॥ তাহমিনা বেগম গিনি ॥

এই বয়সে এসে নীরবে যখন একলা অনেক কথা ভাবি তখন অবাক হয়ে যাই। সত্তোর্ধ বয়সে মৃত্যুর কথা আসবেই। অনেকেই শুনলে বলেন এটা নিয়ে ভাবার কি আছে? আসলে জীবনকে যে যেমন ভাবে যাপন করতে পারেন। দীর্ঘ জীবন পেরিয়ে এসে যখন আল্লাহর ডাকের অপেক্ষায় থাকি তখনতো একবার হলেও ভাবতে হবে কি সামান নিয়ে দাঁড়াবো ¯্রষ্টার কাছে? প্রযুক্তির এই গরম যুগে এহেন পবিত্র বাক্য লেখা নেই ফেসবুকে। আমরা কি সবাই মানি, কিন্তু জানি। বর্তমান যুগে আমার কাছে সবচেয়ে অবাক লাগে মানুষ। কারণ কেন যেন মনে হয় মানুষের কত রকমের চেহারা, বৈশিষ্ট্য, ব্যক্তিত্ব। একজন ভাল মানুষ খুব খুঁজি। এজন্য আমি এখন বাচ্চাদের স্কুলে, কলেজে কোথাও কথা বললে বলি জিপিএ-৫ পাওয়ার দরকার নেই, একজন ভাল মানুষ হও তোমরা। এবার ছাত্রদের আন্দোলন ও দেখিয়ে দিল কত রকম মানুষ। যাদের জীবনেও ভাবিনি তারা এমন হতে পারে অথচ ভাবনার থেকে বেশী হয়েছে তারা। প্রতিদিন বিস্মিত হচ্ছি। আমাদের সময়তো এমন ছিল না। পরিবার, সমাজ, ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক, আমলা, পাড়া, প্রতিবেশী সব কেমন যেন বদলে গিয়েছে। মা, ছেলে, মেয়ের সম্পর্কও বদলে গিয়েছে। প্রায় পরিবারের সন্তানেরা এখন স্বাধীন। মা-বাবার কথা শুনতে চায় না। চাকুরীজীবি নারীরা অনেক স্বাধীন। তারা অনেক পরিবারে গুরুজন এমনকি স্বামীকেও মানতে চায় না। মনে হয় তাদের চলাফেরা অনেক ডেয়ারিং অথচ নারীর অর্থনৈতিক নিরাপত্তার উদ্দেশ্য কিন্তু সরকারের এমন ছিল না। মাদক, সন্ত্রাস, ছিনতাই, অপহরণ, চুরি, ডাকাতি, ধর্ষণ খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। এখন বড়রা ছোটদের সাথে কথা বলতে ভয় পায় অপমান যদি হতে হয় ? এমন শৈশব, কৈশোর, যৌবন, স্কুল, কলেজ, বিশ^বিদ্যালয়ে তো আমরা কাটাইনি। তবে এতো বদলালো কেন? লোভ, লালসা আমাদের সব কিছু বদলে দিয়েছে। জীবনের অনেক কিছু যখন ভাবি তখন বিষ্মিত হয়ে যাই। প্রায় বাসাগুলোতে এখন বড়দের কথা না হয় বাদই দিলাম, ছোট ছেলে মেয়েরাও রাত ১২টা/১টার আগে ঘুমায় না। এরা সকালের সূর্য দেখতে পায় না। ঘুম ভাঙ্গে ১১টা/১২টার পর। স্কুল থাকলে আলাদা কথা। এখনতো দেখি স্কুলেও যেতে চায় না, হয় কোচিং নয় বাসায় প্রাইভেট টিউটর। মা বাবারাও কেমন যেন নির্লিপ্ত। যার যার চাকুরীর রাস্তায় তারা বেরিয়ে যায়। এরা কি শৈশব কাটায়। কোথায় আমাদের সেই ছোটবেলা, বাবার গলার শব্দে ঘুম থেকে উঠে পড়া। যার যার বিছানা সুন্দর করে গোছানো, পড়াশোনা, মার হাতের নাস্তা সবাই একসাথে বসে খাওয়া, তারপর গোসল সেরে স্কুলের জন্য তৈরি হওয়া। তখনও মা ভাত খাইয়ে দিতেন। আমি প্রায়ই সরকারি স্কুলে পড়েছি, তাই স্কুলেই টিফিন দিত। মা-বাবারা কেউ যেতেন না স্কুলে। সেই ছোট্ট ক্লাস থেকে এখনতো মাকে রীতিমতো চাকুরী করতে হয় বাচ্চাদের স্কুলে আনা নেওয়ার জন্য। আসা যাওয়ার পথে আমরা স্কুল ড্রেসের উপর আলাদা খোলা একটা ওড়না দিয়ে পেচিয়ে নিতাম কেউ কেউ। তখনও