হবিগঞ্জের বিশিষ্টজনেরা বিদায়ী সেনা কর্মকর্তা কর্নেল মনিরের কৃতিত্বপূর্ণ জীবনালেখ্য অনুষ্ঠানে তুলে ধরেন
আতাউর রহমান কানন
১২ অক্টোবর ২০০৭, শুক্রবার। আজ ২৯ রোজা চলছে। আমি সারাদিন বাসাতেই ছিলাম। আসন্ন ঈদুলফিতর উপলক্ষ্যে গতকাল ঢাকা থেকে আমার স্ত্রী-পুত্র-কন্যা এসেছে। এসপি সাহেব তাদের আগমনেরই অপেক্ষায় ছিলেন। আজ তাঁর বাসায় ইফতারের আয়োজন করেছেন। সেখানে সেনা ইউনিটের সিও কর্নেল মনিরও সপরিবারে আমন্ত্রিত। সন্ধ্যার কিছুটা আগে এসপি সাহেবের বাসায় দাওয়াতে যাই। ইফতারের আয়োজন ব্যাপক হলেও পূর্ব অভিজ্ঞতায় এবার সব মেপে মেপে খেলাম। আমরা তিন পরিবার অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে সময় কাটাই। রাত সাড়ে ৮টায় এসপি ও তাঁর মিসেসকে ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় নিই।
১৪ অক্টোবর ২০০৭, রবিবার। এবার ৩০ রোজা পূর্ণ হওয়ার পর আজ ঈদুল ফিতর। সকাল থেকেই থেমে থেমে বৃষ্টি হতে থাকে। ৮টার দিকে বৃষ্টি বন্ধ হয়। হবিগঞ্জ কেন্দ্রীয় ঈদগাহে নামাজের সময় ছিল সকাল ৮টা। বৃষ্টির কারণে তা ১০ মিনিট পরে শুরু করা হয়। নামাজের পূর্বে জেলা প্রশাসক হিসেবে প্রথানুযায়ী জেলাবাসীদের ঈদের শুভেচ্ছা জানাই। নামাজ শেষে বাসায় ফিরে আসি। দুপুরে এসপিসহ জেলা কারাগারে গিয়ে বন্দিদের ঈদের শুভেচ্ছা জানাই ও তাদের খাবার দর্শন করি। সেখান থেকে পুলিশ লাইনে গিয়ে পুলিশ সদস্যদের সাথেও শুভেচ্ছা বিনিময় করে বাসায় ফিরে আসি।
রাতে ঈদ উপলক্ষ্যে আমার বাসভবনে বরাবরের ন্যায় জেলায় কর্মরত বেসামরিক-সামরিক অফিসারদের সপরিবারে ডিনারে আপ্যায়িত করি। ইউএনওগণও এ ডিনারে সপরিবারে অংশগ্রহণ করেন।
পরের দিন সিলেট বিভাগীয় কমিশনারের বাংলোতে জেলা প্রশাসকদের সপরিবারে ঈদের শুভেচ্ছামূলক ডিনারের আমন্ত্রণ ছিল। আমি সস্ত্রীক সন্ধে ৭টায় সেখানে পৌঁছি। শুভেচ্ছা বিনিময় ও ডিনার শেষে রাত ১১টায় বাসায় ফিরে আসি।
১৬ অক্টোবর ২০০৭, মঙ্গলবার। ঈদের ছুটি শেষে আজ প্রথম অফিস। অফিসার-কর্মচারীগণ আমার সাথে প্রথমবেলা শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। সারাদিন ঢিলেঢালা অফিস চলে। সন্ধে ৭টায় হবিগঞ্জ প্রেসক্লাবে যাই। সেখানে আজ সেনা ইউনিটের সিও লে. কর্নেল মনিরুল ইসলাম আখন্দের বদলিজনিত সংবর্ধনা দেওয়া হয়। কর্নেল মনির এ জেলায় কর্মকালীন অনেক সমস্যা নিজ উদ্যোগে সমাধান করেছেন। তন্মধ্যে বিভক্ত হবিগঞ্জ প্রেসক্লাবের পুরানো বিবাদ মিটিয়ে একীভূতকরণ অন্যতম। তাঁর উদ্যোগে আমার উপস্থিতিতে কয়েক দফা জেলার সাংবাদিকদের নিয়ে মিটিং করে সমস্যাটি সমাধান করা হয়। সাংবাদিকগণ তাঁর অবদান মূল্যায়ন করেছেন এবং এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে তা অকাতরে স্বীকার করেছেন।
