জালাল আহমেদ
কাতেবী মসজিদকে শপথের মসজিদও বলা হতো ॥ কোন বিবাদ নিষ্পত্তির জন্য শপথ করাতে এই মসজিদের সামনে যাওয়া হতো

বাঁশখালীর সংসদ সদস্য মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী বৈলছড়ি ইউনিয়নের এক অভিজাত পরিবারের সন্তান। তাঁর বাবা খান বাহাদুর বদি আহমদ চৌধুরী ১৯২২-৫২ বৈলছড়ি ইউনিয়ন বোর্ড এর প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ১৯২৯-১৯৩৬ সময়কালে বেংগল লেজিস্লেটিভ এসেম্বলী এর সদস্য (এমএলএ) এবং ১৯৪৩-৪৪ সময়কালে জমিদারদের প্রতিনিধি হিসেবে এমএলএ হন। এছাড়া ও কলকাতা চট্টগ্রামে বিভিন্ন সংগঠনের সংগে যুক্ত ছিলেন তিনি। তাঁর এক ভাই নুরুল ইসলাম চৌধুরী বৈলছড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন ১৯৫২ থেকে ১৯৮৪ এবং আমি যখন ইউএনও তখন নুরুল ইসলাম চৌধুরী’র ছেলে তাঁর ভাতিজা বদরউদ্দিন চৌধুরী ওরফে সোহাগ মিয়া চেয়ারম্যান ছিলেন। মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরীর চাচাতো বোন ছিলেন প্রাক্তন প্রতিমন্ত্রী কামরুন্নাহার জাফর। চাচা খান সাহেব রফিক আহমদ চৌধুরী ছিলেন ইন্ডিয়ান ফরেস্ট সার্ভিস এ বিভাগীয় বন কর্মকর্তা। তাঁর এক ভাই এর নাম দেশবাসী জানে কারণ ওলিউল ইসলাম চৌধুরী (সুক্কু মিয়া) ৭০-৮০ দশকে একাধিকবার রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচনে প্রার্থী ছিলেন।
মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৫ সালে মাস্টার্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং ঐ বৎসরেই ফৌজদারী কার্যবিধি ১৮৯৮ এর বিধান অনুযায়ী তরুণ বয়সে চট্টগ্রামের অনারারী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োজিত হন। ১৯৭৫-১৯৭৮ সময়কালে তিনি অনারারী ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন এবং ১৯৭৯ সালের সংসদ নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮৫ সালে প্রথম উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বাঁশখালী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন ও পরে ১৯৮৬ এবং ১৯৮৮ সনে তিনি জাতীয় পার্টি থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী অত্যন্ত বুদ্ধিমান ব্যাক্তি ছিলেন আর তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল অসাধারণ। ক্ষমতা খাটাতে পছন্দ করতেন এবং জনমনে বিশ্বাস ছিল ছিল যে তাঁর ইশারা ইঙ্গিতে না চললে বাঁশখালী তে ইউএনও হিসাবে চাকুরী করা যাবে না। আমার পূর্বসূরিদের এর উদাহরণ হিসাবে দেখানো হত। বাঁশখালি, চট্টগ্রাম এবং ঢাকায় তাঁর ব্যক্তিগত তথ্যসংগ্রাহক নিয়োজিত ছিল বলে বলা হয়। বাঁশখালীতে ছিল ইসহাক নামে একজন ছিলেন, তাকে বলা হত কুঁ’ড়া ইসহাক, কোন এক সময় সে কুঁ’ড়া (কুকড়া-মোরগ) মার্কায় ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য পদে নির্বাচন করেছিল, সেই স্মরণে। এমপি সাহেবের শুরুতে সরাসরি কোন ইন্টারেকশন না থাকলেও উপজেলা চেয়ারম্যান ও তাঁর অন্য খয়ের খাঁ দের কথা শুনে আমার সংগে তাঁর সম্পর্ক বিরুপ হয়ে যায়।
