জালাল আহমেদ
জেলা প্রশাসককে জিজ্ঞেস করলাম একজন ফিল্ড অফিসারের সাফল্যের পূর্বশর্ত কি? তিনি বললেন চোখ-কান খোলা রাখা
আইনজীবী শিক্ষক ও সাংবাদিক এই তিন পেশার লোককে সাবধানতার সঙ্গে হ্যান্ডল করতে হবে

ঐ সময়ে সিভিল সার্ভিসে প্রথম সিনিয়র স্কেলে পদোন্নতি পরীক্ষার উদ্যোগ নেয়া হয়। ১৯৮৬ সালে এ বিষয়ে বিধি প্রণয়ন করা হলেও প্রথম পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় ১৯৮৭ সালের আগস্টে। বিসিএস ১৯৮২ বিশেষ ব্যাচের সঙ্গে সিনিয়রিটির বিষয়টি নিষ্পন্ন না হওয়াতে আমাদের ব্যাচ পরীক্ষা দিতে আগ্রহী ছিল না। এ বিষয়ে উচ্চ আদালতে একটি মামলাও করা হয়। হাইকোর্ট মামলা গ্রহণ করলেও পরীক্ষার উপর কোন নিষেধাজ্ঞা প্রদান করেনি। এতে আংশিক সাফল্য লাভ করায় পরদিনই আপীল বিভাগের চেম্বার জজের কাছে রিভিশন দায়ের করার সিদ্ধান্ত হয়। আমি পরীক্ষা দেবার জন্য ঢাকা চলে এসেছিলাম। আমরা চেম্বার জজের কাছে আবেদন করতে যাই, উপস্থিত ৭/৮ জনের মধ্যে আমিও ছিলাম। চেম্বার জজও পরীক্ষার উপর নিষেধাজ্ঞা দিতে রাজী না হয়ে আবেদনটি বিবেচনার জন্য ফুল বেঞ্চে পাঠিয়ে দিলেন। আমাদের মধ্যে দু’ভাগ হয়ে গেল যে পরীক্ষা দেয়া হবে কি না। আমি পরীক্ষার পক্ষে ছিলাম এবং যুক্তি ছিল যে আমরা আপীল বিভাগ পর্যন্ত এসেছিলাম, আপীল বিভাগ যেহেতু পরীক্ষা স্থগিত করে নাই তখন আমাদের দায়িত্ব পরীক্ষা দেয়া। আমি সহ অনেকেই পুরো পরীক্ষা দেই, কেউ কেউ পরীক্ষা শুরু করে বেরিয়ে আসেন।
৬ ডিসেম্বর ১৯৮৭ ফল প্রকাশিত হলে দেখা যায় যে আমি সহ ২৭৫ জন সকল বিষয়ে উত্তীর্ণ হয়েছি। ১ মার্চ ১৯৮৮ আমাদের জ্যেষ্ঠতা সংক্রান্ত আদেশ হয় যাতে ১৯৮২ নিয়মিত ব্যাচের ‘নোশনাল জয়েনিং ডেট’ নির্ধারণ করা হয় ২ এপ্রিল ১৯৮৩। মনে থাকতে পারে, ১৯৮২ বিশেষ ব্যাচের মহিলা ও মুক্তিযোদ্ধারা যোগদান করেছিলেন ৩ এপ্রিল ১৯৮৩। এ আদেশের প্রয়োজন হয়েছিল কারণ ১৯৮২ নিয়মিত ব্যাচের জুলাই ১৯৮৩ সালের ফলাফল ঘোষণার পর প্রথম গ্রুপ যোগদান করে ২৭ অক্টোবর ও অন্যরা জানুয়ারি ১৯৮৪ এবং কোন কোন ক্যাডার আরো পরে। জ্যেষ্ঠতা সংক্রান্ত সাধারণ নিয়মাবলীর একটি বহুল ব্যবহৃত বিধি ব্যবহার করে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ১৩ এপ্রিল ১৯৮৮ তারিখে প্রথমবারের মত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের সিনিয়র স্কেলে পদোন্নতি আদেশ জারি হয় এবং ১৯৮২ নিয়মিত ব্যাচের প্রথম কয়েকজনের সঙ্গে আমিও চাকুরী জীবনের প্রথম পদোন্নতি পাই। আমি সিনিয়র স্কেল প্রাপ্ত হই ২৭ বছর ৩ মাস ১০ দিনে।
