॥ তাহমিনা বেগম গিনি ॥

‘হাই’ যাঃ জোশ লাগতাছে না তোরে, এক্কেবারে মাইরা দিছস’। পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখলাম উঠতি বয়সের কিছু বালিকার কথোপকথনের টুকরো অংশ। তাদের পোশাক-আশাক অঙ্গভঙ্গি সবকিছুর দিকে অবাক চোখে কিছুটা সময় তাকিয়ে রইলাম। স্থান-লাউয়াছড়া, শিক্ষা ভ্রমনের একটি বাস দাড়িয়ে আছে। বাংলিশ আলাপে সচকিত হলাম। তবে আলাপের ভাষা ছিল বেশি ইংরেজী। যেন বাংলায় কথা বলতেই চাচ্ছে না একদল ছেলে মেয়ে। তাদের পোশাকে আশাকে বাঙালিয়ানার বড্ড অভাব। হঠাৎ করে কানে এলো একজন ছেলে একটি মেয়েকে বলছে ‘দেখ, থার্টি ফোর-টুয়েন্টি ফোর, থার্টি ফাইভ। কি চিজ দেখছোস ?’ স্থান- বান্দরবন, নীলাচল। শব্দমালার অর্থ খুঁজতে যেয়ে দেখলাম, অনতিদূরে দাড়ানো সুন্দর একটি মেয়ের শারীরিক গঠনের পরিমাপ দিচ্ছে ছেলিটি তার মেয়ে বান্ধবীর কাছে। এবার দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম ‘তোমরা কোথা থেকে এসেছো, কি পড়ো ?’ ঢাকা থেকে এসেছে। ওরা সবাই ‘এ’ লেভেল পরীক্ষা দেবে। ছোটবেলা থেকে ওরা ইংরেজী শিক্ষাই পেয়েছে। এই দুটি ঘটনার অবতারণা এজন্য করলাম- আমাদের বাংলাভাষা এখন কেমন আছে ? ১৯৫২ সালে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে ঢাকার রাজপথ লাল হয়েছিল- এ ইতিহাস সবার জানা। রফিক, শফিক, জব্বার, সালাম, আমাদের অতি পরিচিত আপনজন। কারণ মাতৃভাষার জন্য পৃথিবীর ইতিহাসে তারাই প্রথম শহীদ। এখন আরো কিছু নাম যোগ হয়েছে শহীদের তালিকায়। অনেক আন্দোলন, সংগ্রাম, জেল জুলুমের পর উর্দ্দুর পাশাপাশি বাংলা রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি পায়। পৃথিবীতে চল্লিশ কোটি মানুষ বাংলায় কথা বলেন। বাংলা ভাষার স্থান ভাষার জগতে পঞ্চম। ২০১০ সালে একুশে ফেব্রুয়ারি আর্šÍজাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পায়। পৃথিবীর বহু দেশে এখন একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়। পৃথিবীর অনেক রাষ্ট্রে এখন স্থায়ীভাবে শহীদ মিনার আছে। বর্তমানে চেষ্টা চলছে বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে রুপান্তরিত করার। ৫২-এর ভাষা অন্দোলনের হাত ধরে বাংলাদেশে সব আন্দোলন হয়েছে এবং সফলতা লাভ করেছে। ‘৫৪, ‘৬৯ সর্বশেষ ’৭১। শহীদ মিনার বাঙালীর সব অন্দোলনের বাতিঘর। ভাষার নামে দেশের নাম পৃথিবীতে একটি মাত্র দেশ আছে- বাংলাদেশ। স্বাধীনতার ঊনপঞ্চাশ বছর পরও আমরা পারিনি সর্বত্র বাংলা চালু করতে। এখনো হাইকোর্ট থেকে রুল জারি হয় সর্বত্র বাংলা ব্যবহারের জন্য। বিদেশে কোথাও বেড়াতে গেলে বুঝে উঠতে পারিনা- এটা কি অফিস, স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়, না কোন দোকান বা শপিংমল ? একমাত্র কারণ তাদের মাতৃভাষায় সবকিছু লেখা থাকে। হাতে গোনা ইংরেজী লেখা দেখা যায়। বাংলাদেশে বাংলা ভাষার জায়গায় ইংরেজী ভাষা ব্যবহারই চোখে পড়ে। গজিয়ে উঠছে ইংরেজী স্কুল। কোন ভাষার বিপক্ষ নই আমরা। কিন্তু সর্বাগ্রে মাতৃভাষাকে গুরুত্ব দিতে হবে, লিখতে, পড়তে, জানতে হবে। বাংলাদেশের প্রায় কিন্টারগার্ডেন বিদ্যালয়গুলোতেও শুদ্ধ, প্রমিত বাংলা শিখানো হয় না। পারিবারিকভাবে শিশুরা আঞ্চলিক ভাষায় অভ্যস্থ হয়ে পড়ে। বর্তমান স্যাটেলাইট যুগে হাতে রিমোট কন্ট্রোল শিশুদের নানান ভাষায় অভ্যস্থ করে ফেলে। তার মাঝে হিন্দি প্রধান। কিন্তু সবচেয়ে দুঃখ পাই যখন বাংলাদেশের টিভি, মিডিয়ায়, নাটকে, উপস্থাপনায়, আলাপচারিতায়, টকশোতে ইংরেজী বাংলার সংমিশ্রন দেখি। বাংলাদেশের সম্মানিত সংসদে মাঝে মধ্যে বাংলা ভাষার যে ব্যবহার দেখি নিজেদেরই লজ্জা পেতে হয়। অথচ আমাদের জাতির পিতা জাতিসংঘে প্রথম ভাষন দিয়েছিলেন বাংলায় শুধুমাত্র আপন মাতৃভাষাকে বিশ্বের দরবারে পরিচিত এবং প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। একজন ভিনদেশী যদি ইংরেজীতে কথা বলেন, আলাপচারিতায় আমরা কেন তার সাথে বাংলায় কথা বলি না ? ইংরেজী না জানলেও চেষ্টা করি তার সাথে ভুল ইংরেজীতে কথা বলতে, কেন এই হীনমন্যতা আমাদের ? বাংলা ভাষার ‘মা’ শব্দটি পৃথিবীর মধুরতম শব্দ। শুধু বাঙালী বলে গর্ববোধ করলে চলবে না- ভাষায়, দেশপ্রেমে, পোষাকে কবে আমরা বাংলাদেশের বাঙালী হব ? পহেলা বৈশাখে আমাদের বাঙালী হবার নিরন্তন প্রচেষ্টা, কিন্তু পরের দিনই ভুলে যাই সবকিছু। এমন সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ভাষা শহীদদের সম্মান রাখতে হলে বাংলা ভাষাকে ভালোবাসতে হবে। কথনে, পঠনে, লিখনে, বচনে সর্বদা শুদ্ধ বাংলা ব্যবহার করতে হবে। তা যদি না পারি তাহলে কবি আব্দুল হাকিমের সেই বিখ্যাত পংক্তি বলতে হয় ঃ-

‘যে জন বঙ্গে জন্মে হিংসে বঙ্গবানী,
সে জন কাহার জন্ম নির্ণয় না জানি। ’

শেষ করছি একটি অনুরোধ করে- ‘যা ইচ্ছে কর সারাটা বছর মানা করছি না, শুধু বলব ভাষার মাসে মাম্মি বা মম না ডেকে মাকে বলুন ‘মা’।