পাহাড়-বনভূমি ও সমতল-জলাভূমি নিয়ে গঠিত মাধবপুরে প্রাকৃতিক সম্পদের কোন ঘাটতি নেই ॥ রয়েছে গ্যাস ও কাচ বালু

আতাউর রহমান কানন

পরের দিন অফিস হয়ে সকাল ১১টায় স্টাফ অফিসারকে সাথে নিয়ে পূর্বনির্ধারিত সৌজন্য মতবিনিময় সভায় যোগদানের জন্য মাধবপুর উপজেলায় যাই। এ উপজেলায় আমাকে একরকম উষ্ণ সংবর্ধনা দেওয়া হয়। কারণ বলতে গেলে বলা যায় যে, আমি একসময় এ উপজেলার ইউএনও ছিলাম। সে সুবাদে এখানকার প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা আবেগের বশবর্তী হয়ে এমন আয়োজন করেছেন। পৌরসভার মেয়রসহ এগারো ইউনিয়নের সকল চেয়ারম্যান উপস্থিত ছিলেন। ইউএনও জিএসএম জাফরউল্লাহ’র সভাপতিত্বে সৌজন্য মতবিনিময় সভায় এলাকার কোনো সমস্যা তুলে না ধরে তাঁরা আমার প্রশংসা করেই বক্তব্য রাখেন। নিজের প্রশংসা শুনতে কার না ভালো লাগে? এক্ষেত্রে আমিও ব্যতিক্রম না। বক্তাদের প্রাণখোলা বাঁধহীন বক্তৃতা চলছে তো চলছেই।
আমি মাধবপুরের পটভূমি ও একনজরের তথ্যাবলিতে চোখ বুলিয়ে যাচ্ছিলাম। আমার জানা-অজানা অনেক তথ্যই সেখানে রয়েছে।
সোনাই নদীর তীরে সিলেট বিভাগের গেট হিসেবে অভিহিত মাধবপুর উপজেলাটি হবিগঞ্জের একটি জনবহুল উপজেলা। ১৮০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত মাধবপুর থানা ১৯৮৩ সালের ১ আগস্ট উপজেলায় উন্নীত হয়। এর নামকরণে জনশ্রুতি আছে যে, এখানে বসবাসকারী মহাদেব নামক একজন সাধকের নামানুসারে প্রথমে মহাদেবপুর এবং পরবর্তীতে মহাদেব থেকে মাধবপুর নাম ধারণ করেছে। এ উপজেলায় অনেক প্রখ্যাত ব্যক্তি জন্মগ্রহণ করেছেন, যা নিয়ে এলাকাবাসীর গর্বেরও শেষ নেই। এমনই ক’জন হলেন:-
১. আশরাফ উদ্দিন চৌধুরী, প্রাক্তন এম.এল.এ, আসাম পার্লামেন্ট;
২. নাসির উদ্দিন চৌধুরী, সাবেক মন্ত্রী (১৯৫৪-১৯৫৬);
৩. মাওলানা আছাদ আলী, সাবেক এম. এন. এ;
৪. কবি ও সাহিত্যিক রাম কুমার নন্দী মজুমদার;
৫. সাজিদুল বার চৌধুরী (এসবি চৌধুরী), সিএসপি, সাবেক সচিব;
৬. আমিনুল বার চৌধুরী (এবি চৌধুরী) সাবেক সচিব;
৭. ড. মোহাম্মদ ফরাস উদ্দিন (সিএসপি), সাবেক গভর্ণর, বাংলাদেশ ব্যাংক;
৮. মাহবুব উদ্দিন চৌধুরী রাজনীতিবিদ ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামী;
৯. অ্যাডভোকেট আবদুল হাই, আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ;
১০.অ্যাডভোকেট আবদুল মবিন, সাবেক বিচারপতি হাইকোর্ট ডিভিশন।
১১. জগলুল আহমেদ চৌধুরী, সাবেক প্রধান সম্পাদক ও এমডি, বাসস।
