আতাউর রহমান কানন
সহকর্মীদের মধ্যে কোনো ভেজাল থাকলে নিজ দায়িত্বে সংশোধন হতে বলি, অন্যথায় জেলা ছেড়ে চলে যাওয়ার আহ্বান জানাই
মোঃ আতাউর রহমান ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দুই বছর হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক ছিলেন। সর্বশেষ তিনি খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হিসেবে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পরপরই ৫ বছর জাতিসংঘ বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচিতে সিনিয়র কনসালট্যান্ট পদে চাকরি করেন। চাকরি জীবনের বাইরে তিনি একজন লেখক। আতাউর রহমান কানন নামে তিনি পাঠক মহলে সমাদৃত। তাঁর অনেকগুলো গল্প, উপন্যাস, ভ্রমণ কাহিনি, কাব্যগ্রন্থ ইত্যাদি প্রকাশিত হয়েছে। চাকরি জীবনের প্রথম দিকে তিনি হবিগঞ্জ সদর উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট, এনডিসি, মাধবপুরের ইউএনও হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। হবিগঞ্জে দায়িত্ব পালনকালীন সময়ের প্রতিটি মুহূর্ত তিনি নিজের ডায়েরিতে লিখে রেখেছেন। তাঁর সেই ডায়েরি তিনি বই আকারে প্রকাশ করবেন ‘খোয়াই নদীর তীরে’ শিরোনামে। বই প্রকাশের আগে তাঁর এই লেখা দৈনিক হবিগঞ্জের মুখ পত্রিকার পাঠকদের জন্য ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে-
এই লেখায় কোন সংশোধন বা সংযোজন থাকলে লেখক আতাউর রহমান কাননকে জানাতে পারেন যে কেউ। প্রয়োজনে তিনি বইয়ে তা সংশোধন-সংযোজন করবেন বলে জানিয়েছেন।
২০ সেপ্টেম্বর ২০০৬, বুধবার। আজ সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ভারি মেঘে ছেয়ে থাকা আকাশ হতে থেমে থেমে দমকা হাওয়াসহ শ্রাবণের ধারা বইতে থাকে। এরমধ্যে আজ আবার আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় বিরোধীজোট কর্তৃক সারাদেশে আধবেলা রাজপথ-রেলপথ-জলপথ অবরোধ কর্মসূচি ছিল। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ৪ দলীয় জোট সরকারের শেষ সময়ে বিরোধী জোটের হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি বেশ বেগবান হচ্ছে।
বিকেলে আমি জেলা প্রশাসক হিসেবে যোগদানের জন্য সপরিবারে হবিগঞ্জ জেলায় আসি। হবিগঞ্জের গেট বলে পরিচিত মাধবপুর উপজেলা সদরে জেলা প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আমাকে অভ্যর্থনা জানান। আমি একসময় এই মাধবপুর উপজেলার ইউএনও এবং হবিগঞ্জ জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেট-এনডিসি ছিলাম। সে সুবাদে এলাকার অনেক কিছুই আমার চেনা-পরিচিত। আমার আগমন সংবাদে মাধবপুরের পৌর মেয়র আবু মুসলিম-সহ এলাকার বেশ কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গও উপস্থিত হন। এখানের সড়ক বিভাগের ঐতিহ্যবাহী রেস্টহাউজে চা-নাশতায় আপ্যায়িত হয়ে হবিগঞ্জ সদর দপ্তরের উদ্দেশে রওনা করি। সন্ধ্যা হয় হয় এমন সময়ে সার্কিট হাউজে পৌঁছি। সেখানে কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দ আমাদের ফুল দিয়ে স্বাগত জানান। আমার ভালো লাগল অধিকাংশ স্টাফই আমার পরিচিত দেখে।
