দেশ স্বাধীনের পূর্বে দলিত জনগোষ্ঠীর ভোটাধিকার ছিল না। স্বাধীনতা উত্তর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাদেরকে ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ করে দেন। এখনো তারা কৃতজ্ঞচিত্তে বঙ্গবন্ধুর সেই অবদানের কথা স্মরণ করে
মঈন উদ্দিন আহমেদ ॥ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আদিবাসী জনগোষ্ঠী বিশেষ করে দলিত জনগোষ্ঠীর অবদান অবিস্মরণীয়। বাংলা নামে একটি স্বাধীন দেশের আত্মপ্রকাশের সংগ্রামে আদিবাসী জনগোষ্ঠী বা দলিত জনগোষ্ঠীর অবদান খাটো করে দেখার কোন সুযোগ নেই। বিশেষ করে হবিগঞ্জের দলিত জনগোষ্ঠীর অবদান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে দলিত জনগোষ্ঠীর অবদান সম্পর্কে শিক্ষা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত সহকারী প্রকৌশলী লাখাইর কৃতি সন্তান প্রদীপ কান্তি রায় বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে দলিত জনগোষ্ঠীর অবদান অপরিসীম। বাংলাদেশে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান নানা ধর্ম বর্ণ ও জাতি গোষ্ঠীর বসবাস। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যেকেরই কম বেশি অবদান রয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলার হিন্দু এলাকা হিসেবে পরিচিত কৃষ্ণপুর গ্রামের ১২৭ জন নিরীহ ব্যক্তিকে ব্রাশফায়ার করে নির্মমভাবে হত্যা করে পাকিস্থানী হানাদার বাহিনী। ওই দিন গ্রামের অনেক নারী হানাদার বাহিনী ও রাজাকারদের হাতে সম্ভ্রম হারান। হত্যাযজ্ঞের ৪৭ বছর পরও শহীদদের তালিকায় নিহতদের অনেকেরই নাম উঠেনি। আহত মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম নেই গুলি খেয়েও বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের। তবে কৃষ্ণপুর গ্রামে গণহত্যায় জড়িতদের দ্রুত বিচারের দাবি জানিয়েছেন তিনি।
লাখাই উপজেলার ১নং লাখাই ইউনিয়নে কৃষ্ণপুর গ্রামটি অবস্থিত। গ্রামটিতে প্রায় ২ হাজার লোকের বসবাস। গ্রামের সবাই হিন্দু ধর্মাবলম্বী। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কৃষ্ণপুর গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা অমরেন্দ্র লাল রায়ের নেতৃত্বে অনেক যুবক মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে ভারতে চলে যান এবং সরাসরি পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেন। অপরদিকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চল হিসাবে নিরাপদ মনে করে গ্রামের মানুষের আত্মীয়-স্বজনসহ বহু মানুষ পালিয়ে এসে গ্রামটিতে আশ্রয় নেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ভোর ৫ টার দিকে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এবং এলাকার স্থানীয় রাজাকার আলবদর বাহিনী পুরো গ্রাম ঘিরে ফেলে। তখন ছিল বর্ষাকাল, গ্রামের চতুর্দিকে ভরা বর্ষার পানি। গ্রামের মানুষ টের পেয়ে দৌড়াদৌড়ি ছুটাছুটি করতে থাকে। অনেকে ভয়ে পুকুরের কচুরিপানার নিচে লুকিয়ে থাকে। অন্যদিকে গ্রামে চলতে থাকে হানাদার বাহিনীর নিষ্টুর নির্যাতন। যাকে যেভাবে পেয়েছে গুলি করে কিংবা বেয়নেট দিয়ে খুচিঁয়ে হত্যা করতে থাকে। অনেককে ধরে এনে যদু নন্দন রায়ের দেয়াল ঘেরা বাড়িতে লাইনে দাঁড় করে গুলি করে হত্যা করে। যুবতী মেয়েদের ধরে এনে সম্ভ্রম হানি ঘটায়। ওই দিন বিকেল ৫ টা পর্যন্ত তারা এই পৈশাচিক কান্ড চালিয়ে যায়। পাকিস্থানী হানাদার বাহিনী গ্রামের ও গ্রামের বাইরের মোট ১২৭ জনকে নিষ্টুুরভাবে হত্যা করে। অনেকে মারাত্মক আহত হয়েও প্রাণে বেঁচে যান। সেদিন ধর্মীয় মতে এই লাশগুলোর সৎকার করা সম্ভব হয়নি। লাশগুলো বর্ষার পানিতে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছিল। যারা বেঁেচে গিয়েছিলেন তারা পরবর্তীতে আবারো আক্রমণের ভয়ে ওই দিন