মঈন উদ্দিন আহমেদ ॥ বাংলাদেশে রয়েছে নানা ধর্ম বর্ণের লোকজনের বসবাস। রয়েছে তাদের আলাদা আলাদা উৎসব অনুষ্ঠান। তার পরও বাঙালি জাতি ধর্মের ব্যবধান ডিঙ্গিয়ে সবাই মিলে মিশে একত্রে পালন করে উৎসব অনুষ্ঠান। ফলে উৎসবগুলো হয়ে উঠে প্রাণবন্তÍ। এ ধারা শত শত বছর ধরে চলে আসছে।
বাঙালির উৎসবে দলিত ও সংখ্যালঘুদের অবদান প্রসঙ্গে নবীগঞ্জ উপজেলা হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি নারায়ন রায় বলেন, বাঙালির উৎসব প্রিয়তা ঐতিহাসিক। জীবনকে আনন্দমুখর রাখতে এই জাতির যাবতীয় আয়োজন কখনও কখনও বাহুল্যের সীমাকেও অতিক্রম করে যায়। তবুও তাকে এ থেকে বিরত রাখা যায়নি কখনও। প্রত্যেক জাতির আত্মপরিচয়ের মূলে থাকে সেই জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব উৎসব। ধর্মীয় বিভাজনের আগে বাঙালি সমাজ প্রায় একই ভাবধারা ও জীবনাচারে অভ্যস্ত ছিল। ঋতুভিত্তিক বা ধর্মীয় পালা-পার্বণ সংশ্লিষ্ট মেলা, বিনোদন, সন্ধ্যায় পুঁথিপাঠ, কীর্তন ইত্যাদি অনুষ্ঠান হতো। এ ছাড়া বছরের বিশেষ সময় পৌষে গো-অর্চনা, পিঠা উৎসব, ভাদ্রে নৌকাবাইচ, বৈশাখে বৈশাখী ও ফল উৎসব, পৌষ সংক্রান্তি, দুল পূর্ণিমাসহ বিভিন্ন ধর্মীয় মেলা ও উৎসবে সাজ-সজ্জা বাঙালি উৎসবের প্রাচীন ঐতিহ্য বহন করে। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় শিল্পবিকাশ ও আধুনিক যুগে এসে আমাদের বাঙালি উৎসব অনেকটা কোনঠাসা হয়ে পড়েছে। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই, তার পরও ওই সকল উৎসব সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কল্যাণে এবং তাদের অংশগ্রহণে দিন দিন বিকশিত হচ্ছে। উৎসব কেন্দ্রিক তারা বাঁশ-বেত, চামড়া, কাঁদা মাটিসহ নানা উপকরণ ব্যবহার করে পণ্যসামগ্রী তৈরী করে থাকে। আর গান-বাজনাতো টিকেই রয়েছে তাদের হাত ধরে। এখনো বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠানে গান-বাজনা বিশেষ করে বাদ্যযন্ত্র বাজাতে যাদের দেখা যায় তাদের প্রায় সকলেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। বাঙালির উৎসব টিকিয়ে রাখতে হলে প্রথমেই সংখ্যালঘুদের কাজের স্বীকৃতি প্রয়োজন। প্রয়োজন পৃষ্ঠপোষকতারও। পৃষ্ঠপোষকতা পেলে তারা বাঙালি উৎসব পৌষ মেলা, চৈত্র সংক্রান্তি মেলা, বাংলা নববর্ষসহ অন্যান্য উৎসবের মূল অনুসঙ্গ মাটির টেপা পুতুল, হাড়ি-পাতিল, বিভিন্ন ফুল পাখি, দেব-দেবীর মূর্তি, খই-নাড়– বিশেষ করে মাটির তৈরী আসবাবপত্র তৈরীতে আরো বেশি উৎসাহিত হবে।
মূল ধারার জনগোষ্ঠীর সাথে অবস্থার পার্থক্য সম্পর্কে তিনি বলেন, আধুনিক শিল্পযুগে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের তৈরী জিনিসপত্রের সঠিক মূল্য না পাওয়ায় তারা দিন দিন এ পেশা থেকে সরে যাচ্ছে। পরিবার পরিজন নিয়ে বাঁচার তাগিদে অনেকেই বিকল্প অন্য পেশায় জড়িয়ে গেছেন। তার পরও অনেকে পৈত্রিক পেশা হিসেবে এ পেশাকে আকড়ে ধরে রেখেছেন। আমাদের উচিত তাদের কাজের স্বীকৃতি, সম্মান ও সঠিক মূল্যায়ন করা। তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা।
