এসএম সুরুজ আলী ॥ হবিগঞ্জের বানিয়াচঙ্গে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী পলো বাইচ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়েছে। বাংলার হারিয়ে যাওয়া এ ঐতিহ্যকে আবারও জাগ্রত করে তুলেছে বানিয়াচং উপজেলার আতুকুড়া গ্রামবাসী ও নবীগঞ্জ উপজেলার বিজনা নদীর অববাহিকার পাঁচ গ্রামের লোকজন। মঙ্গলবার সকাল থেকে দিনভর বানিয়াচং উপজেলার আতুকুড়া বড়আন বিলে এবং নবীগঞ্জের বিজনা নদীতে এ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন স্থান থেকে এতে অংশ নিয়ে প্রতিযোগিতাকে মাতিয়ে তুলেছে হাজারো সৌখিন মাছ শিকারী।
জেলার বানিয়াচং উপজেলার আতুকুড়া গ্রামের বড়আন বিলে যুগ যুগ ধরে চলে আসছে পলো বাইচ প্রতিযোগিতা। এক সময় জেলার নবীগঞ্জ, বাহুবল, আজমিরীগঞ্জ, লাখাই ও বানিয়াচং উপজেলায় এ প্রতিযোগিতার প্রচলন ছিল। বিভিন্ন নদী, বিলে এ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হতো। শুধুই মাছ ধরা নয়, এর মাঝে ছিল গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যের মিশ্রণ। ছিল মানুষের বিনোদনেরও অন্যতম মাধ্যম এটি। বর্তমানে এটি হারিয়ে গেলেও আতুকুড়া গ্রামবাসী এ ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। পলো বাইচ প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় বিভিন্ন স্থান থেকে কয়েক হাজার মানুষ।
মঙ্গলবার সকাল থেকেই আতুকুড়াসহ আশপাশের গ্রাম ও জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে লোকজন মাছ ধরতে পলো নিয়ে বিলে হাজির হন। সাথে ছিল ভেড় জাল ও ছিটকি জালের সমারোহ। প্রতি বছর শীত মওসুমে হাওরের পানি কমতে শুরু করলে বানিয়াচং উপজেলার আতুকুড়া, সুবিদপুর, কাটখাল, মিঠাপুর, দরওয়া, মেওতুল, নাগুরা, কবিরপুর, সুনারু, বলাকীপুর, সহ আশপাশের গ্রামের মুরুব্বীরা বসে পলো দিয়ে মাছ শিকারের তারিখ নির্ধারণ করেন। নির্ধারিত দিনে কয়েক হাজার লোক পলো, জাল, দঁড়িসহ মাছ শিকারের বিভিন্ন উপকরণ নিয়ে দলবদ্ধ হয়ে বিলে হাজির হন। মাছ শিকার উৎসব উপলক্ষে আশপাশের গ্রামগুলোতে বিরাজ করে উৎসবমূখর পরিবেশ।
শিকারীদের অনেকেই বোয়াল, গজার, শোলসহ বিভিন্ন দেশীয় প্রজাতির মাছ ধরেন। প্রায় দুই হাজার শিকারী কয়েক লাখ টাকার মাছ শিকার করেন। মাছ ধরা পড়ার সাথে সাথে তাদের আনন্দে শরীক হন পাশের লোকজন। পলো দিয়ে পানিতে একের পর এক ঝাপ দেওয়া আর হৈ হুল্লোর করে সামনের দিকে ছন্দের তালে তালে এগিয়ে যাওয়া চিরচেনা গ্রামবাংলার অপরূপ সৌন্দর্যময় এক দৃশ্য। মাছ শিকার উৎসবে পলো ছাড়াও ফার জাল, ছিটকি জাল, ঝাকি জাল, পেলুন ইত্যাদি দিয়েও মাছ শিকার করেন অনেকে।
আতুকুড়া গ্রামের আশিক মিয়া পলো দিয়ে একটি গজার এবং ৩টি বোয়াল মাছ ধরেন। তিনি এই মাছ শিকার করতে পেরে আনন্দিত। একই গ্রামের সমুজ আলী আখঞ্জী পান ১টি বড় গজারসহ ৩টি মাছ। দেশীয় এই মাছ শিকার করতে পেরে তিনি খুশি। সমুজ আলী জানায় প্রতি বছরই তিনি পলো দিয়ে মাছ শিকার করতে বিলে যান।
নবীগঞ্জের বিজনা নদীতেও মাছ শিকারীরা এবার হাসি মুখে বাড়ি ফিরেছেন। কারণ সবার হাতেই ছিল বড় বড় মাছ। শীতের কষ্ট লাঘব হয় এই মাছ পেয়ে। বড়গাও গ্রামের শামিম আহমেদ ও তার লোকজন ছোট বড় ১০টি মাছ শিকার করেছেন পলো দিয়ে।
আতুকুড়া গ্রামের প্রবীণ মুরুব্বি আব্দুল হেকিম জানান, পলো বাইচ প্রতিযোগিতা দেয়ার আগে বিলে জাল ফেলে মাছ ধরে নেয় ইজারাদাররা। ফলে প্রতিযোগীরা তেমন মাছ পান না। এছাড়া প্রতিযোগিতা শেষে বিলে বিষ দিয়ে মাছ নিধন করা হয়। এতে মাছের বংশবিস্তার বিনষ্ট হয়ে যায়। তাই বিলে যেন বিষ দিয়ে মাছ নিধন না করা হয় সেদিকে সরকারকে সুনজর দিতে হবে। তিনি আরো জানান, এলাকার লোকজন বৈঠক করে দিন তারিখ নির্ধারণ করেন। এই উৎসব আমাদের ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
© স্বত্ব দৈনিক হবিগঞ্জের মুখ ২০১৯
ওয়েবসাইটটি তৈরী করেছে ThemesBazar.Com