জালাল আহমেদ
সঠিক বন্ধু নির্বাচন জীবনে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ
আমি পাঁচটি বিষয়ে আবেদন করেছিলাম এবং পাঁচটি বিষয়েই মৌখিক পরীক্ষার জন্য ডাক পাই। মৌখিক পরীক্ষার শেষে আবেদিত সবগুলো বিষয়েই ভর্তির জন্য মনোনীত হই এবং হাজী মুহাম্মদ মহসিন হল এর ছাত্র হিসেবে আমার পছন্দের বিষয় লোক প্রশাসনে ভর্তি হই। আমি আজিমপুর সরকারী কলোনীতে আমার চাচার বাসায় থাকতাম এবং হেঁটে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াত করতাম। আমাদের ক্লাশে ৬৪ জনের মধ্যে অন্ততঃ ২০ জন ছিল বিভিন্ন বোর্ডের এসএসসি/এইচএসসি বা উভয় পরীক্ষায় স্ট্যান্ড করা ছেলেমেয়ে। আমি নিঃসন্দেহে সৌভাগ্যবানদের একজন যে নিজ পছন্দের বিষয়ে ভর্তি হতে পেরেছিল। লোক প্রশাসন তখন এবং এখনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অন্যতম পছন্দের পাঠ্য বিষয়। আমাদের ক্লাশ শুরু হয় ৪ জানুয়ারী ১৯৭৯ এবং আমিও চেষ্টা করি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে। আমার মফস্বল ব্যাকগ্রাউন্ড, ব্যক্তিগত অন্তর্মুখী চরিত্র এবং বিশেষ করে ঢাকা বোর্ডের ছাত্রদের সঙ্গে মানের পার্থক্য আমাকে শুরুতেই একটু পিছিয়ে রাখে। ঢাকা বোর্ডে যে সপ্তম হয়েছিলো, জাকারিয়া আহমেদ, তাঁর নাম্বার ছিল আমার চেয়ে ৫০ বেশি, তাঁর জ্ঞানের পরিধি ও ঝকমকে ব্যক্তিত্বের কথা আর নাইবা বললাম। আমার সমান নাম্বার পেয়েও ইফতেখার হোসেন স্ট্যান্ড করার কাছে ছিল না। দু’জনেই হয়ে যায় আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। দু’জনের বাসাতেই আমার ১৯৭৯-৮০ এর অনেক সকাল-দুপুর-রাত কেটেছে।
১৯৭৯ সালের ৪ জানুয়ারী আমাদের প্রথম বর্ষের ক্লাশ শুরু হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম মেধাবী, সুদর্শন ও স্মার্ট শিক্ষক প্রফেসর সালাহউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান এর ক্লাশ দিয়ে। তিনি পরিসংখ্যান ও সামাজিক গবেষণা পড়াতেন। তাঁর প্রতি আমাদের মুগ্ধতা ও শ্রদ্ধাবোধ এখনো অটুট। সালাহউদ্দিন স্যারের বিষয়ে এবং জিন্নাহ স্যারের পাবলিক পারসোনেল এডমিনিস্ট্রেশন এর প্রথম ইন-কোর্স পরীক্ষায় আমি ভালো করি এবং তা আমাকে প্রয়োজনীয় আত্মবিশ্বাস যোগায়। ভর্তির সময়ে বিভাগীয় চেয়ারম্যান ছিলেন অধ্যাপক নুর মোহাম্মদ মিয়া। পিতৃতুল্য এই শিক্ষক ছিলেন আমাদের অন্য সকল শিক্ষকেরই শিক্ষক এবং আমার জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন তিনি। অন্য যে শিক্ষকমন্ডলী আমাদের পড়িয়েছেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন অধ্যাপক লুৎফুল হক চৌধুরী, অধ্যাপক নাজমুন্নেসা মাহতাব যিনি এই ৪২ বছর পরে আমার ছেলেকে লোক প্রশাসনের একটা কোর্স পড়াচ্ছেন, পুরনো ঢাকার বাসিন্দা অধ্যাপক এম এ জিন্নাহ, অধ্যাপক হাবিব মোঃ জাফরুল্লাহ, জনাব মাসুদুজ্জামান যিনি প্রভাষক ছিলেন ও সেখান থেকে সরাসরি চীফ ম্যানেজার পদে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকে যোগদান করেন।