আজ সদর ইউএনও উম্মে সালমা তানজিয়ার বাসায় সপরিবারে ঈদোত্তর দাওয়াত থাকায় আমি প্রেসক্লাবের অনুষ্ঠান শেষে সেখানে যাই।
১৭ অক্টোবর ২০০৭, বুধবার। আমি সকালে যথারীতি অফিসে যাই। ঈদের ছুটি শেষে অফিস পুরোদমে শুরু হয়ে গেছে। আমার অফিসের ম্যাজিস্ট্রেটগণ তাঁদের কোর্ট-কাচারি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। আজ আমি পরপর ৭টি মাসিক রুটিন সভায় সভাপতিত্ব করি।
হবিগঞ্জবাসীর ব্যানারে আজ সন্ধ্যায় কর্নেল মনিরুল ইসলাম আখন্দকে বিদায়সংবর্ধনা জানানোর জন্য স্থানীয় কিবরিয়া মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। আমি সে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত হয়ে যোগদান করি। হবিগঞ্জের বিশিষ্টজনেরা উপস্থিত থাকেন। বিদায়ী সেনা কর্মকর্তা কর্নেল মনিরের বর্ণাঢ্য কৃতিত্বপূর্ণ জীবনালেখ্য অনুষ্ঠানে তুলে ধরা হয়। হবিগঞ্জবাসীর কাছে তিনি তাঁর কর্মের মাধ্যমে এক প্রশংসার পাত্র হয়ে ওঠেন। এ অনুষ্ঠান রাত ৯টায় শেষ হলে আমি বাসা হয়ে সপরিবারে ঈদোত্তর দাওয়াত রক্ষার্থে মাধবপুর উপজেলার সায়হামনগরে সৈয়দ ফয়সল সাহেবের বাসায় যাই। সেখানে মূলত ডিসি, এসপি ও বিদায়ী কর্নেল মনিরকে সপরিবারের দাওয়াত করা হয়েছে। ফয়সল সাহেব ও তাঁর পরিবারের সদস্যগণ আমাদের আন্তরিকভাবে আপ্যায়ন করেন। তাঁদের অতিথিপরায়নতার কথা ভোলবার মতো না। দাওয়াত খেয়ে বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত সাড়ে ১১টা বেজে যায়।
১৮ অক্টোবর ২০০৭, বৃহস্পতিবার। আজ সকাল ১০টায় আমার সহধর্মিণী পুত্র-কন্যাসহ ঢাকার উদ্দেশে রওনা করে। মেয়েটা যাওয়ার সময় প্রতিবারই টলটলে চোখে মন খারাপ করে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয় না। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে বিদায় জানিয়ে বললাম, স্কুল ছুটি হলেই আবার চলে আসবে। ঢাকা তো আর খুব বেশি দূরে না।
‘চাকরিস্থল আর সন্তানের লেখাপড়া’ ফ্যামিলি লাইফের এখন দ্বন্দ্ব হয়ে দেখা দিয়েছে। এ বিড়ম্বনা না মেনে নেওয়ারও তো কোনো উপায় নেই। ওরা চলে গেলে আমি অফিসে ফিরে সাড়ে ১১টায় হিন্দু কল্যাণ ট্রাস্টের চেক বিতরণ অনুষ্ঠানে যোগদান করি। এ কল্যাণ ট্রাস্টের ট্রাস্টি হবিগঞ্জের অন্যতম কৃতী সন্তান কণ্ঠশিল্পী সুবীর নন্দী এসেছেন। মূলত দুর্গাপূজা উপলক্ষ্যে পূজামন্ডপের জন্য এই চেক বিতরণ করা হয়। সুবীর নন্দী চলে গেলে আমি অফিসের কাজে মনোযোগী হই।
