লে. কর্নেল (অব:) এ কে এম মাকসুদুল হক, পিএসসি

প্রাকৃতিক দুর্যোগ আল্লাহ পাকের শাস্তি হিসেবে আপতিত হয় মানুষকে সতর্ক করার জন্য। এই দুর্যোগ বিভিন্নভাবে এসে থাকে। পবিত্র কুরআনে এ ধরনের বেশ কিছু দুর্যোগের ইতিহাস বর্ণনা করা হয়েছে বিশ্ব মানবতার শিক্ষা নেয়ার জন্য। অহঙ্কার আর শিরকে লিপ্ত হয়ে যাবতীয় অন্যায়-পাপাচারে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে পড়লে হজরত নূহ আ:-এর কওমকে মহা জলোচ্ছ্াস ও বন্যায় ডুবিয়ে ধ্বংস করা হয়, আদ জাতি হজরত হুদ আ:-এর সতর্কবাণী প্রত্যাখ্যান করার পর তাদের ঝড়-তুফান দিয়ে ধ্বংস করা হয়। সামুদ জাতিকে ভূমিকম্প দিয়ে ধ্বংস করা হয়, হজরত লুত আ:-এর জাতিকে তাদের জঘন্য পাপাচারের শাস্তিস্বরূপ পাথর বৃষ্টি দিয়ে ধ্বংস করা হয়। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সা:-এর সম্মান ও বরকতের কারণে এ ধরনের অহঙ্কার, শিরক ও পাপাচারের শাস্তিস্বরূপ পুরো জাতিকে ধ্বংস না করে বরং বিশ্ব মানবতার কোনো অংশকে দুর্যোগে বিপদগ্রস্থ করে পুরো বিশ্ববাসীকে সতর্ক করা হয়ে থাকে। কিন্তু প্রতি বছর একবার কিংবা দু’বার বিভিন্ন অঞ্চলে বন্যা, জলোচ্ছ্াস, ঘূর্ণিঝড়, সুনামি, দাবানল, অনাবৃষ্টি, খরা, যানবাহন দুর্ঘটনা, ভূমিকম্প, যুদ্ধসহ বিভিন্ন ধরনের দুর্যোগ দিয়ে বিপর্যস্ত হওয়ার পরও আমরা তাওবা করি না এবং কোনো শিক্ষাও নেই না। (সূরা তাওবা : ১২৬) ফলে আল্লাহ মহাবিপর্যয়ের দ্বারা মানুষকে শাস্তি দিয়ে থাকেন যেন তারা প্রভুর দিকে ফিরে আসে। (রুম : ৪১) এরই ধারাবাহিকতায় আজকের এই চলমান করোনা মহামারী আমাদের ওপর আপতিত হয়েছে। সত্যিকারার্থে এই ‘কোভিড-১৯’ মানুষের কৃতকর্মেরই ফল। আজকে অভিযোগ উঠেছে চীনে জীবাণু মারণাস্ত্র তৈরির গবেষণাগার থেকে দুর্ঘটনাবশত করোনাভাইরাস মানুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়েছে। অর্থাৎ মানুষকে মারার জীবাণু অস্ত্র নির্মাণের গবেষণারই প্রতিক্রিয়া হতে পারে এই মহামারী। অন্য মতে, চীনের একটি জীবন্ত পশু-পাখির বাজার থেকে বাদুড়ের মাধ্যমে এই জীবাণু মানুষে সংক্রমিত হয়েছে। অর্থাৎ মানুষ হালাল-হারামের তোয়াক্কা না করে সব ধরনের পশু-পাখি খেয়ে ফেলার প্রতিক্রিয়া হতে পারে এই ভাইরাস। তাছাড়া রোহিঙ্গা, উইঘুর এবং ফিলিস্তিনিদের জাতিগতভাবে ধ্বংস করে ফেলা হচ্ছে। শক্তির দাপটে চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্র্রান্স, রাশিয়া, ভারত, মিয়ানমার, নির্বিচারে নিরীহ লাখো মুসলমানকে হত্যা করছে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে। বিশ্বব্যাপী এই বিপর্যয় সৃষ্টির পরিপ্রেক্ষিতেই বিবেকহীন মানবতাকে শাস্তিদানের জন্য আল্লাহ তায়ালা আজকের এই করোনা মহামারী দিয়েছেন। এর আগেও বহু জাতির ওপর এ ধরনের বিপর্যয় আল্লাহ্ তায়ালা দিয়েছেন যেন মানুষ বিনীত হয় ও আল্লাহর কাছে নতি স্বীকার করে। (আনআম : ৪২) আর এই বিপর্যয় যখন আসে তখন তা বেছে বেছে শুধু জালিমদেরই ধ্বংস করেনা বরং তা সবাইকেই ধ্বংসের মুখে ফেলে। (আনফাল : ২৫)