ইভটিজাররা ছিল। কলেজ, স্কুল গেটে ছেলেদের ভীড় লেগে থাকতো, কিন্তু কখনো শুনিনাই অমুক মেয়ে অপহরণ কিংবা ধর্ষণের শিকার হয়েছে। কয় দশকে যুগটা কেমন বদলে গেল। তখনও গ্রামে বাল্য বিবাহ ছিল, পড়াশোনারও প্রচলন ছিল। আমরা তো মোবাইল, ট্যাব, ল্যাপটপ আরো কত কি প্রযুক্তি ছাড়াই চলেছি, কই কোনো কিছুতো থেমে থাকেনি। আমাদের সময় কোচিং সেন্টার, শিক্ষকদের কোচিং ব্যাচ কিছুই ছিল না, তাই বলেকি লেখপড়ার মানের কমতি ছিল? তখনও তো মেধাবীরা বৃত্তি নিয়ে বিদেশ যেতো পড়াশোনা করতে। কেউ ফিরতেন, কেউ ফিরতেন না। এমন বিদেশ যাওয়ার তো হিড়িক ছিল না। সিলেটের মানুষজন তখন সবচেয়ে বেশী বিদেশ যেত। রাস্তাঘাটে এত দুর্ঘটনা, ছিনতাই শুনতে পেতাম না। হতে পারে তখন মানুষ সাড়ে সাত কোটি ছিল। কিন্তু এখন মানুষ বাড়লেও তো রাস্তাঘাট, গাড়ী, বাস, ফ্লাইওভার, টানেল, মেট্রোরেল কত কিছু বেড়েছে। তবুও প্রতিদিন শুনবো রাস্তা-ঘাটে, বাসা-বাড়ী, খালে-বিলে, জঙ্গলে লাশ পড়ে আছে। শৈশব, কৈশোরে এগুলো শুনেছি বলে মনে হয় না। নৈতিক শিক্ষার সাথে সাথে স্কুলে গান, নাচ, সেলাই, রান্না, বির্তক, উপস্থিত বক্তৃতা, রচনা প্রতিযোগিতা, রবীন্দ্র, নজরুল জয়ন্তী, একুশে ফেব্রুয়ারী সব পালন করা হতো, শিক্ষা দেওয়া হতো। একটি পাড়ায় মুরুব্বিরা থাকতেন একটি বাবার ছেলে কিংবা একটি মেয়েকে শাসনের জন্য। সবাই কত যে আপন ছিল। ছেলে মেয়েরাও ছিল বিনয়ী, ভদ্র। রাস্তাঘাটে আমাদের সময় কোনো মেয়ে বিপদে পড়লে রাস্তাতেই অচেনা কোনো বড় ভাইয়ের কাছে নিশ্চিন্তে সাহায্য চাইতো। ছেলেটিও তাকে আপন বোনের মত বাড়ী পর্যন্ত পৌঁছে দিত। আসলে তখনকার সেই দিনগুলো কোথায় গেল? ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে পড়েছি। কোথাও শুনিনি র‌্যাগিং বা অন্য কিছু। ভালবাসা, প্রেম-প্রীতি তো থাকবেই। এটা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু এখন আমরা প্রযুক্তির চূড়ায় বসে মনুষত্ব্যকে কত নীচে নামিয়ে এনেছি। বৃদ্ধাশ্রমের কথা কোনদিন শুনিনি। আমি অনেক বাইরের বই পড়তাম। একদিন লেখক শংকরের একটি বইতে প্রথম পড়েছিলাম আমাদের সবকিছু ছিল মা। নানা, দাদা, মামা, চাচা সবার মাঝে কেমন সৌহার্দ্য ছিল। এখন ঘরে ঘরে বিবাদ। মা-বাবাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে ছেলে, ছেলের বউ। আত্মীয়তার মাঝে নেই সুসম্পর্ক। বউ সামান্য কথায় স্বামীকে ডির্ভোস দিচ্ছে। এখন নারীদের ডির্ভোসের হার সবচেয়ে বেশী। লোভ, হিংসা, খুন, সন্ত্রাস এখন কোনো ব্যাপারই না। পত্রিকার পাতায় দেখি একেক জনের ২৮০/৩০০টি বাড়ী, ফ্ল্যাট আর পরকীয়াতো আছেই। একটি এক বছরের বাচ্চা মেয়েও এখন নিরাপদ নয়। প্রযুক্তি আর কতদূর যাবে তখন কি হবে পৃথিবীর মানুষের? মাঝে মাঝেই ভাবি এ কোন জামানা চলছে?
একজন দার্শনিকের কথা মনে পড়ে গেল-
“প্রতিদিন পবিত্র ধর্মগ্রন্থ স্পর্শ করে আমরা এখন বিচারালয়ে সবচেয়ে বেশি মিথ্যে কথা বলি,
আর সবচেয়ে সত্যি কথা বলি শুড়িখানায় আকন্ঠ মদ পান করে।”