দিনরাত পরিশ্রম করে, নিজের প্র্যাক্টিস বাদ দিয়ে, আরাম আয়েশ পরিহার করে, সকল অর্থ ব্যয় করে ১৮৪০ সালে টিকা আবিষ্কারে সফল হলেন মহামানব এডওয়ার্ড জেনার। কথিত আছে এডওয়ার্ড জেনার যখন রাষ্ট্রীয় পুরস্কারে ভূষিত হলেন তখন ঐ মহিলা ফারাহ নেলমকে পুরস্কারে অংশীদারত্বের জন্য বহু খোঁজাখুজির পরও তাঁকে আর পেলেন না। এতে গুটি বসন্তের টিকা আবিস্কারের জনক এডওয়ার্ড জেনার মানসিকভবাবে দারুণ কষ্ট পেয়েছিলেন। গুটি বসন্তের শীতলা দেবী বা ভেরিওলা ভাইরাস আজ কড়া নিরাপত্তায় দুই পরাশক্তির হাতে বোতলে বন্দী। স্যালুট এডওয়ার্ড জেনার।

ডা. মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহাব

নবসনা গ্রামের সূত্রে ১৯৪৭ এর রায়টের পরও আমার গ্রামে হিন্দু-মুসলিম ছিল সমান সমান। গ্রামের হিন্দু-মুসলিম সকল মুরুব্বিদের সাথে দাদার সুসম্পর্ক ছিল। এ সুবাদে দাদার একমাত্র আদুরে নাতি হিসেবে সবাই আমাকেও অনেক আদর করতেন। সত্যি কথা কি তখনকার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পরাকাষ্ঠায় এবং আন্তরিকতায় হিন্দু-মুসলিম ভিন্নভাবে বিচার করার সুযোগ হয়ে উঠেনি আমার যেমন করে একান্নবর্তী পরিবারের ধাঁচে বড় হওয়ায় সার্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আজও পিছু হঠতে পারিনি। প্রথম ছ’বছরই হল জীবনকে গড়ে তোলার সুইচ পয়েন্ট। এ সময়ের চিন্তা চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গিই সারা জীবনকে বিশেষ এক ধারায় পরিচালিত করে। তাই পারিবারিক, পারিপার্শ্বিক ও সামাজিক শিক্ষা তখন থেকেই সারা জীবনের উপর প্রভাব বিস্তার করে চলে। সুতরাং জীবনের সূচনা লগ্নের এই অর্ধযুগই হচ্ছে স্বকীয় ব্যক্তিত্বের মূল ধারক।
এ সময়টাতে মা-বাবার চেয়ে দাদা-দাদির সাথেই সংস্পর্শটা বেশি ছিল, ফলে উনাদের নিকট থেকে অনেক কিছু শিখেছি। জীবনের শেষ লগ্নে দাদা অবসর জীবন কাটাতেন। উঠোনে বসে বসে বাঁশের বেতের বিভিন্ন সামগ্রী নিখুঁত হাতে তৈরি করতেন। গ্রামের হিন্দু-মুসলিম বয়স্কজন সারাদিন ভিড় জমাতেন নানাবিধ পরামর্শের জন্য। দুপুরে দাদাকে খুব একটা একা ভাত খেতে দেখতাম না। এ অভ্যাসটা আমিও যথারীতি আয়ত্ত করার চেষ্টা করেছি। যদিও দাদাকে আমি বেশিদিন পাইনি তথাপি উনার সততা, দায়িত্ববোধ, ব্যক্তিত্ব সবকিছু প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আমার উপর প্রভাব বিস্তার করেছে। দাদির সাথে আমার সান্নিধ্য ছিল অনেকদিনের। বলা চলে দাদির আঁচলই ছিল আমার নিরাপত্তার আচ্ছাদন। রাজ-রাণীর গল্প, ঠাকুরমার ঝুলি, খনার বচন, বিভিন্ন সময়ে গ্রামে বিভিন্ন মহামারিতে লোক বিয়োগের গল্প বহুবার শুনেছি। শুনেছি দাদার অনেক সাহসী বীরগাঁথা অনেকটা নকশীকাঁথার মাঠ বা সুজন বাদিয়ার ঘাঁটের গল্পের মতই। দাদি এসব বলতেন আর মাঝে মাঝে খিলখিলিয়ে হাসতেন। পরম সৌভাগ্য এই যে আমার চাকুরি লাভের পরও দাদি প্রায় আট ন’বছর বেঁচে ছিলেন। অফিস থেকে ফিরে দাদির সাথ একপাতে ভাত খেতাম প্রায় প্রত্যহ। মনে হত যেন আমার জন্য দাদি সারাদিন না খেয়ে বসে থাকতেন। দাদির নিকট থেকেই শোনা আমাদের গ্রামের পশ্চিম হাঁটির পনের-বিশ জন সুপুরুষ নাকি