শীতের মৌসুমে হবিগঞ্জে মাজারে মাজারে উরসের ধুম পড়ে যায়

আতাউর রহমান কানন

২১ ফেব্রুয়ারি ২০০৭, বুধবার। রাত ০০:০১ মিনিটে শহিদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে দিবসটি শুরু হয়। জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়ে খালি পায়ে শহিদ মিনারের বেদিতে গিয়ে সর্বাগ্রে পুষ্পস্তবক প্রদানের মাধ্যমে যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটির সূচনা করি। এরপর বিভিন্ন দপ্তর ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে দলে দলে একুশে ফেব্রুয়ারির গান “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি” গেয়ে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়। আজ সরকারি ছুটি। সারাদিন বাসাতেই থাকি। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় কালেক্টরেট ভবনের নিমতলা চত্বরে জেলা প্রশাসনের আয়োজিত আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগদান করি। শহরের বিশিষ্টজনেরা উপস্থিত থেকে আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। এরপর চলে একুশের কবিতা পাঠ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। দর্শকদের অনুরোধে আমিও স্বরচিত কবিতা ‘ফাগুন এসেছে’ আবৃত্তি করি।
পরদিন সকাল ৭টায় হবিগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে জেলা স্কাউটস সমাবেশে প্রধান অতিধি হিসেবে যোগদান করি। স্কাউটদের ঐতিহ্যবাহী সুশৃঙ্খল সমাবেশ ভোরের ফাল্গুনি মিঠে রোদের আবহে মনটাকে নাড়া দিয়ে যায়। স্বেচ্ছাসেবী এই সংগঠনের আদর্শ সমগ্রজাতি ধারণ করতে পারলে জাতির চেহারাটাই পাল্টে যেত। এ দিন বিকেলে জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের নেতৃবর্গের সাথে পূর্বনির্ধারিত একটি বিশেষ সভা করি। সেখানে তাঁরা কিছু দাবিদাওয়া উত্থাপন করেন। আমি আমার পক্ষ থেকে যথাসম্ভব দাবিগুলো বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নেওয়ার আশ্বাস দিয়ে সভা শেষ করি।
২৪ ফেব্রুয়ারি ২০০৭, শনিবার। সকাল সাড়ে ১১টায় বানিয়াচং উপজেলাধীন আলিগঞ্জ বাজারে যাই। সেখানে উপসচিব দাবিরুল ইসলামের বাসায় গিয়ে তাঁদের পারিবারিক অনুদানে গঠিত এক ফাউন্ডেশনের বৃত্তি প্রদান অনুষ্ঠানে যোগদান করি। দাবিরুল ইসলাম সাহেব আমার এক ব্যাচ সিনিয়র প্রশাসনের কর্মকর্তা। আমরা দুজনে লক্ষীপুর জেলার দুই উপজেলায় একই সময়ে উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলাম। তখন থেকেই আমাদের ঘনিষ্টতা। তাঁর বাড়ির আঙিনায় প্যান্ডেল টানিয়ে বৃত্তি প্রদান অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। উপজেলার কৃতী ও দরিদ্র শিক্ষার্থীদের মাঝে বার্ষিক বৃত্তির নগদ টাকা বিতরণ করা হয়। এ মহতী অতুল্য কাজ আমার বেশ ভালো লাগল। আয়োজক দাবিরুল ইসলাম ও ফাউন্ডেশনের অন্যান্যদের ধন্যবাদ জানিয়ে আমি বিকেল তিনটায় সেখান থেকে বিদায় নিই।
সন্ধে সাড়ে ৬টায় হবিগঞ্জের রামকৃষ্ণ মিশনের অনুষ্ঠানে যোগদান করি। জেলা প্রশাসক জেলার জনগণের সেবা ছাড়াও সকল ধর্মবর্ণের অনুষ্ঠানেরই আমন্ত্রণ রক্ষা করে থাকে। আমিও সে রীতির বাইরে না। রামকৃষ্ণ মিশনের অনুষ্ঠানে ঘণ্টা দুয়েক কাটিয়ে সাড়ে আটটায় বাসায় ফিরে আসি।
২৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৭, রবিবার। সকাল ৯টায় জালাল স্টেডিয়ামে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও তাদের সন্তানদের জন্য আয়োজিত বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা উদ্বোধন করি। সেখান থেকে রওনা হয়ে চুনারুঘাট উপজেলায় যাই। উপজেলা নির্বাহী অফিস ও থানা পরিদর্শন করি। চুনারুঘাট জামেয়া ইসলামিয়া মাদরাসার একাডেমিক ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করি। সেখান থেকে ১টায় সৈয়দ সঈদ উদ্দিন উচ্চবিদ্যালয়ে অস্থায়ীভাবে স্থাপিত লায়নস চক্ষু শিবির আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করি। ২টায় নিজ অফিসে ফিরে আড়াইটাতে জেলা সার ও বীজ মনিটরিং কমিটির সভায় যোগদান করি। জেলায় কোনো সার সঙ্কট নেই এবং সরকার নির্ধারিত মূল্যেই ডিলারগণ সার বিক্রি করছেন বলে সার ডিলার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোতাব্বির হোসেন জানান। ডিলারদের ধন্যবাদ দিয়ে সভা শেষ করে আবার জালাল স্টেডিয়ামে গিয়ে সকালে উদ্বোধনকৃত খেলার বাকি অংশ উপভোগ করি এবং বিজয়ীদের মধ্যে পুরস্কার বিতরণ করি। এখানে উল্লেখ্য, বিকেলে গিয়ে অন্যান্য প্রতিযোগীদের সঙ্গে আমি ডিসকাস থ্রো আইটেমে অংশ নিয়ে প্রথম স্থান অধিকার করি।
২৭ ফেব্রুয়ারি ২০০৭, মঙ্গলবার। সকাল সাড়ে ৯টায় হবিগঞ্জ সরকারি বালক বিদ্যালয়ের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা উদ্বোধন করে জেলা কারাগার পরিদর্শনে যাই। সেখান থেকে সাড়ে ১১টায় নিজ অফিসে ফিরে আসন্ন এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা ২০০৭ এর প্রস্তুতিমূলক সভায় যোগদান করি। বিকেলে ৩টায় হবিগঞ্জ বালক সরকারি বিদ্যালয়ের ক্রীড়া অনুষ্ঠানের সমাপনী অনুষ্ঠানে গিয়ে পুরস্কার বিতরণ শেষে ৪টায় জাতীয় শিশু পুরস্কার প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে যোগদান করি। শিশুদের অনুষ্ঠানে গিয়ে নিজেও শিশুদের সাথে মিশে যাই। তখন নষ্টালজিয়া কোথা থেকে যেন দৌড়ে নিজের ভেতর এসে লাফালাফি শুরু করে দেয়। শিশুদের নির্মল উচ্ছলতায় আমার দারুণ একটা সময় কেটে যায়! অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে সন্ধ্যা নেমে আসে। আমি সেখান থেকে একটা অন্যরকম প্রশান্তি নিয়ে বাসায় ফিরে আসি।
১ মার্চ ২০০৭, বৃহস্পতিবার। আজ বাইরে কোনো প্রোগ্রাম না থাকায় সারাদিন অফিসেই কাজকর্ম করি। এদিন বিকেলে ঢাকা থেকে আমার সহধর্মিণী ও কন্যা আমার কর্মস্থলে আসে। তারা এবার হবিগঞ্জে কদিন থাকবে এবং কয়েকটি সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগদান করবে।
পরদিন সন্ধ্যায় চুনারুঘাট উপজেলাধীন দেওন্দি চা বাগানের এমডি ওয়াহেদুল হকের আয়োজিত এক ডিনার অনুষ্ঠানে যোগদান করি। সেখানে জেলা প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, সেনা ইউনিটের সিও ও পুলিশ সুপারের পরিবারবৃন্দও আমন্ত্রিত ছিলেন। এছাড়া ঢাকা থেকে এমডি সাহেবের কয়েকজন আত্মীয় আসেন। অনুষ্ঠানে বারবিকিউসহ নানা ধরনের মজাদার খাদ্যের ব্যবস্থা ছিল। আর সেই সঙ্গে ছিল ঘরোয়া মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। আমার কন্যা লিসামণিও সে অনুষ্ঠানে একটি গান গেয়ে শোনায়। ফাল্গুনের মাঝামাঝি সময়ের মিঠে হিমেল রাতে মনকাড়া এমন অনুষ্ঠানে আনন্দের যেন শেষ ছিল না। আমাদের ফিরতে হবে তাই যেন ফেরা। সুন্দর সে পরিবেশ ছেড়ে বাসায় আসতে আসতে রাত ১১টা বেজে যায়।