আমি ফ্রেশ হয়ে সার্কিট হাউজের সভাকক্ষে উপস্থিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়ে সৌজন্য বক্তব্য রাখলাম। তাঁরা আমাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বিদায় নিলে আমি সেখান থেকে সপরিবারে জেলা প্রশাসকের জন্য নির্ধারিত বাসভবনে গিয়ে উঠি। সার্কিট হাউজের সংলগ্ন পশ্চিম পাশেই বেশ অনেকটা জায়গা নিয়ে পুকুরসহ বাসভবন। আগে আমি এ জেলায় ম্যাজিস্ট্রেট-এনডিসি হিসেবে চাকরি করাকালে অগণিতবার এ বাসভবনে এসেছি-খেয়েছি। আজ সেই বাসভবনই কিনা আমার বাসস্থান! একটা অন্যরকম অনুভূতি আমার মনের ভেতর দোলা দিতে থাকে।
পরদিন সকাল ৯টায় কাঁটায় কাঁটায় অফিসে গেলাম। ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক মো. ফজলুর রহমানের নেতৃত্বে কালেক্টরেটের সহকর্মীরা আমাকে রিসিভ করেন। এরপর জেলা ট্রেজারির দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার মাধ্যমে জেলা প্রশাসকের আনুষ্ঠানিক দায়িত্বভার গ্রহণ করি। সকাল ১০টায় পুলিশ সুপার মিলি বিশ্বাস আমার চেম্বারে এসে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন এবং জেলার আইন-শৃঙ্খলা বিষয়ে ব্রিফ করেন। তিনি আমার ব্যাচমেট। এরমধ্যে আমার সম্পর্কে হবিগঞ্জের মানুষের কাছে অনেককিছুই জেনেছেন বলেও নির্দ্বিধায় জানান। সাক্ষাৎ শেষে তিনি চলে গেলে সকাল ১১টায় কালেক্টরেটের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে সম্মেলন কক্ষে এক সৌজন্য সভায় মিলিত হই। অধিকাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারী আমার পূর্বপরিচিত। আমার আগমন নিয়ে অনেকেই প্রশংসা করে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখলেন। কর্মকর্তাদের মধ্যে যাঁরা আমার অপরিচিত তাঁরা আমার সম্পর্কে একটা বার্তা পেয়ে যান। আমি এই জেলায় ১৯৯২ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত ম্যাজিস্ট্রেট ও এনডিসি হিসেবে চাকরি করেছি। সে সময় আমার কাজের নিরপেক্ষতা যে প্রশ্নাতীত ছিল, তা আমি বিভিন্নভাবেই অবহিত। আমার ওই সময়ের কার্যকলাপ নিয়ে আমারই লেখা ‘মেঘ জোছনার দিনগুলি’ নামক স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থে বিধৃত রয়েছে।
আমি আজকের এই সভায় কালেক্টরেটের কাজকর্মের সুবিধা-অসুবিধার বিষয় জানতে চাইলে প্রথমদিন বলেই হয়তো কেউ মুখ খুললেন না। তবে আমি এখানে আসার আগে অনেকেরই সম্পর্কে আমার কানভারি হয়েছে। বিশেষ করে কোর্ট নাকি আর কোর্ট নাই। পচা ডিমের গন্ধভরা। আমি সবার উদ্দেশে আভাসে ইঙ্গিতে সাদাসিধে বক্তব্য রাখি। সর্বোপরি সহকর্মীদের নিরপেক্ষতা ও সততার সঙ্গে কাজ করার জন্য আহ্বান জানিয়ে সভা শেষ করি।