উপজেলাটি মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম পীঠস্থান। এখানের তেলিয়াপাড়া চা বাগানের বাংলোতে জেনারেল এম এ জি ওসমানীর নেতৃত্বে সেক্টর কমান্ডারদের সমন্বয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধের সাংগঠনিক কাঠামো সম্পর্কিত প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় এবং সমগ্র বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টর ও ৩টি ব্রিগেড ফোর্সে বিভক্ত করে শপথ গ্রহণের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা হয়।
এলাকায় বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:-
১. তেলিয়াপাড়া মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসৌধ: তেলিয়াপাড়া চা-বাগানের বাংলোর পূর্ব-দক্ষিণ কোণে নির্মাণ করা হয়েছে ২, ৩ ও ৪নং সেক্টরের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্মরণে তেলিয়াপাড়া স্মৃতিসৌধ। ১৯৭৫ সালের জুন মাসে এ স্মৃতিসৌধের উদ্বোধন করেন সেসময়ের সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল কে এম শফিউল্লাহ। বুলেটের আকৃতিতে তৈরি এই সৌধের সামনে দু’টি ফলকে অঙ্কিত রয়েছে কবি শামসুর রাহমানের বিখ্যাত কবিতা ‘স্বাধীনতা তুমি’। চা বাগানের সবুজ বেষ্টনীঘেরা স্মৃতিসৌধটির পাশে রয়েছে লাল শাপলা ফোটা একটি নজরকাড়া লেক।
২. সুরমা চা বাগান: বাগানটি দেশের অন্যতম বৃহৎ চা বাগান। এর ভেতর দিয়ে বয়ে চলা ছড়ার বালু বেশ মূল্যবান। কাচ ও সিরামিক শিল্পে ব্যবহৃত হয়।
৩. বাঘাসুরা রাজবাড়ি: বাঘাসুরা ইউনিয়নে অবস্থিত প্রাচীন এই রাজবাড়িটি অনেকেই দেখতে আসেন। ইট, সুরকি ও রড-কাঠের নির্মিত এই বাড়িটি এলাকার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের কথা বলে।
৪. আদাঐর জমিদার বাড়ি: আদাঐর ইউনিয়নে অবস্থিত ইট, সুরকি ও রড দ্বারা নির্মিত জরাজীর্ণ এই বাড়িটি মোগল আমলের সাক্ষী হয়ে এখনও দাঁড়িয়ে আছে।
৫. শাহ সোলায়মান ফতেহগাজী বোগদাদীর মাজার: মাধবপুরের শাহজীবাজারে অবস্থিত। কথিত আছে, এই আউলিয়া হযরত শাহ জালাল (র.) এর ৩৬০ জন সফরসঙ্গীর অন্যতম।
৬. ফ্রুটস ভ্যালী: মাধবপুর উপজেলার শাহজীবাজারস্থ হবিগঞ্জ গ্যাসফিল্ড এলাকায় অব্যবহৃত প্রায় ৫ একর টিলা শ্রেণি ভূমিতে গ্যাসফিল্ডের জনৈক ম্যানেজার এটিএম নাছিমুজ্জামান ২০০৩ সালে এই ফলের বাগান গড়ে তুলেন। এখানে দেশিবিদেশি প্রায় ২০০ প্রকার ফলের গাছ রয়েছে। রাবার ও চা বাগানে ঘেরা পাহাড়-টিলায় দৃষ্টিনন্দন ফ্রুটস ভ্যালির পরিচিতি দেশের বিভিন্ন জায়গার পর্যটকদের কাছে ছড়িয়ে পড়েছে। সারে সারে ফলের গাছ ছাড়াও ভ্যালিতে রয়েছে দেখার মতো প্যাভিলিয়ন, মিনি বাংলো, ফোয়ারা এবং একটি মিনি চিড়িয়াখানা। চিড়িয়াখানায় মনকাড়া ময়না, তোতা, ঘুঘু, দোয়েল, কোয়েল, মুনিয়াসহ ১৩ জাতের পাখি ও আট জাতের কবুতর রয়েছে।
