চন্ডিছড়া চা বাগানে রাজকীয় খানাদানা আর গানের জলসা সবকিছুই ছিল উপভোগ্য

আতাউর রহমান কানন

২৬ মার্চ ২০০৭, সোমবার। আজ মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। অন্যান্য বছরের ন্যায় এবারও সূর্যোদয়ের সাথে সাথে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জেলার কেন্দ্রীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে দিবসটি উদ্যাপনের সূচনা করি। হবিগঞ্জ জালাল স্টেডিয়ামে জাতীয় এ দিবসটি আনুষ্ঠানিকভাবে পালনের জন্য বর্ণিল সাজসজ্জাসহ ব্যাপক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। আমি সকাল আটটায় জাতীয় সংগীতের তালে তালে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করি। এরপর মার্চপাস্টের জন্য মাঠে সারে সারে দাঁড়ানো পুলিশ, আনসার ও ভিডিপি, বিএনসিসি, মুক্তিযোদ্ধা, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের অবস্থান পুলিশ সুপারসহ সুসজ্জিত বাদক দলের বাদ্যের তালে তালে পরিদর্শন শেষে সালামি গ্রহণ মঞ্চে এসে দাঁড়াই। প্যারেড কমান্ডার মার্চপাস্টের অনুমতি নিয়ে বাদ্যের তালে তালে সকল অংশগ্রহণকারী দল নিয়ে একে একে সালামি মঞ্চ অতিক্রম করে যেতে থাকেন। প্রতিটি দলের দলপতি মঞ্চ অতিক্রমের সময় দক্ষতার সাথে স্যালুট দিতে থাকেন। আমি পুলিশ সুপারকে সঙ্গে নিয়ে যথারীতিতে তাদের সালামি গ্রহণ করি।
দর্শনার্থী দ্বারা স্টেডিয়াম পরিপূর্ণ। তেজোদীপ্ত সূর্যের ঝলকানি উপেক্ষা করেই দর্শক অনুষ্ঠান উপভোগ করে। মার্চপাস্ট শেষে এমনই এক পরিবেশে প্রথা অনুযায়ী হবিগঞ্জবাসীর উদ্দেশ্যে জেলা প্রশাসকের বাণীতে স্বাধীনতার তাৎপর্য উল্লেখসহ সকলের সুখসমৃদ্ধি কামনা করি।
এরপর শুরু হয় শিক্ষার্থীদের দলে দলে নানারকম মনোমুগ্ধকর শারীরিক কসরত। দর্শক প্রায় মধ্য চৈত্রের খরতাপ ভুলে অত্যন্ত আনন্দচিত্তে তা উপভোগ করেন।
এরপর অনুষ্ঠানের ধারাবাহিকতায় সকাল ১১টায় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জেলা প্রশাসকের সম্মেলনকক্ষে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। বিকেলে প্রীতি ফুটবল ম্যাচ এবং রাতে আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দিনটির উদযাপন শেষ হয়।
পাশাপাশি হবিগঞ্জ মহিলা ক্রীড়া সংস্থার পক্ষ থেকে হবিগঞ্জ মহিলা কলেজ মাঠে জেলার মহিলাদের নিয়ে খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। জেলা প্রশাসকের স্ত্রী পদাধিকার বলে মহিলা ক্রীড়া সংস্থার সভাপতি হওয়ায় তিনি তাঁর সংস্থার সদস্যদের নিয়ে ওই অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। আর জেলা প্রশাসক হিসেবে আমাকে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি করায় আমি সেখানে পুলিশ সুপারকে সাথে গিয়ে যথাসময়ে হাজির হই। অনুষ্ঠানের শেষাংশ উপভোগ করে পুরস্কার বিতরণ করি।