রাতে যে যেভাবে পারেন পালিয়ে গিয়েছিলেন। ওইদিন কোন বাড়ি তাদের হত্যাকান্ড ও লুটতরাজ থেকে রক্ষা পায়নি। স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলাদেশের যে ৩০ লাখ শহীদ আত্মদান করেছেন তাদের সাথে আছে কৃষ্ণপুর গ্রামের ১২৭ জন শহীদের আত্মদান। একদিন হয়ত ভবিষৎ প্রজন্ম শহীদদের সুমহান আত্মদানের কথা ভুলে যাবে। কৃষ্ণপুর গ্রামের অনাগত ভবিষ্যত প্রজন্ম যাতে গ্রামের ১২৭ জন শহীদের বীরত্বগাথা জানতে পারে এজন্য গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা অমরেন্দ্র লাল রায়ের উদ্যোগে ও পৃষ্ঠপোষকতায় এবং গ্রামবাসী সকলের সহযোগিতায় এখানে বধ্যভূমি নির্মিত হয়েছে। প্রতি বছর ১৮ সেপ্টেম্বর বধ্যভূমিতে শহীদদের স্মরণে আনুষ্ঠানিকভাবে পুষ্পস্তবক অর্পন, সাংস্কৃতিক অনৃষ্ঠান ও আলোচনা সভার মাধ্যমে মর্যাদা সহকারে দিবসটি পালন করা হয়ে থাকে। এখানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষনরত অবস্থার প্রতিকৃতি, ৩ জন মুক্তিযোদ্ধার প্রতিকৃতি ও শহীদ স্মৃতিস্তম্ভসহ জাতীয় দিবসগুলো উদযাপন ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করার জন্য স্থায়ী মঞ্চ নির্মাণ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, দেশ স্বাধীনের পূর্বে দলিত জনগোষ্ঠীর ভোটাধিকার ছিল না। স্বাধীনতা উত্তর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাদেরকে ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ করে দেন। এখনো তারা কৃতজ্ঞচিত্তে বঙ্গবন্ধুর সেই অবদানের কথা স্মরণ করে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে দলিত জনগোষ্ঠীর অবদান প্রসঙ্গে বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী মমিন বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে দলিত জনগোষ্ঠীর অবদান অপরিসীম। হবিগঞ্জে বসবাসকারী দলিত জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে পাকিস্তান সেনাবাহিনী দ্বারা নানা ভাবে নির্যাতিত, নিপীড়িত হয়েছেন। ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে পাকিস্তানি বাহিনী হবিগঞ্জের মাধবপুরের সুরমা চা-বাগানে প্রবেশ করে এবং শুরু করে হত্যাযজ্ঞ। চা-শ্রমিকদের ওপর অমানুষিক নির্যাতনের পর তাঁদের হত্যা করা হয়। তাঁদের কয়েকজনের মধ্যে হলেন আয়ছর আলী, আবদুল আজিজ, নাজিম উদ্দিন, প্রেমসিং মাকি মুন্ডা, চান্দা মুন্ড, চুনু সাঁওতাল প্রমূখ।
১৯৭১ সালের ১৭ আগস্ট সকাল ৯টায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী নৌকাযোগে বানিয়াচংয়ের মাকালকান্দি গ্রামে আসে। গ্রামটি ছিল হিন্দু অধ্যুষিত। এই গ্রামের পশ্চিমপাড়ায় নির্মিত চন্ডীমন্ডপে বিষহরি পূজার আয়োজন চলছে এবং গ্রামবাসী সেখানে অংশগ্রহণ করে। এই সময় পাকিস্তানি বাহিনী গ্রামটিকে ঘিরে ফেলে এবং অবিরাম গুলি ছুড়তে থাকে। একপর্যায়ে গ্রামের বৃদ্ধ-নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিশেষে চন্ডীমন্ডপের সামনে লাইনে করে দাঁড় করিয়ে সবাইকে গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। এখানে ৮২ থেকে ৮৭ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হয়। তাঁদের কয়েকজন হলেন অভিনয় দাস, সূর্য কুমার দাস, তরণী কান্ত দাস, গিরিন্দ্র কুমার দাস, ধীরেন্দ্র কুমার দাস, কৃপেন্দ্র সরকার, নকুল চন্দ্র দাস, কর্ণ সরকার, অন্নদাচরণ দাস, সুভাষিণী দাস, সরলা রাণী দাস, খুশি রাণী দাস, অমরি রাণী দাস, মানদা বালা দাস, তমাল রাণী দাস, সুভা রাণী দাস, সুরেন্দ্র দাস, কুমুদিনী দাস, শৈবালিনী দাস, গিরীশ সরকার, শ্যামল বালা দাস, বিধান চন্দ্র দাস প্রমূখ।
