জালাল আহমেদ
বৃটিশ ভদ্রলোক মৃত্যুর আগে উইলে বাঙালি বাবুর্চির জন্য আর্থিক অনুদান রেখে গিয়েছিলেন, সেই টাকা বৃটিশ হাই কমিশন তার কাছে পৌঁছে দেয়
ন্যাশনাল ব্যাংকের ম্যানেজার সুলতান আমার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলেন

জেলা প্রশাসকের বাংলোতে অফিস রুমে রাতে ঘুমাতো অবসরপ্রাপ্ত নাইটগার্ড আব্দুর রশিদ। সে সন্ধ্যার পর চলে আসতো রাতে ঘুমানোর জন্য, সকালে আবার চলে যেতো। রশিদ ৪০ বছর চাকুরী করার পর ১৯৭৬ বা ১৯৭৭ সালে অবসর নিয়েছে কিন্তু বাংলোতে রাতে ঘুমিয়ে যে অভ্যাস হয়েছিল তা ছাড়তে পারেনি তাই অবসরের ১০ বছর পরেও ডিউটি করে যাচ্ছিল। একবার বৃটিশ হাইকমিশন থেকে যোগাযোগ করা করা হল একজন বেনিফিশিয়ারীকে খুঁজে দিতে। এক বৃটিশ ভদ্রলোক চাঁদপুরে ডিএসপি ছিলেন ১৯৪৬ সালে, তিনি মারা গিয়েছেন কিছুদিন আগে। চাঁদপুরে থাকতেন ডাকাতিয়া নদীর ওপারে ডাব্লিও রহমান জুট মিলের জিএম থাকেন যে বাংলোতে, সেখানে। মৃত্যুর আগে উইলে তিনি তাঁর বাবুর্চির জন্য দেড় হাজার পাউন্ডের কাছাকাছি রেখে গিয়েছেন, সেই বাবুর্চিকে খুঁজে বের করতে হবে। রশিদ তাকে মনে করতে পারলো এবং পরবর্তীতে তাকে খুঁজে জীবিতও পাওয়া গেল। বৃটিশ হাইকমিশনের প্রতিনিধি চাঁদপুরে এসে তাকে এই টাকা হস্তান্তর করলো। অত্যন্ত সদাচারী ও মৃদুভাষী রশিদের কথা মনে পড়ে, তাঁর সঙ্গে ১৯৮৯ এর পর আর দেখা হয়নি।
একদিন সন্ধ্যায় জেলা প্রশাসকের বাংলো অফিসে বসে আছি, সামনে এসে একটা কার থামলো। উঠে বের হয়ে গেলাম, কার থেকে বের হয়ে এলেন ড. আব্দুস সাত্তার, ১৯৬০ ব্যাচের বিখ্যাত সিএসপি, বঙ্গবন্ধুর আমলে স্বাস্থ্য সচিব ছিলেন। গাড়ি থেকে নেমে গাড়ির পেছনে বুট খুলছেন, বুট থেকে বের হলো বাঁশের তৈরী এক চাঙ্গারী, উপরে খবরের কাগজ দিয়ে মোড়ানো। ভেতরে আছে মেহার কালীবাড়ির বিখ্যাত জিলিপি। এর মধ্যে জেলা প্রশাসক মহোদয় এসে গেছেন, তিনি বলছেন যে স্যার, এগুলো কেন নিয়ে আসতে গেলেন? সাত্তার স্যার বললেন যে কালেক্টরের সঙ্গে খালি হাতে দেখা করা যায় না, তাই নজরানা! নজরানা এক প্রাচীন পদ্ধতি, নজরে আসার জন্য নজরানা ছিল আবশ্যকীয়। ১৯৮২ সালে দিরাই উপজেলাতে ১৯৭৩ ব্যাচের এক অফিসার প্রথম ইউএনও হয়ে গেলে দিরাই এর এক সম্ভ্রান্ত পরিবার ইউএনওকে তাঁদের পারিবারিক ঐতিহ্য বলে এমন নজরানা দিয়ে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছিল।