৩ মার্চ ২০০৭, শনিবার। সকাল সোয়া ৭টায় সিলেটের উদ্দেশে সপরিবারে রওনা হয়ে সাড়ে ৮টায় সিলেট স্টেডিয়ামে পৌঁছি। সেখানে সরকারি কর্মচারী ও তাদের সন্তানদের বিভাগীয় বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। বিভাগীয় কমিশনার আজিজ হাসান প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত হয়ে ক্রীড়ানুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন। বিভাগের অধীনস্থ ৪ জেলার ডিসিরাই সেখানে স্বস্ব জেলা থেকে অংশগ্রহণকারী দলের নেতৃত্ব দিই। সারাদিন ক্রীড়া প্রতিযোগিতা চলে। সন্ধ্যার আগে পুরস্কার বিতরণের মাধ্যমে এবারের ক্রীড়া প্রতিযোগিতা শেষ হয়। পুরস্কারপ্রাপ্তি ও পয়েন্ট বিবেচনায় আমার দল হবিগঞ্জ চ্যাম্পিয়ন হয়। বিভাগীয় কমিশনার আমার হাতে চ্যাম্পিয়ন ট্রফি তুলে দেন। বিজয়ের আনন্দ নিয়ে সিলেট থেকে রওনা হয়ে রাত আটটায় হবিগঞ্জ ফিরে আসি।
শীতের মৌসুমে হবিগঞ্জে মাজারে মাজারে উরসের ধুম পড়ে যায়। মনে হয় প্রায় সব পিরই যেন শীতকালে পরলোকগমন করেছেন। উরস পালনকারীগণ জেলা প্রশাসকের কাছে নিয়ম রক্ষার অনুমতি ও আইনশৃঙ্খলার আবেদন করেন। এসব অনুষ্ঠান জায়েজ কি নাজায়েজ, যাই হোক না কেন, অনুমতি দিতেই হয়। আর অবস্থা বুঝে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও মোতায়েন করতে হয়। আবার সমাবেশের পরিস্থিতি বুঝে নিজেরও দেখভাল করতে যেতে হয়। দেশে মানুষের স্বেচ্ছাধর্ম পালনে বাঁধা দেওয়ার কোনো আইন নেই। কথিত পির দেওয়ান মাহবুব রাজার উরস অনুষ্ঠানের ব্যাপকতা বিবেচনা করে, ‘রথ দেখা আর কলা বেচা’র মতো আজ রাত ১০টায় উমেদনগরস্থ উক্ত পিরের মাজারে যাই। আমার সফরসঙ্গী হয়েছেন এসপি মান্নান ও সিও কর্নেল মনির। উরস উপলক্ষ্যে অনেকটা জায়গাজুড়ে জমজমাট মেলা বসে গেছে। বাদ্যবাজনা নিয়ে স্থানে স্থানে সুর-বেসুরে ভক্তিমুলক গানবাজনা চলছে। আর অনিয়ন্ত্রিত গঞ্জিকা সেবন তো আছেই। আমাদের আগমন সংবাদ পেয়ে মাজার কমিটির নেতৃবর্গ আমাদের নিয়ে মাজার সংলগ্ন একটি দালানের কক্ষে বসালেন। বাইরে বেশ কয়েক জায়গায় বড় বড় ডেগে রান্নাবান্না চলছিল। শুনলাম, সারা দিনরাতই নাকি উরসের সময় ভক্তদের দেওয়া গরু-খাসির রান্না চলতে থাকে। এসব দেওয়ার লোকের যেমন অভাব নেই, খাওয়ার লোকেরও তেমন অভাব নেই। আমরাও আজ খাওয়ার লোকের দলে পড়লাম। মাজারের প্রধান খাদেম আমাদের আটকিয়ে ধূমায়িত গরম ভাত আর বাটামশলায় রান্না করা গরুর মাংস দিয়ে আপ্যায়ন করালেন। রান্নার তারিফ না করে পারলাম না। আমি গরুর মাংস পারতপক্ষে খাই না। তবে লোভে পড়ে আজ কিছুটা খেলাম। আর আমার সঙ্গী দুজন কম বয়সী হওয়ায় রান্নার তারিফ করতে করতে ইচ্ছে মতোই খেলেন। এছাড়া আমাদের সঙ্গীয় জোয়ান সিকিউরিটি ফোর্সদের খানা খাওয়ার কথা আর নাই বা বললাম। মাজারের আইনশৃঙ্খলা ও কীর্তিকলাপ দেখে বাসায় ফিরতে রাত বারোটা বেজে যায়।