ডা. মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহাব

সম্ভবত ১৯৬১ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার এ্যাগ্রিকালচার ডেভেলাপমেন্ট করপোরেশন তৈরি করে কৃষি বিপ্লবের সূচনায় মনোনিবেশ করে। বিচক্ষণ সামরিকজান্তা আইয়ূব খাঁন কৃষি বিপ্লবের উপযুক্ত ভূমি হিসেবে তখনকার পূর্ব পাকিস্তানকে টার্গেট করে হয়ত শোষণের এক মোক্ষম পন্থা হিসেবেই। ১৯৬৫ সালে জার্মানি থেকে লক্ষ লক্ষ রাস্টন ডিজেল পাওয়ার পাম্প মেশিন আমদানি করে সমগ্র বাংলাদেশে গতানুগতিক বোরো ধানের চাষাবাদ থেকে সরে এসে ইরি (ওজজও) ধান উৎপাদনে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে থাকে। ভাটি বাংলার এক ফসলা জমিতে দুই আড়াই গুণ বেশি ধান উৎপাদন হওয়ার কারণে কৃষকের ভাগ্য ফিরতে শুরু করে ক্রমশ। প্রায় অর্ধেক বা এক তৃতীয়াংশ পতিত জমি যা কেবল একসময় গো-চারণ ভূমিই ছিল তাও কৃষির আওতায় চলে আসে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৪, /৭৫ সাল পর্যন্ত কৃষক এবং গৃহস্থ পরিবারের আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। দু’এক বছর পর পর বন্যা, শিলাবৃষ্টি এসব প্রাকৃতিক দূর্যোগ হানা দিলেও কৃষকশ্রেণী তা গায়েই মাখেননি।
নদীমাতৃক বাংলাদেশের হাওর, বাওর, খাল-বিল সমৃদ্ধ ভাটি অঞ্চলের প্রতিটি গ্রামের চতুষ্পার্শ্বে হাজার হাজার একর জমি বিদ্যমান। এসব অঞ্চলে কৃষি নির্ভর গরু, মহিষ ছিল তখন ঘরে ঘরে। প্রতিটি গৃহস্থ ঘরে চার পাঁচটা গাভী সমেত বিশ-পঁচিশটা গরু বাছুর থাকা অতি স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। সুতরাং হাড়িতে খাঁটি দুধ, দই, মাঠা, সিঁকেয় ঘি, গোয়ালে গরু, গোলায় ধান, বিল, পুকুর, খালে বিলে মিঠা পানির সুস্বাদু অফুরন্ত ছোট, বড়, বৃহদাকার মাছ ছিল তখন ভাটি বাংলার ঐতিহ্য। বিরল ঘটনা বা দু’চারটে পরিবার ব্যতীত কোন গৃহস্থ পরিবারের দুধ, মাছ বা চাল কেনার প্রয়োজন পড়েছে আমার নজরে পড়েনি কখনো।
মাধ্যমিক শিক্ষালাভের উদ্দেশ্যে কৈশোরে উজান এলাকায় আসার পর ভাটি থেকে আসা বড় বড় মাছ বাজারে টুকরো টুকরো করে বিক্রির পসরা দেখে অবাক হতাম প্রথমে। প্রায় ঘরেই দুধ ছিল যেন এক দুষ্প্রাপ্য জিনিস। প্রায় পরিবারেই প্রতিদিন চাল এবং মাছ বাজারের প্রয়োজনীয়তার নৈমিত্তিক ঘটনাগুলো অবাক বিস্ময়ে অবলোকন করতাম। হিসেব কষে মাছের টুকরো রান্না এবং খাবারের ব্যাপারগুলোও আমায় প্রথম প্রথম ভীষণ ভাবিয়ে তুলত উৎসুক কিশোর মনকে।
শিক্ষাদীক্ষা এবং যোগাযোগ ব্যবস্থায় পিছিয়ে পড়া ভাটি অঞ্চল সমসাময়িক দৃষ্টিকোণ থেকে আঁড়চোখের আওতায় থাকলেও সুখ, শান্তি এবং প্রাচুর্যের বিবেচনায় ছিল তখন সর্বজন গৃহিত। কৃষি বিপ্লবের ভাটার কারণে আজ অনেকটা ভাটা পড়লেও অতিথিপরায়ণতায় এখনো কৃষিপ্রধান ভাটি অঞ্চল প্রশংসার দাবি রাখে। সুখি সমৃদ্ধ মানুগুলো বিস্তৃত মাঠ আর খোলা আকাশের মতই ছিল সহজ সরল এবং উদার মনমানসিকতা সম্পন্ন।
আজ হয়তো সব ভাটা পড়েছে। কৃষকগোষ্ঠী শতকরা আশিভাগ থেকে ষাট এ নেমে এসেছে। তবু এখনো সিংহভাগ কর্মসংস্থান, অর্থনীতির জিডিপিতে অবদান, প্রায় বিশ কোটি মানুষের খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা কৃষিরই দখলে নয় কি?
আমদানিকৃত বস্তাপঁচা চালে খাদ্যের ঘাটতি পূরণ হয়ত কিছুটা সম্ভব, কিন্তু পাতে সুস্বাদু ও সুগন্ধিযুক্ত ঐতিহ্যবাহী বিন্নি, কালোবিন্নি, চিনিগুড়া, চিনিআতপ, কালিজিরা, কাটারিভোগ, মদনভোগ, বাদশাভোগ, বাঁশফুল, পশুশাইল চালের ভাতে টানাপোড়ন দেখা দিবে নিশ্চিত। কালেভদ্রে কিছু পাওয়া গেলেও কখনো তা মধ্যবিত্তের নাগালের ভিতরে থাকবে বলে মনে হয় না।
তাই আবারো বলছিলাম, এসকল ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে হলে ম্রিয়মাণ কৃষকশ্রেণী এবং গৃহস্থ পরিবারকে ধরে রাখতে হবে। এদেরকে নিয়ে ভাবতে হবে শিক্ষিত, সুশীল, বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিকমহল সহ সিংহাসনে সমাসীন খোদ সরকারকেই। তাহলেই বাঁচবে কৃষক, বাঁচবে আমার আপনার সেই বাংলাদেশ, এই বাংলাদেশ।

চলবে…
ডা. মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহাব
এমবিবিএস; এফসিপিএস
প্রাক্তন সিনিয়র কনসালটেন্ট
জাতীয় সংসদ সচিবালয়, ঢাকা।