পাঠকের কলাম…
পিয়ারা বেগম
রিফাত চুনারুঘাট উপজেলারা লালচান্দ চা বাগানের বাঙালি পাড়ার ছোট্ট এক শিশু, যার জীবন সংগ্রাম আর দুঃখে ভরা। বয়সে সে খুব ছোট, তবে তার কাঁধে যেন অনেক বড় দায়িত্বের বোঝা। রিফাতের বাবা-মায়ের মধ্যে বিচ্ছেদ হয়েছে, মা আবার বিয়ে করেছেন, আর বাবার ঠিকানা সে জানে না। এই ভাঙা পরিবারের জটিলতা তাকে জীবনের কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি করেছে।
রিফাত এখন তার নানুর কাছে থাকে। কিন্তু নানু বৃদ্ধ এবং অসুস্থ; তার পা ভেঙে গেছে, ফলে নানু আর আগের মতো চলাফেরা করতে পারেন না। রিফাতের খাবারের দায়িত্ব মাঝে মাঝে তার খালাই নেন। তবে জীবন এতটা সহজ নয়।
শিক্ষা তার কাছে একটি স্বপ্নের মতো। রিফাতের মা তার জন্ম নিবন্ধন করেননি। জন্ম নিবন্ধনের অভাবে সে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারছে না। এ যেন রিফাতের জন্য এক ধরনের বন্দিত্ব। সে মাঝে মাঝে স্কুলে গিয়ে অন্য শিশুদের মতো বসে থাকে, তাদের গানে অংশ নেয়। আশ্চর্যজনকভাবে, রিফাতের গানের গলা চমৎকার। এই গানের প্রতিভা তার একমাত্র আনন্দের উৎস।
একদিন জানা গেল, রিফাত বাগানের একটি শিখন স্কুলে ভর্তি হয়েছে। তবে এখানেও জন্ম নিবন্ধনের প্রশ্ন আসে। মায়ের অনুপস্থিতি ও বাবার কোনো খোঁজ না পাওয়ার কারণে তার জন্ম নিবন্ধন করতে পারছে না কেউ। এটি তার জীবনের সবচেয়ে বড় কষ্ট।
রিফাতের মাকে নিয়ে তার মনে প্রচুর কষ্ট রয়েছে। মা বিদেশে যায় আসে, প্রতিশ্রুতি দেয় যে তাকে সাইকেল কিনে দেবে, কিন্তু প্রতিশ্রুতি কখনোই পূরণ হয় না। প্রতিবার মা ফিরে আসলে তার মনে আশা জাগে, কিন্তু কিছুদিন পর মা আবার চলে যায় এবং রিফাতের আশা আবারও ভেঙে যায়।
রিফাতের এই সংগ্রাম যেন একটি গল্পের মতো শোনায়, যেখানে এক ছোট্ট বালক জীবনের কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজের পরিচয় খুঁজছে। তার জীবন অন্ধকারে ডুবে থাকলেও, তার গানের প্রতিভা যেন আলোর একটি ক্ষীণ ঝলক। সে যদি সঠিক সুযোগ পায়, তার প্রতিভা তাকে এক নতুন দিগন্তে নিয়ে যেতে পারে।
রিফাতের গল্প আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে সমাজে অনেক শিশু এখনও অবহেলার শিকার। তারা জন্মের সনদ বা মৌলিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। রিফাতের মতো শিশুদের জীবনের আলো ফিরিয়ে দিতে হলে আমাদের সমাজের সবস্তরের সহযোগিতা প্রয়োজন।
লেখক ঃ প্রধান শিক্ষক, লালচান্দ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, চুনারুঘাট, হবিগঞ্জ