হবিগঞ্জ জেলা পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান মোঃ নুরুল আমিন ওসমান বলেন, বাঙালি উৎসবে ধর্মীয় উৎসব ছাড়াও বহু উৎসব রয়েছে যাতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের যথেষ্ট অবদান রয়েছে। যেমন- পহেলা বৈশাখ। এই অনুষ্ঠানটি যদিও বাঙালি চেতনার অনুভূতি কিন্তু এটি শুরুতে সংখ্যালঘুরাই পালন করতো। পরবর্তীতে তা সার্বজনীনে রূপ নেয়। তাছাড়া নবান্ন উৎসব এটিও সংখ্যালঘুরাই প্রথম পালন করতো। এছাড়াও পৌষ সংক্রান্তি, চৈত্র সংক্রান্তি এগুলো ধর্মীয় অনুষ্ঠান হলেও বর্তমানে তা সার্বজনীন রূপ লাভ করেছে। অপরদিকে চা বাগানের শ্রমিকরা হুলি উৎসব ও বিভিন্ন পূজা পালন করে থাকে। এগুলো পালনের মাধ্যমে এবং পরিসর বৃদ্ধি করায় এগুলোও সার্বজনীন রূপ লাভ করেছে। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের দুর্গাপূজা, সরস্বতী পূজা এগুলো এখন আর সংখ্যালঘুদের একক অনুষ্ঠান হিসেবে বিবেচিত হয় না। এগুলোতে দুটি অংশ থাকে- একটি ধর্মীয় আর অপরটি উৎসব। ধর্মীয় অংশে সংখ্যালঘুরা তাদের মতো করে পূজার্চ্চনা করলেও উৎসবের অংশে ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই আনন্দ উল্লাস করতে দেখা যায়। একটি সময় ছিল যখন এদেশে ঘটা করে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান হতো না। এটি এখন জাতীয় উৎসবে রূপ নিয়েছে। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই উৎসবে যোগদান করে থাকে এবং এর পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে শাড়ি কাপড়, প্রসাধনী সামগ্রীর দোকানে যে পরিমাণ ভিড় দেখা যায় তাতে বুঝা যায় বাঙালির চরিত্রে এই অনুষ্ঠান কতটা প্রভাব রাখতে সক্ষম। হবিগঞ্জের চা বাগানগুলোতে পাঁচ দিনব্যাপি হুলি উৎসব যাকে তারা লাল পূজা বলে থাকে। তাতেও বহু লোকজনের সমাগম হয়। আসলে বার মাসে তের পার্বণ বলে যে কথাটি প্রচলিত তা আমাদের দেশে দৃশ্যমান এবং এর ব্যাপকতা দেশ ছাড়িয়ে বিদেশে অবস্থানরত বাঙালিদের মধ্যেও তার প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। বাঙালি এমনিতেই উৎসব প্রিয় জাতি। এই উৎসব সকলের মধ্যে একটি সেতু বন্ধন তৈরী করে এবং এই উৎসব পালনের ফলে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প অনেকাংশে কমে আসে। এই ধর্মীয় উৎসবগুলো এবং অন্যান্য উৎসব আমাদেরকে সবাই মিলে লালন করা উচিত। যাতে এই উৎসব পালনের মধ্য দিয়ে সকলে মিলে আমরা সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী শক্তি তৈরী করতে পারি। আমরা আশা করব ভবিষ্যতে সংখ্যালঘু বা সংখ্যাগুরু যাদেরই উৎসব হোক না কেন আমরা যেন সবাই তা মিলে মিশে পালন করতে পারি। যার মাধ্যমে সম্প্রীতির বন্ধন আরও দৃঢ় হবে।
তিনি আরো বলেন, বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তির উত্তরণে বিদেশি সংস্কৃতির ওপর আমাদের নতুন প্রজন্মের প্রবল আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। ফলে বাঙালি জাতি নিজস্ব উৎসবের ধারা থেকে অনেকটা বিচ্যুত হয়ে পড়েছে। আমাদের রক্তের ধারায় মিশে থাকা অনেক বাঙালি উৎসব আজ আমাদের মধ্য থেকে হারিয়ে গেছে। আমাদের নতুন প্রজন্মকে তাদের নিজস্ব উৎসক অনুষ্ঠানের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। তাদেরকে বুঝাতে হবে নিজস্ব উৎসক অনুষ্ঠানের মাঝেই রয়েছে নিজের আত্মপরিচয়।