যাই হোক, সাত্তার স্যারের সঙ্গে তাঁর বাবা মেহার পঞ্চগ্রাম খ্যাত আজিজুর রহমান পাটওয়ারীও ছিলেন। তাঁরা বসা অবস্থায়ই এলেন মতলব জেবি পাইলট হাইস্কুলের বিখ্যাত প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক ওয়ালীউল্ল্যাহ পাটওয়ারী। দুই প্রবীন একজন আরেকজনকে পেয়ে খুব খুশি হলেন আর নিজেরা গল্প করতে লাগলেন। সাত্তার স্যারের ছবি তোলার হবি ছিল, তিনি উভয়ের ছবি তুলতে লাগলেন। আজিজুর রহমান পাটওয়ারীর একটি গ্রামোন্নয়ন উদ্যোগ ছিল মেহার পঞ্চগ্রাম। সিরাজুল ইসলাম নামে একজন সাংবাদিক থেকে শুল্ক কর্মকর্তা বনে যাওয়া গবেষক তাঁর পিএইচডি করেছেন এই উদ্যোগের উপর। আর ওয়ালীউল্ল্যাহ পাটওয়ারী বিখ্যাত শিক্ষাবিদ, তিনি ১৯৩০ সালে সহকারী শিক্ষক হিসেবে মতলব জেবি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে যোগদান করেন এবং ১৯৭১ পর্যন্ত ৪০ বছর তিনি প্রধান শিক্ষক ছিলেন। ১৯৭১ থেকে আমৃত্যু, ১৯৯৯ পর্যন্ত ছিলেন একই স্কুলের রেক্টর অর্থাৎ ৭০ বছর যুক্ত ছিলেন এই স্কুলের সঙ্গে।
আমরা গাধা পিটিয়ে মানুষ করার গল্প শুনেছি, তখন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বিখ্যাত মানুষেরাও তাঁদের সন্তানদের ওয়ালীউল্ল্যাহ পাটওয়ারীর কাছে মানুষ করতে দিয়ে যেতেন। তাঁর ছাত্ররা তখন সারা পূর্ব পাকিস্তানে প্রথম হয়েছে। তিনি ১৯৬১ সালে তমঘায়ে খিদমত, ১৯৮১ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার ছাড়াও ছয় বার সেরা প্রধান শিক্ষকের পুরস্কার পেয়েছেন। সাত্তার স্যারও মৌলভীবাজার ও নারায়ণগঞ্জে এসডিও ছিলেন। কথিত আছে যে বালিকা বিদ্যালয় পর্যায়ে যে উপবৃত্তি এটি তাঁর অবদান, তিনি তাঁর এলাকায় এটা শুরু করেন। ১৯৮৬ সালে শাহরাস্তি ও কচুয়া উপজেলার সকল মেয়ে উপবৃত্তি পেত। ড. সাত্তারের স্ত্রী এলেন সাত্তার এর জার্মানি থেকে সংগৃহিত তহবিলে এই বৃত্তি প্রদানের কাজ শুরু হয়। আমি ড. সাত্তারকে জিজ্ঞেস করলাম যে স্যার, এত উঁচু পদে থেকেও কিভাবে গ্রামের গরীব দুঃখী মানুষের কথা, তাদের উন্নয়নের কথা মনে রাখতে পারেন? তিনি বললেন যে আমাদের বাড়িতে একটার বেশি দুইটা ভালো লুঙ্গী ছিল না, আমার বাবা সেটা পরে বাজারে গেলে আমি তাঁর ফিরে আসার অপেক্ষা করতাম। তাঁর বাবা ছিলেন গ্রামের বাজারে দর্জি। তিনি যখন সিভিল সার্ভিস অফ পাকিস্তান এর সদস্য হিসাবে লাহোর সিভিল সার্ভিস একাডেমীতে যোগদান করতে যাবেন তখন সারা গ্রামের লোক চাঁদা তুলে বিমান ভাড়া ও অন্য খরচের জন্য ৫০০ টাকা দিয়েছিলেন। স্যার বললেন যে আমি কিভাবে একথা ভুলে থাকতে পারি? আসলে আমরা অনেকেই এ সব বাস্তবতা ভুলে যাই এবং চেষ্টা করি শুধু নিজের উন্নয়নের কিন্তু মহৎ ব্যক্তিরা নিজেদের চেষ্টায় মানুষের ভাগ্য বদলে দেন! ড. সাত্তার ছবি তুলেন, তিনি