২৮ মার্চ ২০০৭, বুধবার। সকালে অফিসে গিয়ে এডিসিদের নিয়ে আমার অফিসকক্ষে বসি। আজ সাড়ে ১২টায় আমার অফিসে সেনাপ্রধান জেনারেল মঈন ইউ আহমেদ ভিজিটে আসবেন এবং তিনি জেলার সকল অফিস প্রধানদের নিয়ে এক মতবিনিময় সভায় মিলিত হবেন। আমার অফিসের সম্মেলনকক্ষে সভার আয়োজন করা হয়। আমি চেকলিস্ট ধরে সভার প্রস্তুতি পর্যালোচনা করি। সেনা ইউনিটের সিও কর্নেল মনির সকালে এসেই সম্মেলনকক্ষ পরিদর্শন করে নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা হিসেবে কক্ষটি তাঁদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে প্রহরা বসান।
আমি ও পুলিশ সুপার সেনাপ্রধানের আগমন মেসেজ পেয়ে ১২টায় জালাল স্টেডিয়ামে যাই। সোয়া ১২টায় সেনাপ্রধানের হেলিকপ্টার স্টেডিয়ামে নির্মিত অস্থায়ী হেলিপ্যাডে অবতরণ করে। সেনাপ্রধানকে রিসিভ করে আমার অফিসে নিয়ে আসি। তিনি অন্য কোথাও না বসে সরাসরি সম্মেলনকক্ষে প্রবেশ করেন। আমি তাঁকে হবিগঞ্জ জেলায় স্বাগত জানিয়ে বক্তব্য দেওয়ার পর তিনি সরাসরি বক্তব্য দেওয়া শুরু করেন। তিনি দীর্ঘক্ষণ দেশের বিভিন্ন প্রশাসনিক ব্যবস্থা ও আইনশৃঙ্খলা উন্নয়ন বিষয়ক বক্তব্য রাখেন। তিনি দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়ার জন্য সবাইকে একযুগে কাজ করার উপদেশ দিয়ে বলেন- ঞযব পড়ঁহঃৎু রং হড়ি ধং ষরশব ধং ধ ফবৎধরষবফ ঃৎধরহ. ঝড়, ঃযব ফবৎধরষবফ ঃৎধরহ ঃড় নব ংবঃ ঁঢ় ড়হ ৎধরষধিু ৎরমযঃষু. অর্থাৎ ‘দেশ এখন লাইনচ্যুত ট্রেনের মতো। তাই লাইনচ্যুত ট্রেনটিকে রেলপথে ঠিকভাবে স্থাপন করতে হবে।’
পিন্পতন নীরবতায় সকলেই মনোযোগ দিয়ে তাঁর উপদেশ ও দিকনির্দেশনা শোনেন। তিনি দেড়টায় মৌলভীবাজারের উদ্দেশে হবিগঞ্জ ত্যাগ করেন। তাঁকে বিদায় দিয়ে আমি বাসায় আসি। আজ ২টায় ঢাকা থেকে আমার সেজো ভাবি তার দুই কন্যা- পূর্নিয়া ও দ্যুতি এবং লন্ডন প্রবাসী পুত্র নিলিমকে নিয়ে বেড়াতে আসেন। তাঁদের নিয়ে লাঞ্চ সেরে অফিসে গিয়ে বিকেল ৩টা থেকে সাড়ে ৫টা পর্যন্ত প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক নিয়োগের মৌখিক পরীক্ষা গ্রহণ করি। সন্ধে ৬টায় বাসায় এসে পারিবারিক স্বজনদের সাথে সময় কাটাই। আপন লোকজন পেয়ে আমার অন্যরকম এক প্রশান্তিতে মন ভরে ওঠে।
২৯ মার্চ ২০০৭, বৃহস্পতিবার। সিলেট বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে আজ কয়েকটি নির্ধারিত মাসিক সভা থাকায় আমার বাসায় দেশের বাড়ির মেহমান থাকা সত্ত্বেও সকাল সাড়ে আটটায় সিলেটের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ি। সিলেটে সভাসমূহে অংশগ্রহণ শেষে বিকেল সাড়ে ৪টায় বাসায় ফিরে আসি। চুনারুঘাটের চন্ডীছড়া চা বাগানের ম্যানেজার আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের একই সাবজেক্টের অনুজপ্রতীম মোহাম্মদ শাহজাহান গতকাল আমাকে তাঁর বাগানে বেড়ানের জন্য আমন্ত্রণ করতে এসেছিল। আমি আর তাকে না করিনি। আমার সাথে জেলায় কর্মরত কর্নেল ও এসপিকেও ফ্যামিলিসহ দাওয়াত করতে বলে দিই।
