছি। করোনা আক্রান্ত হয়ে অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম যখন হবিগঞ্জ থেকে ঢাকার মুগদা হাসপাতালে ভর্তি হন, তখন থেকেই এক ধরনের টেনশন কাজ করছিল। মুগদা হাসপাতাল থেকে আশংকাজনক অবস্থায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে তাকে স্থানান্তরের সংবাদটি ছিল আমাদের কাছে খুবই আতংকের। করোনা আক্রান্ত হওয়ার মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে ৬ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ৯টার দিকে তিনি মারাই গেলেন। হবিগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতিতে নজরুল ইসলাম নামে বেশ কয়েকজন আইনজীবী রয়েছেন। তিনি ছিলেন দাঁড়িওয়ালা নজরুল ভাই। সবার কাছে এই নামেই পরিচিত। একজন সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে রাসুল (সাঃ) এর সুন্নত পালনে তার জুড়ি ছিল না। সুন্নতী দাঁড়ি রাখা, টাকনুর উপরে প্যান্ট পরা, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতে পড়ায় অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম ছিলেন সর্বাগ্রে। রাতের প্রথমভাগে তিনি ঘুমাতেন। উঠতেন ফজরের নামাজের আগে। বাসায় তাহাজ্জুত পড়ে ফজর নামাজ পড়তেন মসজিদে গিয়ে। এসব রাসুল (সা.) এর অন্যতম সুন্নত ছিল। কোর্টে আসার সময় হালকা খাবার ও পানি নিয়ে আসতেন ব্যাগে করে। বাহিরের কিছু তেমন খেতেন না। অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম খুঁজে খুঁজে আত্মীয় বের করতেন। অনেক দূরের আত্মীয় তার কাছে অনেক কাছের, ঘনিষ্ট। আত্মীয়ের হক আদায় করা তার কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বর্তমান যোগে আত্মীয় স্বজন থেকে দুরে থাকা যেখানে কালচারে পরিণত হয়েছে সেখানে এই একটি সুন্নত পালনে তিনি ছিলেন ব্যতিব্যস্ত। আত্মীয়দের কে কোন জায়গায় কিভাবে আছে তা নিয়মিতই বর্ণনা করতে আমাদের কাছে। সদা হাস্যোজ্জল ও ফুর্তিবাজ মানুষ ছিলেন তিনি। যেখানে যেতেন, বসতেন, সবাইকে একটা আনন্দের মাঝে ডুবিয়ে রাখতেন। ফুল ও আতর ছিল তার কাছে অধিক জনপ্রিয়। বাসা থেকে নিজের লাগানো গাছের বিভিন্ন ফুল সাথে করে কোর্টে নিয়ে আসতেন নজরুল ভাই। ফুলের পাপড়ি বিলাতেন আমাদের মাঝে। মজা করে বলতেন, আমাকে ফুল মিয়াও ডাকতে পারো তোমরা। উন্নত মানের আতর ব্যবহার করতেন তিনি। নিত্যসঙ্গী ছিল আতর। কোর্টে নিয়ে আসতেন। আমাদের সহকর্মীরা তার কাছ থেকে আতর পায়নি, এমন সংখ্যা খুব কম। আতর দেয়ার সময় বলতেন, আমাকে আতর আলী ডাকবে না? তিনি ফুল ও আতর ভালবাসতেন এই জন্য যে, রাসুল (সাঃ) ফুল ও আতর ভালবাসতেন। অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম আল্লাহর ঘরের মেহমানদের এতো বেশি সম্মান ও স্নেহ করতেন, সাধারণত তা দেখা যায় না।
২০১৫ সালে আমি পবিত্র ওমরা হজ্বে যাব শুনেই তিনি একটি দাবি রাখলেন। বাসায় গিয়ে দাওয়াত খেতে হবে। আমি অবাক হলাম। এমনিতেই আমরা খুব ঘনিষ্ট, তবে বাসায় দাওয়াত খাওয়ার মতো সম্পর্ক ছিল না নজরুল ভাইর সাথে। স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে গেলাম দাওয়াত খেতে। আমাদের জন্য এতো বেশি খাবারের আইটেম তৈরী করলেন, দেখে আমরা অবাক। বারবার বললেন, তুমি আল্লাহর ঘরের মেহমান হতে যাচ্ছ, তোমার খুশিতে আল্লাহ ও রাসুল (সা.) খুশি হবেন। ক্বানায়ে ক্বাবায় ও রাসুল (সা.) এর রওজায় মোনাজাতের সময় যদি আমি নজরুল ইসলামের নামটি তোমার মুখ দিয়ে উচ্চারণ হয়ে যায়, তাহলেই হল। বিশ্বাস করুন, এই নামটি আমি ভুলতে পারিনি। কথা প্রসঙ্গে তিনি জানলেন- আমার স্ত্রী তার এক ভাগ্নীর ক্লাস ফ্রেন্ড। ব্যস, আমি তার ছোট ভাই, আমার স্ত্রী তার ভাগ্নী। এরপর থেকে এই সম্পর্কই বিদ্যমান ছিল। দেখা হলেই জানতে চাইতেন, ছোট ভাই ভাগ্নী কেমন আছে। আইনজীবী সমিতির সিনিয়রদের প্রতি তাঁর সম্মান ছিল চোখে পড়ার মতো। অ্যাডভোকেট আজিজুল বারী কামাল ছিলেন তার সিনিয়র। অ্যাডভোকেট আজিজুল বারী কামাল সাহেবকে তিনি এতো সমীহ করতেন, আজিজুল বারী কামাল সাহেব কোর্টে থাকলে প্রায় সময়ই অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম চেয়ারেই বসতেন না। অথচ অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলামও অনেক সিনিয়র। অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলামের এক ছেলে মেডিকেল কলেজে পড়ছে। আরেক ছেল স্কুলে পড়ছে। পরিবারের অন্য সদস্যদের প্রায় সবাই প্রবাসে। একটা সুখি ও সুন্দর পরিবার থেকে এক আল্লাহ ওয়ালা মানুষের বিদায়ে শোকে মূহ্যমান সবাই। অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলামের মৃত্যুতে আবারও প্রমাণিত হলো সমাজে, আত্মীয় স্বজনের মাঝে, কর্মক্ষেত্রে, পরিবারে সর্বত্র ভাল মানুষ হওয়ার প্রয়োজন আছে। যেটা তিনি দেখিয়ে গেলেন।

লেখকঃ আইনজীবী ও সংবাদকর্মী
হবিগঞ্জ ৬ সেপ্টেম্বর ২০২০
০১৭১১-৭৮২২৩২