এলেন চাঁদপুর কলেজের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী বা এ ধরণের কোন অনুষ্ঠানে, তিনি স্টেজ থেকে একটি মেয়ের লম্বা চুল অনুসরণ করছিলেন, এক পর্যায়ে স্টেজ থেকে নেমে এলেন, এসে ঐ মেয়েটির চুলের ছবি তুললেন, বললেন যে তাঁর মেয়েদের চুলও লম্বা ছিল কিন্তু পরে কেটে ফেলা হয়েছে। সেই লম্বা চুলের মেয়েটি ফারাহ দিবা আহমেদ,পরে আমার স্ত্রী হয়েছেন। এটি তাঁর একটি সুন্দর স্মৃতি।
ঐ সময়ে চাঁদপুরে তিনজন ব্যাংক ম্যানেজার অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছিলেন। অগ্রণী ব্যাংকের মুজিবুর রহমান স্বপন, জনতা ব্যাংকের জসিম উদ্দিন এবং ন্যাশনাল ব্যাংকের সুলতান আহমেদ। আমার সঙ্গে তিনজনেরই সুসম্পর্ক ছিল। আমার অনুরোধে সুলতান সাহেব চাঁদপুর ক্লাবের ক্লে কোর্টকে হার্ড কোর্ট করে দিয়েছিলেন। কিন্তু আমি কোন সহায়তা করতে পারছিলাম না। ব্রুনাই এর ধর্মমন্ত্রীর ফরিদগঞ্জ সফরের পর ফরিদগঞ্জ এর দুই মাদ্রাসার উন্নয়নের জন্য ১০ কোটি টাকার তহবিল এল। সেই টাকা আমি জেলা প্রশাসককে বলে জমা রাখার ব্যবস্থা করলাম ন্যাশনাল ব্যাংকে। এহেন সুলতান এলো আমার কাছে আমার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে, ফারাহ দিবা’র সাথে। আমার ব্যাচমেট বন্ধু আমিনুর রহমান তখন ডেপুটি কমিশনার (ট্যাক্স) চাঁদপুর, আমার ব্যবসায়ী শ্বশুর এর সঙ্গে ভালো সম্পর্ক। আমিনুর রহমানের বাসায় আমি প্রথম আমার স্ত্রীকে দেখি।
চাঁদপুর এর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মোঃ আফজাল হোসেইন আমাকে খুব স্নেহ করতেন, তাঁর স্ত্রীর সঙ্গেও আমার খুব ভালো সম্পর্ক ছিল কারণ তিনি আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগে আমার সিনিয়র, আমরা ছিলাম সতীর্থ। স্যার এবং ভাবি আমার শ্বশুরবাড়িতে গেলেন এবং ফিরে এসে আমাকে বললেন যে আমার স্ত্রীকে তাঁদের পছন্দ হয়েছে, আমি এগুতে পারি। পরে স্যারের বাসায় আবার তাঁকে দেখি। আমার শ্বশুর আমির হোসেন খানও নিয়মিত ক্লাবে আসতেন মূলতঃ বসে আমাদের খেলা দেখতেন ও ডিম-মুড়ি-চানাচুর মাখা খেয়ে ফিরে যেতেন। উনি প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে মেলামেশা করতেন, রোটারী ক্লাব এবং লায়ন্স ক্লাবের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। মহকুমা যুগে মহকুমা প্রশাসক আখতার হোসেন খানের সঙ্গেও তাঁর ভালো সম্পর্ক ছিল বলে তিনি বলেছেন। কিন্তু বিয়ের বিষয়ে তেমন বাস্তব অগ্রগতি হবার আগেই আমার যাবার সময় হয়ে গিয়েছিল এবং আমি চাঁদপুর থেকে বদলী হয়ে চলে যাই।