স্বামীর দাবি সুদখোরদের চাপ সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন শিক্ষিকা রিবন রূপা দাশ

সুদখোরদের চাপ যখন সহ্যের বাইরে চলে যায়, তখন রিবন রূপা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন। এ বিষয়টি নিয়ে স্বামীর সাথে রিবন রূপা দাশের মনোমালিন্য সৃষ্টি হয়। একদিকে সুদখোরের চাপ, অন্যদিকে বাসায় শান্তনার বদলে তিরস্কার সহ্য করতে পারছিলেন না তিনি। মৃত্যুর দুদিন আগে রিবন রূপা নিখোঁজ হলেও তার স্বামী থানায় কোন জিডি করেননি। এ বিষয়টি রিবন রূপার শুভাকাক্সক্ষীদের মধ্যে নানা প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে।

স্টাফ রিপোর্টার ॥ হবিগঞ্জের লাখাইয়ে হাওর থেকে দেশসেরা উদ্ভাবক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা রিবন রূপা দাশের মরদেহ উদ্ধারের ঘটনায় ৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। বুধবার বিকেলে নিহতের স্বামী লাখাই মুক্তিযোদ্ধা কলেজের শিক্ষক অজয় কুমার দাশ বাদি হয়ে লাখাই থানায় মামলাটি দায়ের করেন।
লাখাই থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. আবুল খায়ের বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেছেন, আত্মহত্যায় প্ররোচণার অভিযোগে মামলাটি দায়ের করা হয়েছে। বিষয়টি তদন্তাধিন রয়েছে। ওসি আরও বলেন, বাহ্যিক দিক থেকে আমরা ওই শিক্ষিকার শরীরের কোথাও কোন আঘাতের চিহ্ন পাইনি। বাদিও মামলার কোথাও হত্যা বলেননি। তিনি অভিযোগ করেছেন আত্মহত্যার প্ররোচণার। তার স্বামী আত্মীয় স্বজন সবাই ভালোভাবে দেখে লাশ বুঝে নিয়েছে। তারাও তখন কোথাও আঘাতের চিহ্ন পাননি।
মামলার বরাত দিয়ে ওসি বলেন, মামলায় বলা হয়েছে শিক্ষিকা রিবন রূপা দাশ এক ব্যক্তির কাছ থেকে সুদে কিছু টাকা নিয়েছিলেন। ওই টাকার জন্য তিনি প্রচন্ড চাপে ছিলেন। চাপ সহ্য করতে না পেরে মানসিক ও শারীরিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন। ফলে তিনি বিষপানে আত্মহত্যা করেছেন। আত্মহত্যার পূর্বে তিনি চিরকুটেও বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।
মামলায় তিন জনের নাম উল্লেখ করার কথা স্বীকার করলেও তদন্তের স্বার্থে ওসি তাদের কারো নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি।
তবে পুলিশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, রিবন রূপা দাশের চিরকুট অনুযায়ী মামলায় তিন জনকে আসামী করা হয়েছে। তারা হলেন- হবিগঞ্জ সদর উপজেলার রিচি গ্রামের বাসিন্দা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ সদর উপজেলা আহবায়ক ও যুবলীগ নেতা পিন্টু আচার্য্য, হবিগঞ্জ শহরের কামারপট্টি এলাকার বাসিন্দা যুবলীগ নেতা বিপ্লব রায় সুজন ও বাহুবল উপজেলার মিরপুরের বাসিন্দা সাংবাদিক অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য। অজ্ঞাত আরো কয়েকজন রয়েছেন।
এ ব্যাপারে নিহত রিবন রূপা দাশের স্বামী মামলার বাদি অজয় কুমার দাশের সাথে কথা বলতে চাইলে তিনি মানসিক অবস্থা ভালো নয় বলে আঘাতের চিহ্ন ছিল কি-না তা থানা বলতে পারবে বলে এড়িয়ে যান। তিনি সাংবাদিকদের সাথে কথা বলতেই আগ্রহী নন। এমনকি মামলা দায়েরের কথাও অস্বীকার করেন।
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, লাখাই উপজেলার ভবানীপুর গ্রামের বাসিন্দা কলেজ শিক্ষক অজয় কুমার দাশের স্ত্রী ভরপূর্ণি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষিকা রিবন রূপা দাশ (৪০) গত শুক্রবার নিখোঁজ হন। তিনি স্বামী সন্তান নিয়ে হবিগঞ্জ শহরের পুুরানমুন্সেফী এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় বসবাস করতেন। দুইদিন পর রোববার বিকেলে স্থানীয় ঝনঝনিয়া হাওরে একটি ব্রিজের নিকট থেকে বিষাক্রান্ত অবস্থায় তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। পরবর্তীতে তার মরদেহ হবিগঞ্জ আড়াইশ শয্যা জেলা সদর হাসপাতালের মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে সৎকার করা হয়। লাশ উদ্ধারের ৩ দিন পর বুধবার তার স্বামী বাদি হয়ে ৩ জনের নাম উল্লেখ করে লাখাই থানায় মামলাটি দায়ের করেন।
বিভিন্ন সূত্র জানায়, সুদখোরদের চাপ যখন সহ্যের বাইরে চলে যায়, তখন রিবন রূপা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন। এ বিষয়টি নিয়ে স্বামীর সাথে রিবন রূপা দাশের মনোমালিন্য সৃষ্টি হয়। বাসা থেকে নিখোঁজের সপ্তাহখানেক আগে থেকে তাদের বাসায় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়াঝাটি হচ্ছিল। যা প্রতিবেশীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এ বিষয়টিও এখন তার শুভাকাক্সক্ষীদের মধ্যে আলোচনা হচ্ছে। শুভাকাক্সক্ষীদের অনেকেই মন্তব্য করেন একদিকে সুদখোর চক্রের চাপ, অন্যদিকে বাসায় শান্তনার বদলে তিরস্কার সহ্য করতে পারছিলেন না রিবন রূপা দাশ। সুদখোর চক্রের চাপের মুখে স্বামী যদি পাশে দাঁড়াতেন তাহলে রিবন রূপা দাশকে হয়তো জীবন দিতে হতো না।
মৃত্যুর দুদিন আগে রিবন রূপা নিখোঁজ হলেও তার স্বামী থানায় কোন জিডি করেননি। এ বিষয়টিও রিবন রূপার শুভাকাক্সক্ষীদের মধ্যে নানা প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে।
উল্লেখ্য, রিবন রূপা দাস শিক্ষকতায় জাতীয় পর্যায়ে সেরা উদ্ভাবক হয়েছিলেন ২০২২ সালে। এর আগে ২০১৮ সালে হবিগঞ্জ জেলার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক নির্বাচিত হয়েছিলেন। লাখাই উপজেলার শ্রেষ্ঠ জয়িতা হন তিনি। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তর থেকে নির্বাচিত অ্যাম্বাসেডর শিক্ষকও ছিলেন তিনি।