আজ সন্ধ্যে সাড়ে ৬টায় আমার বাড়ি থেকে আসা মেহমান এবং কর্নেল-এসপির পরিবারবর্গ সহকারে চন্ডিছড়া চা বাগানে যাই। বাগান ম্যানেজার শাহজাহান, বাদশাহ শাহজাহানের মতোই এক রাজকীয় খানাদানার আয়োজন করে। সেইসাথে আবার গানের জলসা! সবকিছুই উপভোগ্য ছিল। জম্পেশ আয়োজনের জন্য শাহজাহানকে ধন্যবাদ দিয়ে রাত সাড়ে ১১টায় বাসায় ফিরে আসি।
৩১ মার্চ ২০০৭, শনিবার। সকাল ১০টায় ইসলামিক ফাউন্ডেশনে গিয়ে ইমামও গণশিক্ষার শিক্ষকদের প্রশিক্ষণে ক্লাশ নিই। সেখান থেকে সাড়ে ১১টায় ফিরে বাসভবনের অফিসে বসে কিছুক্ষণ ফাইলওয়ার্ক করি।
রাত আটটায় কোর্ট মসজিদে যাই। সেখানে এশার নামাজের পর ঈদ-এ-মিলাদুন্নবী উপলক্ষ্যে আয়োজিত ওয়াজ মাহফিলে যোগদান করি। জেলা প্রশাসক হিসেবে অনেক জায়গাতেই আমাকে যেতে হয়। মাহফিল শেষে রাত ১০টায় বাসায় ফিরে আসি।
ডিনার শেষে রাত জেগে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের সুপার এইটের বাংলাদেশ বনাম অস্ট্রেলিয়ার খেলা দেখি। খেলায় বাংলাদেশ ১০ উইকেটে হারে। আমার মনটা তখন বলে ওঠে- খেলাটা না দেখাই ভালো ছিল। তাতে ঘুম ভালো হতো।
১ এপ্রিল ২০০৭, রবিবার। আজ ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী উপলক্ষ্যে সরকারি ছুটি। সকাল সাড়ে ১১টায় হবিগঞ্জের সিনিয়র অ্যাডভোকেট আবুল খায়ের আসেন। তিনি জেলার চা বাগানসমূহের লিগ্যাল অ্যাডভাইজার এবং শহরের অন্যতম সম্মানীয় ব্যক্তি। তাঁকে প্রশাসনবান্ধব বললেও অত্যুক্তি হবে না। তাঁর ছোট বোন এবং নিজ কন্যাকে প্রশাসন ক্যাডারে পাত্রস্থ করেছেন। তিনি আমার সাথে কিছুক্ষণ সৌজন্য আলাপ করে চা খেয়ে চলে যান।
বিকেল ৩টা থেকে ৪টা পর্যন্ত ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক আয়োজিত ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করি। আমাদের দেশের সরকার এ দিনটি খুবই গুরুত্বের সঙ্গে পালন করে থাকে। এই দিনটি নিয়ে সবসময় আমার মনে প্রশ্ন জাগে- যে আরবজাহানে মুহম্মদ (সা.) জন্মেছিলেন, সেখানে এ দিবসটি কেন উদযাপন করা হয় না? আবার পরক্ষণেই ভাবি, আল্লাহর কিতাব-হাদিসের বাইরে আরবজাহানে তো কিছুই করে না, তবু তো বাংলাদেশে সেসব করা হয়। যেমন- শবেবরাত, শবেমেরাজ, মিলাদ মাহফিল, চেহলাম-চল্লিশা ইত্যাদি। যাক, এসব কর্মের প্রবর্তকগণই মহান আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করবেন। আর মহান আল্লাহ্ই এসব ক্ষেত্রের সর্বশ্রেষ্ঠ ফয়সালাকারী।