জুলাই মাসের শুরুতে ঢাকায় ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ লোকাল গভর্নমেন্ট (এন আই এল জি) এ ইউএনও দের উপজেলা পরিষদ ব্যবস্থাপনা কোর্স এর আয়োজন করা হয়। প্রথম বারের মত শুরু করা অনুরূপ প্রশিক্ষনের এটা ছিল তৃতীয় ব্যাচ। ২০ জন উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে এই কোর্সে আহবান করা হয়, আমাদের ব্যাচ এর ৯ জন, এদের মধ্যে মাত্র আমি ও কবির মোঃ আশরাফ আলম ইউএনও পদে যোগদানের পর প্রশিক্ষণে এলাম। আমি যোগদান করেছিলাম ৬ জুন, ১৯৮৮ আর কবির আশরাফ ৭জুন, ১৯৮৮ যোগদান করেন। ৫ বছরের অভিজ্ঞতা প্রসূতজ্ঞান থেকেই এই কোর্সের কারিকুলাম তৈরি করা হয়। একই সংগে ১২ জন কর্মরত ইউএনও এর সংগে ৮ জন হবু ইউএনও এর একত্রে প্রশিক্ষণে অভিজ্ঞতা বিনিময়েরও একটা সুযোগ ছিল। প্রশিক্ষকদের অন্যতম ছিলেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব মোহাম্মদ ফয়েজউল্লাহ ও মন্ত্রীপরিষদ বিভাগের উপসচিব মোঃ ফজলুর রহমান। আমি প্রশিক্ষণ ক্লাশে মোহাম্মদ ফয়েজউল্লাহকে আমার বাঁশখালীতে এক মাসের অভিজ্ঞতা বললাম, ৫ জন ইউএনও এর বদলী এবং উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেটদের ১০ মাস দায়িত্বে থাকার কথা বললাম। বললাম যে স্যার কোন অবস্থাতেই ৫ জন ইউএনও খারাপ হতে পারেন না। আপনাদের উচিত একজন ইউএনও কে ওখানে সেটল হতে দেয়া। আমি ব্যাচেলর, বদলী হলে ব্রিফকেস (তখন ব্রিফকেস এর যুগ) হাতে অন্য স্টেশনে চলে যাব, নইলে কেউ ওখানে কাজ করতে পারবে না। তিনি আমার এই কথা গুরুত্বের সংগে নিলেন যার প্রমাণ আমি পরে পেয়েছি।
প্রশিক্ষণ শেষে ফিরে এলাম স্টেশনে এবং এমপি সাহেবের উপজেলা এজেন্ট এর কাছ থেকে জানা গেল যে আমাকে বদলী করার জন্য চেষ্টা তদবির শুরু হয়েছে। সহকারী জজ সাহেব প্রতিদিন সকালে আমার চেম্বারে আসা শুরু করলেন, আমার চেম্বার থেকে বের হয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান এর চেম্বার, তারপর কোর্ট। আমাকে শিখানোর চেষ্টা করেন উপজেলা চেয়ারম্যান এর সংগে কিভাবে সম্পর্ক ভালো রাখতে হবে, এই উপজেলায় কে কে গুরুত্বপূর্ণ ইত্যাদি। আমার মামাতো ভাই মোঃ গোলাম কিবরিয়া’র মহসিন হল এর সিংগল রুমে তিনি ফ্লোরিং করতেন, সেই সুবাদে তিনি নিজেকে আমার মুরুব্বী ঠাউরে নিয়েছিলেন। আমি বললাম যে আমাদের চাকরীই এই নিয়ে, তাই আমাকে এই জিনিষ শিখানোর তো প্রয়োজন নাই। আমি তাঁর পরামর্শ শুনিনা আর প্রতিদিন উপজেলা চেয়ারম্যান এর সংগে তাঁর শলাপরামর্শ নিয়ে তাঁর সংগে আমার সম্পর্ক শীতল হতে শুরু করলো।
শুরুতেই আমার অভ্যাস মত আমি পুরো উপজেলা ঘুরতে আরম্ভ করি। আগেই বলেছি যে জলকদর খালের কারণে উপজেলার পশ্চিমাংশ প্রায় বিচ্ছিন্ন। খালটি ছিল বেশ বড়, জোয়ারভাটায় বেশ স্রোত থাকতো। খাল পার হবার মত কোন উপযুক্ত সেতু ছিল না। মোশাররফ মিয়ার বাজারে একটা সেতু ছিল, জেলা পরিষদ এর করা যার পাটাতন ছিল না, সিদ্ধান্ত নেই যে এই সেতুটা মেরামত করে শীতেই ওপাড়ে যেতে হবে, বাহারছড়া সি বিচে। দক্ষিণে সম্ভবতঃ নাপোড়া-শেখেরখীল এ একটা সেতু ছিল এটা পার হয়ে প্রায় ৮/১০ কিলোমিটার হেঁটে যাই খুদুকখালী, বাঁশখালী’র অন্যতম “এপল অফ ডিসকরড”। আমার সংগে স্থানীয় চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমানও ছিল। আমি আসার আগে জেলা প্রশাসক আমাকে যে ব্রিফ করেছিলেন সেখানেও খুদুকখালী গুরুত্বের সংগে উচ্চারিত হয়েছিল। শোনা যায় যে প্রায় সব ইউএনও এর বদলীর পেছনে এই খুদুকখালী’র ভূমিকা আছে, খুদুকখালী মোহাজের কলোনী। মোহাজের মানেই হিজরতকারী, বহিরাগত, এই খানে বহিরাগতরা এসেছিল মায়ানমার বা বার্মা মুল্লুক থেকে ১৯৪৭ এর পর। তখন এদেরকে খুদুকখালীতে বসতি করে দেয়া হয় ও ৪৯৫ একর জমি হস্তান্তর করা হয় কিন্তু বুঝাই যাচ্ছিল যে ৪০ বছর পরও স্থানীয় জনগণের সংগে ইন্টিগ্রেশনটা হয় নাই। খুদুকখালীতে মোহাজেরদের দেয়া ১৭৪ একর জমি নিয়েই ছিল মূল বিপত্তি। এর মধ্যে ৪১ একর ছিল যেখানে শীতকালে লবন ও বর্ষাকালে চিংড়ি চাষ হত, এটা ছিল বিবাদের কেন্দ্রবিন্দু। আমি যখন জমিটা হেঁটে হেঁটে সরেজমিনে দেখলাম তখনই আমার মাথায় একটা নিষ্পত্তির চিন্তা আসলো। কিন্তু খুদুকখালী’র নেতৃস্থানীয় মোহাজেররা কেউ আমার সংগে কথা বলতে বা দেখা করতে এলো না।
এর পর আমি এখানকার কিংবদন্তীর কাতেবী মসজিদ দেখতে যাই, একে শপথের মসজিদও বলা হত। কোন বিবাদ নিষ্পত্তির জন্য শপথের প্রয়োজন পড়লে শপথ করার জন্য এই মসজিদের সামনে নিয়ে যাওয়া হত। বিশ্বাস যে কাতেবী মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে কেউ শপথ করে কেউ মিথ্যে বলবে না। কাতেবী পরিবার ছনুয়া এলাকার পুরনো বাসিন্দা এবং সহজেই বোধগম্য যে কিতাব থেকেই কাতেবী। ওই পরিবারের নুরুল ইসলাম কাতেবী তখন বাংলাদেশের প্রধান বন সংরক্ষক। ছনুয়া কুতুবদিয়া চ্যানেলের পারে, ওপারেই কুতুবদিয়া,খালি চোখেই দেখা যায়। কুতুবদিয়া তখন অন্য অনেক কিছুর সংগে মালেক শা হুজুরের জন্যও বিখ্যাত, যিনি পরবর্তীতে ১৯৯১ এর ঘূর্ণিঝড় এর পর আরো পরিচিতি পান।
বাঁশখালীর সবচেয়ে পুরনো মসজিদ বাহারছড়া বখশী হামিদ মসজিদ। এই মসজিদ মুঘল স¤্রাট আওরংজেব এর সময়কালে নির্মিত যদিও মসজিদে সংযুক্ত শিলালিপি অনুযায়ী তা’ পাঠান সুলতান সোলায়মান কররানীর আমলে নির্মিত। এখনকার মতই তখনো আমি প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শনে ও ঐতিহাসিক স্থাপনায় আগ্রহী ছিলাম। একদিন ওই মসজিদ দেখতে বাহারছড়া গেলাম। মসজিদের সামনে স্বাভাবিকভাবেই একটি পুকুর, মসজিদের ঘেরা আংগিনা ও মসজিদের তিন গম্বুজ মুঘল স্থাপত্যের কথা মনে করিয়ে দেয়। মসজিদের মুল দরজার উপরে একটা শিলালিপি ছিল, একটি মই জোগার করা হলে মই বেয়ে উঠে শিলালিপির ছবি নিলাম। বখশী হামিদ মসজিদের উপর অধ্যাপক ডঃ আবদুল করিম এর একটি ছোট পুস্তিকা রয়েছে। অধ্যাপক ডঃ আবদুল করিম বখশী হামিদ নামীয় স্থানীয় সীমান্তরক্ষি/শাসক এই মসজিদ তৈরি করে পাঠান আমলের পুরনো ধবংসপ্রাপ্ত মসজিদের শিলালিপি এখানে ব্যবহার করেছেন বলে মনে করেন। বানীগ্রাম-সাধনপুরের শিখ মন্দির (গুরুদুয়ারা?) ও দশভুজা মন্দির তখনো দেখা না হলেও পুকুরিয়ার বৈল্গ্রাম এর প্রায় পরিত্যাক্ত চা বাগানও তখন দেখতে যাই।