১৯৭১ সালের ১৬ আগস্ট দালালদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি বাহিনী বানিয়াচং উপজেলার নজিপুর গ্রামে প্রবেশ করে। চারদিক থেকে গ্রামটিকে ঘেরাও করে গুলি শুরু করে। সঙ্গে সঙ্গে অনেকেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। তারপর পুরো গ্রামে আগুন ধরিয়ে দেয়। একপর্যায়ে অস্ত্রের মুখে অসংখ্য গ্রামবাসীকে ধরে-বেঁধে লাইন করে দাঁড় করিয়ে গুলি শুরু করে। কিছু লোক হাওরে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণে রক্ষা পান। এখানে প্রায় ৫০ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হয়। তাঁরা হলেন কমল চন্দ্র দাস, ষোড়শী ছায়া রাণী দাস, বারীন্দ্র চন্দ্র দাস, সুনীতি বালা দাস, মীনা রাণী দাস, ঝরনা রাণী দাস, মাধুরী রাণী দাস, সুবল চন্দ্র নবশূদ্র, প্রফুল্লময়ী দাস, গোসাইরাম নমশূদ্র, গবিন্দ্র চন্দ্র নমশূদ্র, বিদ্যাবন নমশূদ্র প্রমূখ।
১৯৭১ সালের ২১ সেপ্টেম্বর হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলার কৃষ্ণপুর গ্রামে আসে পাকিস্তানি সৈন্যরা। এখানে আসার পর গ্রামটি চারদিকে ঘিরে ফেলে এবং এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে শুরু করে। একসময় ননী গোপাল রায়ের বাড়িতে ৩২ জন মুক্তিকামী মানুষকে একত্র করে। তারপর চলে তাদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন। নির্যাতন শেষে গুলি করে হত্যা করে। এ ঘটনা প্রায় ২৮ জন শহীদ হন। তাঁদের মধ্যে কয়েক হলেন ননী গোপাল চক্রবর্তী, সুকুমার সূত্রধর, রামা চরণ রায়, মহেন্দ্র রায়, জয়কুমার রায়, ক্ষিতীশ গোপ, রেবতী মোহন রায় প্রমূখ।
১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে রাজাকারদের সহযোগিতায় চুনারুঘাটে পাকিস্তানিরা ক্যাম্প স্থাপন করে। ক্যাম্পটি এখানে ছিল সাত মাস। এখানে সাধারণ মানুষকে ধরে নিয়ে এসে নির্যাতন করার পর হত্যা করা হতো। এখানে এমনি হত্যার শিকার হন গোছাপাড়া গ্রামের যোগেন্দ্র পাল, সুরেন্দ্র পাল, যোগেশ শুক্ল বৈদ্য ও তাঁর ছোট ভাই, চান্দপুর চা-বাগানের শ্রমিক নিবারং উরাং, কার্তিক ইয়ামুদসহ আরও তিনজন শ্রমিক।
তিরি আরো বলেন, আমাদের এই দেশের সর্বোচ্চ প্রাপ্তি আমাদের স্বাধীনতা। স্বাধীনতা যুদ্ধে এ দেশের সুবিধাভোগী লোকদের থেকে সুবিধাবঞ্চিত মানুষ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। যাদের অর্থ বিত্ত ছিল তারা অনেকেই প্রতিবেশি রাষ্ট্র ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেন। অপরদিকে এ দেশের খেটে খাওয়া মানুষ, কৃষক শ্রমিক জনতা, দিনমজুর ও দলিত শ্রেণিগোষ্ঠী তারা যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন এবং দেশ মাতৃকার স্বাধীনতা রক্ষায় সম্মুখ সমরে ঝাঁপিয়ে পড়েন। দলিত জনগোষ্ঠীর মাঝে ভারতে শরণার্থী হয়ে আশ্রয় নেয়ার যতেষ্ট সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তারা দেশের মাটি ত্যাগ করেনি। খুব কম সংখ্যকই দেশের মাটি ত্যাগ করেছেন। তাদের অধিকাংশই দেশের জন্য জীবন বাজি রেখেছেন। যে কারণে তারা পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ও রাজাকারদের দ্বারা নানাভাবে নির্যাতিত হয়েছেন। অনেক দলিত জনগোষ্ঠীর লোকজন শহীদ হয়েছেন। অনেকে চিরস্থায়ী পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। অনেক মা-বোনের ইজ্জত নষ্ট হয়েছে। তবুও তারা দেশ মাতৃকার স্বাধীনতার জন্য জীবনবাজি রেখেছেন। আর হবিগঞ্জে এ রকম বীর মুক্তিযোদ্ধা কোন অংশেই কম নয়। তাদের অবদান কোন ভাবেই খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আমাদের মনে করিয়ে দেয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আদিবাসী জনগোষ্ঠী বিশেষ করে দলিত জনগোষ্ঠীর অবদান অপরিসীম। তাই এ জনগোষ্ঠীর প্রতি আমাদের আরও বেশি আন্তরিক সহানুভূতিশীল হতে হবে। তাদেরকে তাদের প্রাপ্য সম্মান দিতে হবে। তবেই ৩০ লাখ শহীদের তাজা রক্তের বিনিময়ে, লাখো মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা সার্থক হবে।