৭. শাহজীবাজার বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র: ১৯৬৮ সালে দেশে প্রথম প্রাকৃতিক গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উপাদন কেন্দ্র স্থাপিত হয় মাধবপুর উপজেলার শাহজীবাজারে। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অধীন পাহাড়ে একটি দৃষ্টিনন্দন রেস্টহাউজ রয়েছে। কথিত আছে, তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি উদ্বোধনের জন্য আসার কথা থাকায় এটা নির্মাণ করা হয়েছিল।
হবিগঞ্জ জেলা সদর হতে ৪৯ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত মাধবপুর উপজেলার আয়তন ২৯৫ বর্গ কিলোমিটার। পাহাড়-বনভূমি ও সমতল-জলাভূমি নিয়ে গঠিত মাধবপুরে প্রাকৃতিক সম্পদের কোনো ঘাটতি নেই। এখানে রয়েছে প্রাকৃতিক গ্যাস ও কাচ বালু। এ উপজেলায় রয়েছে ৫টি চা-বাগান। বাগানগুলোর সৌন্দর্য্য যেকোনো পর্যটকের মন নিমিষেই কেড়ে নিতে সক্ষম।
উপজেলার প্রধান কৃষি ফসল ধান, পাট ও গোল আলু। এছাড়া এ এলাকার উৎপাদিত শাকসবজি সিলেট বিভাগের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় সরবরাহ হয়।
আজ সৌজন্য মতবিনিময় সভায় এসে আমার নস্টালজিয়া কাজ করল। পৌরসভার মেয়র আবু মুসলিম, আন্দিউড়ার চেয়ারম্যান অলিউর রহমান, ছাতিয়াইনের চেয়ারম্যান মিনহাজসহ প্রায় সকলেই আমার পূর্বপরিচিত এবং বেশ ঘনিষ্ঠ। তাঁদের আবেগঘন বক্তব্য শোনার পর আমি বক্তব্য রাখতে গিয়ে বেশ আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়ি।
প্রায় ঘণ্টাদুই মতবিনিময় সভা চলে। সভা শেষে আমি হেডকোয়ার্টারে ফিরে আসতে চাইলে ইউএনও পীড়াপীড়ি করে তাঁর বাসায় নিয়ে যান। আমি মাধবপুরের ইউএনও থাকাকালে বাসার যে ব্যাপক সংস্কার করেছিলাম, তার প্রশংসা করতেও তিনি ভুললেন না। এছাড়া বাসার দোতলার দক্ষিণের বড় বারান্দায় আমার মেয়ের জন্য সখের বশে যে দোলনা পেতেছিলাম, সে দোলনায় আমাকে বসিয়ে একটা ছবি তুলে তবেই ছাড়লেন। এ দোলনায় নাকি এখন ইউএনওর কন্যারা দোল খায় এবং এটি তাদের সকলের কাছেই খুব সমাদরের। উল্লেখ্য, আমি মাধবপুরে খুব একটা বেশি সময় ইউএনও থাকতে পারিনি। আমি যোগদানের কয়েক মাস পরেই কেয়ারটেকার সরকার আসে। আর সে সরকারের গণবদলির শিকার হয়ে বড়লেখা উপজেলায় চলে যাই।
বিকেলে অফিসে এসে দেখি অফিস মোটামুটি ফাঁকা। রোজার মাস হওয়ায় ভিজিটরও তেমন একটা নেই। আমি কিছুক্ষণ ফাইলপত্র দেখে বাসায় ফিরে এলাম।
১০ অক্টোবর ২০০৬, মঙ্গলবার। সকাল ৯টায় বাহুবল উপজেলায় যাই। সেখানে ইউএনও মো. মনিরুজ্জামান কর্তৃক আয়োজিত সৌজন্য মতবিনিময় সভায় যোগদান করি। (চলবে…)