সন্ধে ৭টায় দুর্গাপূজার মন্ডপের স্থানসমূহ পরিদর্শনের জন্য বের হই। হবিগঞ্জ রামকৃষ্ণ মিশন, কালিগাছতলা, ঘাটিয়া কালীবাড়ী ইত্যাদি এলাকা ঘুরে রাত সাড়ে ৮টায় ফুড ভিলেজে যাই। সেখানে টেনিস ক্লাবের পক্ষ থেকে কর্নেল মনিরের বিদায় উপলক্ষ্যে ডিনার দেওয়া হয়। তিনি টেনিস ক্লাবের একজন নিয়মিত খেলোয়াড় ছিলেন। ডিনার শেষে রাত ১০টায় বাসায় ফিরে আসি।
১৯ অক্টোবর ২০০৭, শুক্রবার। ভাবছিলাম বন্ধের দিনটা আজ বাসাতেই কাটাব; কিন্তু কার্যতালিকায় আজও কর্মসূচি রয়েছে। সকাল ১০টায় হবিগঞ্জ রামকৃষ্ণ মিশনে কুমারী পূজা দেখতে যাই। আমার সঙ্গে এডিসি জ্যোতি লাল কুরী ও আমার স্টাফ অফিসার। এ পূজার আনুষ্ঠানিকতা দেখে মনে হলো, সারা হবিগঞ্জের লোক ভেঙে পড়েছে। ভিড় সামলাতে পুলিশকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। জীবন্ত সাত-আট বছরের কুমারী নারীকে দেবীর মতো সাজিয়ে মঞ্চে বসিয়ে তাকে পূজাঞ্জলি দেওয়ার নামই কুমারী পূজা। মিশনের অধ্যক্ষ একফাঁকে আমাকে জানালেন, এরচেয়ে বেশি বয়সী কুমারীর মন চঞ্চল হয়ে যায় বলে ভক্তকুলের পরিবার থেকে এদেরই বাছাই করা হয়।
আমি রামকৃষ্ণ মিশন থেকে সাড়ে ১১টায় বাসায় ফিরে আসি। আজ স্টাফ কোয়ার্টার মসজিদে গিয়ে জুমার নামাজ আদায় করি। আমি একসময় যখন হবিগঞ্জে ম্যাজিস্ট্রেট ছিলাম, তখন এই স্টাফ কোয়ার্টারের একটি বাসায় প্রায় ৫ বছর বাস করেছি এবং এই মসজিদেই নিয়মিত নামাজ পড়তাম। মসজিদটি পুনর্নির্মিত হয়ে আগের চেয়ে এখন উন্নত হয়েছে। আমি সে সময় শেষের দিকে কিছুদিন এই মসজিদের সেক্রেটারি ছিলাম। আমার বদলিজনিত বিদায়ের আগে আগে এই মসজিদ পুনর্নিমার্ণের জন্য ইট-বালি জোগাড় করে গিয়েছিলাম। এবার মসজিদটির পূর্ণাবয়ব দেখে আমার বেশ ভালো লাগল।
সন্ধে সাড়ে ৭টায় পুলিশ সুপারসহ হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জ যাই। সেখানে বিভিন্ন এলাকায় নির্মিত পূজামন্ডপ পরিদর্শন করি। এরপর হবিগঞ্জ শহরে ফিরেও বিভিন্ন পূজামন্ডপ দেখি। আমাদের পূজামন্ডপ দেখা মানে মন্ডপে মন্ডপে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত বাহিনীকে তদারক এবং সেই সঙ্গে পূজার দাওয়াতের সামাজিকতা রক্ষা করা। এদিন বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত ১২টা বেজে যায়। চলবে…
© স্বত্ব দৈনিক হবিগঞ্জের মুখ ২০১৯
ওয়েবসাইটটি তৈরী করেছে ThemesBazar.Com