বিকেল ২টায় আইনজীবী সমিতির সঙ্গে সৌজন্য সভায় মিলিত হই। তাঁরা বলা যায় সবাই আমার পূর্বপরিচিত। তাঁদের সঙ্গে আলোচনায় তাঁরা আমাকে জানান যে, আপনি আগে আমাদের ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন, এবার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে আপনাকে পেয়ে আমরা আনন্দিত। আমাদের কোর্ট-কাচারিতে যেটুকু সমস্যা আছে, আপনি আসাতে এমনিতেই তা দূরীভূত হবে।
সন্ধে ৭টায় সার্কিট হাউজের সভাকক্ষে জেলার সাংবাদিকদের সঙ্গে এক সৌজন্য সভায় মিলিত হই। জেলার এই পেশাজীবী গ্রুপের অধিকাংশই আমার পরিচিত। কেউ কেউ আমার বেশ ঘনিষ্ঠ। সভায় কালেক্টরেটর অফিসারগণও উপস্থিত ছিলেন। সাংবাদিকগণের মধ্যে দু-একজনের মুখের লাগাম তো নে-ই, চোখের পাতাও নেই বললে চলে। এ সভাতেই তাঁরা ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টের সমালোচনা করে বক্তব্য রাখেন। আমার প্রতি যে তাঁদের অগাধ আস্থা ও ভালোবাসা আছে তা-ও বলতে কার্পণ্য করেননি।
আমার বক্তব্য দেওয়ার সময় আমি তাঁদের প্রশংসার মান যাতে রাখতে পারি সে সহযোগিতা চাই এবং আমার সহকর্মীদের মধ্যে কোনো ভেজাল থাকলে তাঁদের নিজ দায়িত্বে সংশোধন হতে বলি, অন্যথায় জেলা ছেড়ে চলে যাওয়ার আহ্বান জানাই। সাংবাদিকগণ নাশতাপানিতে আপ্যায়িত হয়ে একে একে আমার সাথে হাত মিলিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়ে চলে যান।
পরের দিন শুক্রবার সকালে স্থানীয় কয়েকটি সংবাদপত্রে জেলা প্রশাসক হিসেবে হবিগঞ্জে আমার যোগদানের বিষয়টি ফলাও করে ছবিসহ লিড নিউজ হয়। আর শিরোনাম হয় ‘দুর্নীতিবাজ ভেজাল অফিসারদের নিজ দায়িত্বে জেলা ছাড়ার নির্দেশ দিলেন নবাগত জেলা প্রশাসক।’
গতকালের সভাসমূহ আমার ইচ্ছানুযায়ী এডিসি জেনারেল আয়োজন করেছিলেন। আজ রাতে আমার বাসভবনে সকল অফিসার ও জেলার কোর অফিসারদের সপরিবারে আমন্ত্রণ জানানো হলে সবাই তাতে যোগদান করেন। এতে জেলা জজ আজিজুল ইসলাম, পুলিশ সুপার মিলি বিশ্বাস, জেলার অন্যান্য কোর অফিসার এবং আমার প্রশাসনের কর্মকর্তাগণ ও তাঁদের পরিবারবর্গের সাথে আমার ও আমার পরিবারের প্রাথমিকভাবে একটা মিথস্ক্রিয়া ঘটে।
মাঠ প্রশাসনের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় ম্যাজিস্ট্রেট, এনডিসি, ইউএনও, এডিসি পদে আমি ১৯ বছরাধিক চাকরি করি। এ সময়ে নানারকমের কাজকর্মে আমার বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়। আমি সবসময় নিরপেক্ষ ও স্বাধীনচেতা হিসেবে কাজ করতে পছন্দ করি। আর আমার এযাবৎ কর্মকালে আমি তার স্বাক্ষর কর্মক্ষেত্রসমূহে রাখতে সমর্থ হয়েছি বলে আমার বিশ্বাস। এ জেলাতে পূর্বে কাজ করার আমার যেমন অভিজ্ঞতা রয়েছে, তেমনি রয়েছে আমার নিরপেক্ষতার পরিচিতি। এখানে যোগদানের আগে আমি গাজীপুর জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ছিলাম। সেখানে আমার আড়াই বছর চাকরিকালীন লিখিত ডায়েরির ওপর নির্ভর করে ‘জীবন নদীর বাঁকে’ নামক গ্রন্থ রয়েছে।
