প্রাকৃতিক বৈচিত্রে ভরপুর বাহুবল উপজেলার লোকজন তুলনামূলক আলসে ॥ বাহু শক্তির কারণেই এর নামকরণ করা হয় বাহুবল

আতাউর রহমান কানন

১০ অক্টোবর ২০০৬, মঙ্গলবার। সকাল ৯টায় বাহুবল উপজেলায় যাই। সেখানে ইউএনও মো. মনিরুজ্জামান কর্তৃক আয়োজিত সৌজন্য মতবিনিময় সভায় যোগদান করি। এখানের লোকজন দেরিতে আসায় সময়মতো সভা শুরু করা যায় না। এতে ইউএনওকে বেশ বিব্রত মনে হল। অজুহাত হিসেবে রোজার দিনকে বেছে নেওয়া হয়। আমার পূর্বঅভিজ্ঞতায়, হবিগঞ্জের অন্যান্য উপজেলার চেয়ে এ উপজেলার লোকজন তুলনামূলক আলসে। আমি ১৯৯৬ সালে মাসাধিককাল এ উপজেলার ইউএনও’র শূন্যপদে দায়িত্ব পালন করেছি। তখন দেখেছি দুপুরের আগে এখানের কোনো অফিসই জমে না। ইউএনও সাহেব অবশেষে দুপুরের আগে আগে সভা শুরু করতে সক্ষম হলেন। বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তা ও চেয়ারম্যানগণ এখানেও আমার প্রশংসাসূচক বক্তব্য রাখলেন। আমি নাকি এদের লোক ছিলাম, আবার এদের মাঝেই ডিসি হয়ে ফিরে এসেছি। আমি ভেতরে মিটিমিটি হাসলেও মন বলে ওঠল, তাই তো! আমি তো এদেরই লোক। আমার মনে পড়ল, ১৯৯৪ সালে উপজেলা কোর্ট উঠে যখন জেলা সদরে যায়, তখন আমার সদর উপজেলা কোর্টের সঙ্গে তো এ উপজেলার কোর্টও সংযুক্ত করা হয়েছিল। আমি তো এদের উপজেলার ম্যাজিস্ট্রেটও ছিলাম। আমার আরও মনে পড়ল সেসময় এইচএসসি পরীক্ষা চলাকালে ডিসি অফিস থেকে ম্যাজিস্ট্রেট শাহজাহান মিয়াকে এই বাহুবল কলেজে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তখন নকলের মহোৎসবের যুগ। উক্ত ম্যাজিস্ট্রেট পরীক্ষার প্রথমদিন কয়েকজন পরীক্ষার্থীকে নকল টোকার কারণে বহিস্কার করেন। পরীক্ষার শেষের দিকে বহিস্কৃত এক পরীক্ষার্থী কাঁটাকম্পাস দিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট শাহজাহানকে পেছন থেকে আচমকা ঘাই মেরে দৌঁড়ে পালিয়ে যায়। এ ঘটনা দ্রুত জেলায় ছড়িয়ে পড়ে। আহত ম্যাজিস্ট্রেট স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে জেলাসদরে ফিরে এলে তাঁর কাছে বিস্তারিত শুনি। পরদিন ডিসি সাহেব আমাকে ওই পরীক্ষা কেন্দ্রে পাঠান। আমি পরীক্ষা শুরুর ঘণ্টাখানিক পূর্বে কেন্দ্রের গেটে চেকপোস্ট বসিয়ে দেহতল্লাশী করে পরীক্ষার্থীদের হলে প্রবেশ করাই। সেদিন কেন্দ্র থেকে ৩৫ জনকে নকলের দায়ে বহিস্কার করি। সারা কেন্দ্রে থমথমে ভাব বিরাজ করছিল। আমি এভাবে কয়েকদিন বাহুবল কলেজ কেন্দ্রে পরীক্ষার আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পালন করি।
বাহুবল উপজেলা সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্যাদি সন্নিবেশিত একটি ফাইল আমার সামনে রাখা ছিল। আমি সে ফাইলের দিকে তাকিয়ে আমার অজানা অনেক বিষয় জেনে নিলাম।
প্রাগৈতিহাসিক হিসেবে ত্রিপুরা রাজ্যের সামন্ত শাসিত ক্ষুদ্র রাজ্য রাজপুরের অধীন ছিল বর্তমান বাহুবল। বিভিন্ন সময়ে এটি বিভিন্ন নামে বিভিন্ন শাসকের শাসনাধীন ছিল। এর নামকরণ নিয়ে দুটি ভিন্ন জনশ্রুতি প্রচলিত আছে-