কিন্তু কেউ তাওবা করে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর পথে ফিরে এসে নিজেকে সংশোধন করে নিলে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেবেন। এমতাবস্থায় সে মহামারীর শিকার হয়ে গেলেও মোমিন হিসেবে গণ্য হবে এবং মহাপুরস্কার লাভ করবে। (নিসা : ১৪৬) এভাবে যখন আল্লাহর সাহায্যে মানুষ বেঁচে যায় বা মহামারীর স্পর্শ থেকে দূরে থাকে তখন অনেকে পুনরায় অহঙ্কারের শিকার হয়। নিজের যোগ্যতা বা ডাক্তার ও ওষুধের কারণেই সে সুস্থ হয়ে উঠেছে বলে দাবি করে বসে। কারণ, আল্লাহর এই পরীক্ষার ব্যবস্থা সে বুঝতেই সক্ষম হয় না। (যুমার : ৪৯)
এ ধরনের মহামারী যখন চলে আসে তখন মানুষের দায়িত্ব হলো এ থেকে বাঁচার জন্য প্রচেষ্টা চালানো। নিজেকে এবং সমাজের লোকদের বাঁচানোর জন্য এগিয়ে আসতে হবে। এ জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ এবং অন্যান্য মানবিক তৎপরতা নিয়োজিত করতে হবে। তা না করলে তা হবে আত্মহত্যার শামিল। (বাকারা : ১৯৫)।
এ ক্ষেত্রে আল্লাহ পাক নিজেদের ভাগ্যকে নিজেরা বদলের চেষ্টা করতে তাগাদা দিয়েছেন। নিজেরা প্রচেষ্টা চালালে তখন আল্লাহ তাদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করবেন। নিজেরা প্রচেষ্টা না চালালে সেই জাতির জন্য অশুভ পরিণতিই নির্ধারিত হয়ে পড়ে। (রাদ : ১১) করোনা মহামারীর বিপদ থেকে বাঁচতে নিজেদের চেষ্টার সাথে সাথে আমাদের রবের ওপর নির্ভর করতে হবে। আল্লাহ পাক বলেন, ‘তুমি শুধু আল্লাহর ওপরই নির্ভর করো; চূড়ান্ত কর্মবিধায়ক হিসেবে আল্লাহ্ই যথেষ্ট।’ (আহযাব : ৩) তবে চূড়ান্তভাবে অব্যাহতি পাওয়ার শর্ত মাত্র একটিই; তা হলো শাস্তি আসার আগেই আল্লাহর কাছে নিঃশর্তভাবে আত্মসমর্পণ করতে হবে। (যুমার : ৫৪)
এইভাবে মহান আল্লাহ তায়ালার নিকট পুরোপুরি আত্মসমর্পণের সাথে সাথে নিজ নিজ সাধ্যমতো পার্থিব উপায়-উপকরণ দিয়ে প্রচেষ্টা চালালে অবশ্যই আল্লাহ্ পাক আমাদের করোনার ওপর বিজয় দান করবেন। আল্লাহ পাক বলেন, ‘তোমরা হতাশ হয়ো না এবং দুঃখিতও হয়ো না; তোমরাই বিজয়ী হবে যদি তোমরা মু’মিন হও।’ (আল ইমরান : ১৩৯) হয়তো বা আল্লাহ তায়ালা মোমিনগণকে করোনা থেকে বাঁচিয়ে রাখবেন। আর যদি এই মহামারীতে আক্রান্ত হয়ে কোনো মোমিন মৃত্যুবরণও করে তবে মোমিন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করার কারণে তার জন্য আল্লাহর কাছে রয়েছে মহাপুরস্কার।
লেখক: অধ্যক্ষ, বাদশাহ্ ফয়সল ইনস্টিটিউট (স্কুল অ্যান্ড কলেজ)