এপ্রিল মাসেই অষ্টম ইন্টার ক্লাব শ্যুটিং কমপিটিশন ১৯৮৮ অনুষ্ঠিত হয় ঢাকায়। তখন শ্যুটিং ফেডারেশনের সভাপতি ছিলেন মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। কমপিটিশন উদ্বোধন করেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হোসেইন মোহাম্মদ এরশাদ। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রেজেন্টেশন লাইনে মন্ত্রী আমাকে চাঁদপুর এর এনডিসি হিসেবে চিনতে পারলেন। প্রেসিডেন্ট তো আমাকে চিনলেনই, ডাল খাওয়াতে পারিনি বলে। মন্ত্রী আমাকে বললেন আপনি ইউএনও হিসাবে হাটহাজারী আসেন। আমি বললাম যে স্যার, আমার পোস্টিং হলে তো আপত্তি নাই। ইন্টারক্লাব শ্যুটিং শেষে চাঁদপুরে ফিরে আসার কিছুদিন পর আমার ইউএনও হিসাবে পদায়ন হল আবারো খারাপ যোগাযোগ ব্যবস্থার এক উপজেলা, চট্টগ্রাম জেলার বাঁশখালীতে। এই বদলী ছিল অপ্রত্যাশিত এবং আকস্মিক। জেলা প্রশাসক মহোদয় আশা করেছিলেন যে উনি এ বিষয়ে জানবেন। প্রধানমন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরী চাইলেন চাঁদপুর সদর উপজেলায় আমার পোস্টিং হোক। তিনি এ বিষয়ে জেলা প্রশাসকের সঙ্গে কথাও বললেন, সদর উপজেলা চেয়ারম্যান কাদির মাস্টারও প্রধানমন্ত্রী’র কথায় জেলা প্রশাসকের বাংলোতে এসে কথা বলেন। জেলা প্রশাসক ঢাকায় কথা বললেন। জানা গেল যে ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার ওয়ালিউল ইসলাম এর কথায় আমাকে বাঁশখালীতে পোস্টিং দেয়া হয়েছে, অথচ তাঁকে আমি চিনিও না। জেলা প্রশাসক আমাকে চাঁদপুর সদরে দিতে বললেন, না পারলে মতলব। আমি পড়লাম দোটানায়। আমার কখনোই কোন পোস্টিং চয়েস নাই, শেষ পর্যন্তও ছিল না, কি করি?
তখন ড. সা’দত হুসাইন কুমিল্লায় বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমীর (বার্ড) মহাপরিচালক, চাকুরীর শুরু থেকেই, একাডেমী থেকেই আমাকে ভালো জানেন, ভাবলাম তাঁর পরামর্শ নেই। টেলিফোনে এপয়েন্টমেন্ট করে নিজেই এক বিকেলে গাড়ি চালিয়ে কুমিল্লা রওয়ানা দিলাম। আমার ব্যাচমেট শফিক আলম মেহদী তখন কুমিল্লাতে রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর (আরডিসি), ভাবছিলাম তাঁর ওখানে ইফতার করব। সা’দত স্যার বললেন যে আসবে আমার এখানে আর ইফতার করবে আরেক জায়গায় এটা কেমন করে হয়! ফলে ইফতারের আগে আগে বার্ডে গিয়ে মহাপরিচালকের বাংলোতে হাজির হলাম। ইফতার করলাম, আমার সংকটের কথা স্যারকে জানালাম। তিনি বললেন যে সোজা গিয়ে বাঁশখালীতে যোগদান কর। এখন তুমি এনডিসি আছো, সদরের ইউএনও হল সিনিয়র এনডিসি হবে। দূরের উপজেলা পোস্টিং থাকলে দায়িত্ব নিয়ে কাজ করবে, সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা বাড়বে। রাতের খাবার খেয়ে ফিরে আসলাম। এসে জেলা প্রশাসককে বললাম যে স্যার, আমি বাঁশখালীতেই যোগদান করবো। তদনুযায়ী আমাকে অবমুক্ত করা হল।