২৩ সেপ্টেম্বর ২০০৬, শনিবার। দিনটি সাপ্তাহিক ছুটি হওয়ায় আমি বাসাতেই অবস্থান করি। সকালে হবিগঞ্জের সাবেক পৌর মেয়র বিশিষ্ট সুধীজন শহীদ চৌধুরী ও দু-একজন পূর্বপরিচিত ভিজিটর আমার সাথে সাক্ষাৎ করেন। তাঁরা আমাকে আপন ভেবে জেলার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে কিছু ধারণা দেন।
বিকেল ৪টায় ‘উন্নয়নের দিগন্ত’ শীর্ষক বাংলাদেশ বেতার, সিলেট এর বহিরাঙ্গন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগদান করি এবং দেশের উন্নয়নের ওপর বক্তব্য রাখি। রাতে স্টাফ অফিসারকে সঙ্গী করে হবিগঞ্জ শহর এলাকার বর্তমান অবস্থা সরেজমিন পর্যবেক্ষণ করি।
২৪ সেপ্টেম্বর ২০০৬, রবিবার। আমি জাস্ট ৯টায় অফিসে যাই। বলা যায় আজই আমার অফিসে কর্মচঞ্চল দিন কাটে। এরমধ্যে অনেকেই আমার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। পূর্ব পরিচিতজনেরা তো আপন ভেবে নানারকম আলাপ করেন। আমি আমার পদ-পদবির কথা ভুলে তাঁদের অনেকের সাথেই আলাপে মিশে যাই। তাঁদের চা-নাশতা খাইয়ে বিদায় জানাই। তাঁরা আমার বর্তমান চেয়ারের সম্মান দেখিয়ে চলে যান। পরিচিত জায়গায় পুনরায় উচ্চপদে চাকরি করতে আসার ভালো-মন্দ দুটোই রয়েছে। তবে আমার ক্ষেত্রে ভালো ও মন্দের কোনটি হয়েছে তা এখনো নিরূপণের সময় আসেনি।
অফিস শেষে বিকেল ৫টায় বাসায় ফিরে আসি। মাগরিবের পর বাংলোর অফিসে বসে কিছু পেন্ডিং নথি নিষ্পত্তি করি। এরপর টেলিফোনে বিভাগীয় কমিশনার আবদুল হাকিম মন্ডলের সঙ্গে কথা বলে তাঁর সৌজন্য সাক্ষাৎ প্রার্থনা করলে তিনি আগামীকাল দুপুর সাড়ে ১২টায় সময় মঞ্জুর করেন। আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, ডিসিরা যোগদানের পরপরই কমিশনারের সঙ্গে অনতিবিলম্বে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। কেউ কেউ আবার আগেও দেখা করে তারপর যোগদান করেন। আমার ক্ষেত্রে কিছুটা বিলম্ব হয়ে গেছে।
ডিনার শেষে রাতে ঘুমিয়ে গেছি। অব্যাহত টেলিফোনে ঘুম ভেঙে যায়। গুরুত্বপূর্ণ ভেবে ফোন রিসিভ করলে জামায়াতের জেলা আমির পরিচয় দিয়ে আমাকে বলেন, ডিসি সাহেব, উমেদনগর কওমী মাদরাসার মাইকে সেহেরি খাওয়ার জন্য ঘোষণা দিচ্ছে।
আমি ঘুমভাঙা চোখে বললাম- অসুবিধা কী?
-আমাদের সরকার তো চাঁদ দেখার ঘোষণা দেয় নাই।
-তাতে কী?
-একদেশে দুই নিয়ম চলতে পারে না। এটা বন্ধ করেন।
-এটা তো নতুন কিছু না। এরা সৌদি আরবের সাথে মিল রেখে রোজা করে, ঈদ করে। দেশের বিভিন্ন এলাকাতেই বহু আগে থেকেই হয়ে আসছে। আপনারও জানার কথা। আজ আমি বন্ধ করব কীভাবে?
-ডিসি চাইলে সব পারে।
-তা ঠিক না। বিশেষ করে ধর্মীয় বিষয়ে তো নয়ই। ও বিষয়টি ধর্মীয় নেতারাই বুঝবেন।
আমির সাহেব আরও কিছু বলতে চেয়েছিলেন, আমি আর কথা না বাড়িয়ে ‘আচ্ছা রাখি’ বলে টেলিফোন রেখে দিলাম। (চলবে…)