একবার কিছুদিনের জন্য ছন কাটাতে শ্রীমঙ্গলের এক পাহাড়ে গিয়েছিলেন। জ্বরে আক্রান্ত হয়ে বাড়ি এসে সাতদিনের ভিতরেই সুঠাম দেহী তেরজনই অজ্ঞান হয়ে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। পাহাড়ের গভীর জঙ্গলে নাকি ডাইনী থাকে যা মানুষ গভীর রাতে বাঘের চেয়েও বেশি ভয় পেত। তাই সারারাত আগুন জ্বালিয়ে বাঘ এবং ডাইনী এ দু’থেকেই রক্ষা পাওয়ার জন্য পালা করে পাহারা দিত। দাদি প্রায়ই এদের নাম স্মরণ করে গল্প করতেন ডাইনী তাদের উপর দিয়ে ডেইয়ে যাওয়ার ফলেই গ্রামের একটা কোনা সুপুরুষ শূন্য হয়ে গেল। এ গল্প তখনকার সময়ে সারা গ্রামের মানুষের মুখে মুখেই ছিল। আজ চিকিৎসা বিজ্ঞানের একটা বিশেষ পর্যায়ে এসে বুঝতে অসুবিধা হয়নি এ করুণ মৃত্যুর কারণ ছিল ফ্যালসিফেরাম ম্যালেরিয়া বা সেরিব্রাল ম্যালেরিয়া, যে কারণে রোগীরা সব অজ্ঞান হয়ে মৃত্যুবরণ করেছিল। মশা ডাইনী বা বাঘের মত আগুনকে ভয় পায়নি, তাই পাহারায় কোন কাজ হয়নি। সেরিব্রাল ম্যালেরিয়ায় একবার বানিয়াচং গ্রামে বৃটিশ পিরিয়ডে রোগ নিরুপনের পূর্বই প্রায় আঠার হাজার লোক মৃত্যুবরণ করেছিল।
টিকা আবিষ্কারের ফলে শীত ও গ্রীষ্মের সন্ধিক্ষণে বসন্তকালে তখন গুটি বসন্তের যে মহামারি দেখা দিত তা এখন সারা বিশ্ব থেকেই বিলুপ্ত। শুধুমাত্র ইউএসএ এবং রাশিয়ার দুটো জায়গায় অত্যন্ত নিরাপত্তার সাথে গুটি বসন্তের ভেরিওলা ভাইরাসকে সংরক্ষিত করে রাখা হয়েছে স্যাম্পুল হিসেবে। যে শীতলা দেবীর ভয়ে মানুষ দিনরাত আতঙ্কে কাটাত এই ভেরিওলা ভাইরাস আবিষ্কারের পিছনেও মজাদার অথচ দুঃখজনক কাহিনি রয়েছে। বৃটিশ ডাক্তার এডওয়ার্ড জেনার সারাবিশ্বে গুটি বসন্তে মৃত্যু মহামারি দেখে বিচলিত হয়ে পড়লেন। একদিন লক্ষ্য করলেন উনাকে দুগ্ধ সরবরাহকারী মহিলা ফারাহ্ নেলম এর হাতে কয়েকটি ফোস্কা। খুঁজে খুঁজে উনার বাড়িতে যেয়ে গাভীর দুধের বানের ফোস্কার সাথে তা পরখ করে নিখুঁতভাবে মিলালেন। গরুর শরীরেও কাউ পক্স বা গুটি বসন্ত হয়। অতঃপর এ ফোস্কা হতে তরল পদার্থ সংগ্রহ করে নিজেরই আত্মীয় আট বছরের যুবক জেমস ফিপকে ঝুঁকি নিতে রাজি করালেন এবং তাঁর শরীরের চামড়ায় তা ইনজেকশন বা পুশ করলেন। দেখলেন কিছুটা জ্বর হল, ফোস্কা পড়ল কিন্তু নবম দিনে ভাল হয়ে গেল। এভাবে বেশ কয়েকজন আক্রান্ত হলেন কিন্তু মারা গেলেন না। মোটামুটি একটা সাড়া পড়ে গেল। ইত্যবসরে ভদ্র মহিলা ডাক্তারের এ ঘনিষ্ঠতাকে সন্দেহ করে একেবারে নিখোঁজ হয়ে গেলেন। পরবর্তীতে এ পদ্ধতির কিছুটা পরিবর্তন করে দিনরাত পরিশ্রম করে, নিজের প্র্যাক্টিস বাদ দিয়ে, আরাম আয়েশ পরিহার করে, সকল অর্থ ব্যয় করে ১৮৪০ সালে টিকা আবিষ্কারে সফল হলেন মহামানব এডওয়ার্ড জেনার। কথিত আছে এডওয়ার্ড জেনার যখন রাষ্ট্রীয় পুরস্কারে ভূষিত হলেন তখন ঐ মহিলা ফারাহ নেলমকে পুরস্কারে অংশীদারত্বের জন্য বহু খোঁজাখুজির পরও তাঁকে আর পেলেন না। এতে গুটি বসন্তের টিকা আবিস্কারের জনক এডওয়ার্ড জেনার মানসিকভবাবে দারুণ কষ্ট পেয়েছিলেন। গুটি বসন্তের শীতলা দেবী বা ভেরিওলা ভাইরাস আজ কড়া নিরাপত্তায় দুই পরাশক্তির হাতে বোতলে বন্দী। স্যালুট এডওয়ার্ড জেনার।