আগেরদিন রাতে এলাম জেলা প্রশাসক থেকে বিদায় নিতে। জেলা প্রশাসককে জিজ্ঞেস করলাম যে একজন ফিল্ড অফিসারের সাফল্যের পূর্বশর্ত কি? তিনি বললেন চোখ-কান খোলা রাখা। তিনি বললেন যে মানুষকে শুনতে হবে, সে কষ্ট করে আসেই কিছু বলতে, তাই শোনার ধৈর্য রাখতে হবে, এতেই সে অর্ধেক খুশি। এছাড়া আইনজীবী, শিক্ষক ও সাংবাদিক এই তিন পেশার লোককে সাবধানতার সঙ্গে হ্যান্ডল করতে হবে। আমিও সবসময় তাই খোলা দরজা নীতি অনুসরণ করেছি, এতে ক্ষতির চাইতে লাভ বেশি। বিশেষ করে ফরিদপুরে জেলা প্রশাসক থাকাকালে শাব্দিক অর্থেই দরজা খোলা রাখতাম। তিনি জিজ্ঞেস করলেন যে যাচ্ছো কিভাবে? আমি বললাম যে স্যার, আগামীকাল ভোরের ট্রেনে, চাঁদপুর থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত মেঘনা ছিল ভোর ৫টায় ছেড়ে যাওয়া একটা সুবিধাজনক ট্রেন। স্যার বললেন যে এভাবে এতো ভোরবেলা স্টেশন থেকে বিদায় নিয়ে যাবে, কেমন দেখায়? এডিসি জেনারেলকে বললেন জালালকে একটা গাড়ি দিয়ে দেন, নামিয়ে দিয়ে আসুক। এডিসি জেনারেল স্মার্ট, আমি বিদায়ী কর্মকর্তা, আমাকে গাড়ী দেন কিভাবে? তিনি সঙ্গে যাবার জন্য ৮৫ ব্যাচের মোঃ কামাল উদ্দিন তালুকদার ও জিয়াউদ্দিন আহমেদকে বলে দিলেন। কামাল সচিব হিসাবে অবসরে গিয়েছে আর জিয়া ঢাকা ছেড়ে থাকতে পারতেছিল না বলে চাঁদপুর থেকেই চাকুরী ছেড়ে দেয়, এখন নিউইয়র্ক এর বাসিন্দা, আমি গেলেই দেখা হয়। ভোরের ট্রেনে নলিনী রঞ্জন বসাকেরও চট্টগ্রাম যাবার কথা, তাঁকে বললাম স্টেশনে অপেক্ষমান বাঁশখালী উপজেলা’র জীপ ড্রাইভারকে যেন স্টেশনেই অপেক্ষা করতে বলে।
পরদিন ভোরবেলা জেলা পুলের গাড়ি নিয়ে রওয়ানা হলাম, আমি চালাচ্ছি, পাশে ৮৫ ব্যাচের কামাল ও জিয়া। তখন ফেনী বাইপাস নতুন হয়েছে, ভোরবেলা রাস্তাও অনেক ফাঁকা, ফলে ১০টার দিকে চট্টগ্রাম পৌঁছে গেলাম। গেলাম সরাসরি চট্টগ্রাম রেলস্টেশনে, এখন যেটা পুরাতন ভবন, চৈতন্যগলি কবরস্থানের উল্টোদিকে। স্টেশন প্রাঙ্গণে গাড়ি নিয়ে ঢুকে উপজেলার সবুজ গাড়ি দেখে জিজ্ঞেস করলাম যে এটা বাঁশখালী’র গাড়ি কি না, ড্রাইভার হ্যাঁ সূচক জবাব দিলে তাঁকে অনুসরণ করতে বললাম। গেলাম পরীর পাহাড়ে (ভধরৎু যরষষং) অবস্থিত জেলা প্রশাসক কার্যালয়, কোর্ট বিল্ডিং এ। বাঁশখালী’র ড্রাইভারকে সেখানে অপেক্ষা করতে বলে আমরা তিনজন উঠে গেলাম কোর্ট বিল্ডিং এর দোতলায়, জেলা প্রশাসক এর ফ্লোরে। জেলা প্রশাসক তখন লাস্ট ব্যাচের সিএসপি এম এ মান্নান। স্যারের সঙ্গে দেখা করলাম। এর আগে তিনি গৌরনদীর ইউএনও, কিশোরগঞ্জ এবং ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক ছিলেন। অসাধারণ স্মৃতি শক্তির অধিকারী এবং ভদ্রলোক বলে তাঁর খ্যাতি ছিল এবং এখনো তা অক্ষুন্ন। জেলা প্রশাসক এবং অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মহোদয়গণের সঙ্গে দেখা করার পর নেমে আসলাম। এরমাঝে প্রায় দুপুর। নীচে নেমে আবার ড্রাইভারকে বললাম অনুসরণ করতে, এলাম জিইসি মোড়ে, ওখানে ওয়াংচাই রেস্টুরেন্টের সামনে গাড়ি রেখে বাঁশখালী’র ড্রাইভারকে খাবার টাকা দিয়ে আমরা তিনজন দোতলায় উঠে গেলাম লাঞ্চ করতে।