নতুন বিভাগে শিক্ষক কম থাকায় ও শিক্ষকদের অনেকেই তখন উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশে থাকায় অন্ততঃ দুজন বহিরাগত শিক্ষক আমাদের পাঠ দান করেছেন। একজন তৎকালীন ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ পাবলিক এডমিনিস্ট্রেশন (নিপা) এর সিনিয়র ইন্সট্রাক্টর জনাব সফিউর রহমান এবং তৎকালীন এডমিনিস্ট্রেটিভ স্টাফ কলেজে প্রেষণে থাকা অধ্যাপক আলী আহমদ। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় পাঠকালীন সময়টা রাজনৈতিকভাবে অস্থির থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে এর বেশি প্রভাব পড়েনি। ১৯৮১ সালের মে মাসে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হত্যা এবং বিচারপতি সাত্তার এর ১০ মাসের শাসনকাল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক পরিবেশে বিঘœ সৃষ্টি করে নাই। ফলে ১৯৭৮-৭৯, ১৯৭৯-৮০ এবং ১৯৮০-৮১ পরপর তিনটি ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় যা এরপর আর কখনো হয় নাই।
একই সময়ে আমাদের বিভাগে এবং অন্যান্য বিভাগেও বিভাগীয় প্রতিনিধি নির্বাচন হয়। আমাদের বিভাগ নতুন হওয়াতে বিভাগীয় সেমিনারে বা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরীতে প্রয়োজনীয় বই পত্রের অভাব ছিল। ফলে আমাদের পড়ালেখা ছিল মূলতঃ নিপা কেন্দ্রিক (বর্তমান বাণিজ্য অনুষদ এর সামনের ভবনটাই তখনকার নিপা বিল্ডিং)। আমরা নিপা লাইব্রেরী ব্যবহার করতাম, নিপা’র বারান্দায় সারাদিন রোটেটিং আড্ডায় অংশ নিতাম আর কখনো কখনো নিপা ক্যান্টিনে খেয়েও নিতাম। সেখানে অনেকেই থাকতো, জাকারিয়া আহমেদ, রোমান কাওসার, একেএম আনোয়ার হোসেন, হোসেন মাহমুদ সালাম, মওদুদুর রশিদ সফদার, গোলাম শফিক, আবু ইলিয়াস সরকার, ইফতেখার হোসেন, কাজী গালিব হাসান, শেখ মাহবুবুর রহমান স্বপন’দা সহ অনেকে। কখনো এর সংগে যোগ হতো কনকা জামিল, লুতফুন নাহার নাজ, কাজল আহমেদ, ফাহমিদা, জেসমিন বা সোহানী। নিপা’র আড্ডা সকালে শুরু হতো, সারাদিনে সদস্য পরিবর্তন হতো কিন্তু আড্ডা চলতে থাকতো। বাঙালির আড্ডা জগৎবিখ্যাত, কিন্তু এ আড্ডায় শিক্ষণীয়ও অনেক কিছু ছিল। এ সময়ে আমরা সবাই স্টাডি সার্কেল বা গ্রুপ স্টাডি ধারণার সঙ্গে পরিচিত হই। আড্ডাকে যদি সঠিক ধারায় গাইড করা যায় অথবা আমি যদি সঠিক সঙ্গ বা আড্ডা বেছে নিতে পারি তবে এর লাভ অনেক। ‘এ পারসন ইস নোন বাই দ্যা কোম্পানী হি কিপস’, সঙ্গী দিয়েই একজনকে চেনা যায়। “কাষ্ঠের সঙ্গে কইরা পিরিত লোহা ভাসে জলে”, তাই সঠিক বন্ধু নির্বাচন জীবনে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।