জনশ্রুতি-১. প্রাচীনকালে কুদরত মাল নামে এক পালোয়ান বাহুবল এলাকায় বাস করতেন। এলাকায় তখন মল্লযুদ্ধের প্রচলন ছিল। আর মল্লযুদ্ধে তাঁর খুবই নামডাক ছিল। একবার সেই পালোয়ানের সঙ্গে মল্লযুদ্ধে লড়ার জন্য বর্তমান মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলার দক্ষিণভাগ থেকে নামকরা এক পালোয়ান এসেছিলেন। সেই যুদ্ধ প্রথমে সমানে সমান চলছিল; কিন্তু শেষ পর্যন্ত কুদরত মাল বিজয়ী হয়ে নিজের বাহুর পেশী দেখিয়ে গর্বভরে বলেছিলেন, ‘বাহুকা বল দেখ বেটা’। সেই ‘বাহুকা বল’ থেকে এলাকার নাম হয়েছে বাহুবল।
জনশ্রুতি-২. এ এলাকার পুরুষগণ ছিল খুবই শক্তিশালী ও বীরযোদ্ধা। সেইসময় তেমন কোনোরূপ ধারালো অস্ত্রশস্ত্রের ব্যবহার ছিল না। মারামারিতে সাধারণত ৩-৪ হাত লম্বা বাঁশের লাঠি ব্যবহার হতো। সে বাঁশের লাঠি যার হাত থেকে পড়ে যেত বা ভেঙে যেত সে হতো পরাজিত। তার উপর আর কেউ আঘাত করত না। এছাড়া পাহাড়ের হিংস্র বাঘের সঙ্গে এ এলাকার মানুষের অনেকসময় হাতাহাতি যুদ্ধ হতো। এমনকি বাঘের হাত থেকে হরিণ ছিনিয়ে আনতেও তাদের সাহসের কমতি ছিল না। এলাকার এসব নির্ভীক সাহসী বীর পুরুষদের পরিচয় থেকেই ‘বাহুবল’ নামের উদ্ভব হয়েছে বলে অনেকেই বলে থাকেন।
১৯২১ সালে আসাম প্রাদেশিক সরকারের এক গেজেট নোটিফিকেশনে বাহুবল প্রশাসনিক থানা হিসেবে প্রতিষ্ঠালাভ করে। সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে ১৯৮৩ সালের ২৪ মার্চ প্রশাসনিক সংস্কারের বদৌলতে ৭টি ইউনিয়ন নিয়ে ২৫০.৬৬ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের বাহুবল প্রশাসনিক থানাটি উপজেলায় উন্নীত হয়।
বাহুবল উপজেলা প্রাকৃতিক বৈচিত্রে ভরপুর। এ এলাকা পাহাড়ি টিলা, সমতল ভূমি ও হাওড় নিয়ে গঠিত। উপজেলার অন্তর্গত ৭টি চা বাগান ও উপজেলার পাহাড়ি নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী খাসিয়াদের জীবনাচরণ পর্যটকদের কাছে বেশ আকর্ষণীয়। খাসিয়ারা বাহুবলের আলিয়া খাসিয়াপুঞ্জিতে আদিকাল থেকে বসবাস করে আসছে। তাদের প্রধানকে বলা হয় ‘মন্ত্রী’। পাহাড়ের ওপর মন্ত্রীর বাড়ি এর আগে আমি যখন হবিগঞ্জে কর্মরত ছিলাম, তখন দুবার দর্শন করেছি। এদের প্রধান ফসল পান-সুপারি। পাহাড়ি গাছে গাছে এই পান চাষ হয়। এছাড়া কলা ও আনারস তাদের অন্যতম ফসল। এখানের সবরি কলা স্বাদে ও গন্ধে দেশ সেরা।
এই বাহুবলেই রয়েছে ‘রশিদপুর প্রাকৃতিক গ্যাসফিল্ড’। এই গ্যাসফিল্ডটি ১৯৪৬ সালে সর্বপ্রথম আবিষ্কৃত হয়। ১৯৭৫ সালে এর মালিকানা বাংলাদেশ সরকার পায়। অতঃপর নব্বই দশকে কূপ খননের মাধ্যমে এখান থেকে গ্যাস উত্তোলন শুরু হয়।
রূপাইছড়া রাবার বাগান বাহুবলের অন্যতম পর্যটক আকর্ষণ। ১৯৭৭ সালে পুটিজুরী পাহাড়ি ১৯৬৩.২২ একর ভূমিতে বন বিভাগ কর্তৃক সৃজিত এই বাগান থেকে ১৯৮৫ সালে রাবার উৎপাদন শুরু হয়। সারিবদ্ধভাবে লাগানো রাবার গাছের চিরসবুজ পাতার সৌন্দর্য দেখে দর্শনার্থীগণ বিমোহিত হন।
এই বাহুবলের গর্ব করার মতো প্রখ্যাত ব্যক্তি হলেন- কমান্ড্যান্ট মানিক চৌধুরী (২০ ডিসেম্বর ১৯৩৩ – ১০ জানুয়ারি ১৯৯১) যিনি একজন প্রখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা ও রাজনীতিবিদ। মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণের জন্য অস্ত্রের প্রয়োজনে তাঁর নেতৃৃত্বে হবিগঞ্জ সরকারি অস্ত্রাগার লুট করা হয়েছিল এবং ১৯৭১ সালের এপ্রিলের ৫ তারিখে সিলেট অঞ্চলের সবচেয়ে বড় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত শেরপুর-সাদিপুর যুদ্ধে তিনি সরাসরি অংশ নেন। সম্মুখ যোদ্ধা ও সংগঠক হিসেবে অসামান্য অবদানের জন্য মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের চীফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল এম. এ. রব তাঁকে সিভিলিয়ান হওয়া সত্ত্বেও “কমান্ড্যান্ট” উপাধিতে ভূষিত করেন।
মুক্তিযুদ্ধ ছাড়াও তাঁর বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে তিনি ৬ দফা আন্দোলন ও ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। তিনি ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে হবিগঞ্জ থেকে এম.এন.এ. এবং ১৯৭৩ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৭ জুলাই ১৯৭৫ সালে তিনি বাকশাল সরকারের হবিগঞ্জ মহকুমার গভর্ণর নিযুক্ত হয়েছিলেন। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে অনন্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে ২০১৫ সালের “মরণোত্তর” স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদান করা হয়। দেশপ্রেমী এই সংগ্রামী মানুষটি জীবনের শেষ দিকে প্রায় বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করেন।
মতবিনিময় সভা দেরিতে শুরু হওয়ায় বক্তাদের সবাই বক্তব্য রাখতে সময় পেলেন না। জোহরের আজান ভেসে আসতে থাকে। আজান শেষ হলে আমি সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখলাম। রোজার মাস। উপজেলা মসজিদে জোহরের নামাজ আদায় করে আমি বাহুবল থেকে সদর দপ্তরে ফিরে আসি।
এদিন সন্ধ্যায় হবিগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির আয়োজিত ইফতার মাহফিলে যোগদান করি। এ মাহফিলে জেলা জজশিপ ও জেলা পুলিশের কর্মকর্তারাও আমন্ত্রিত হয়ে যোগদান করেন।
পরের দিন সকাল ১১টায় সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার আবদুল হাকিম মন্ডল হবিগঞ্জ কালেক্টরেট পরিদর্শনে আসেন। তিনি তাঁর পরিদর্শনের বাইরে জাতীয় স্যানিটেশন দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে যোগদান করেন। তাঁর সম্মানে প্রদত্ত ইফতার ও নৈশভোজে তিনি অংশগ্রহণ করে রাত আটটায় হবিগঞ্জ ত্যাগ করেন।
(চলবে…)