আমিনুর রশীদ এমরান
একটি নক্ষত্রের পতন
কামাল এম মোস্তফা, মিশিগান, যুক্তরাষ্ট্র
কি লিখব? এমনিতেই করোনার দ্বিতীয় পর্বের তান্ডবে মিশিগান অঙ্গরাজ্যের অনেক বাঙালি আক্রান্ত। বয়স্ক মানুষরা একে একে না ফেরার দেশে চলে যাচ্ছে। প্রতি সপ্তাহে স্থানীয় মসজিদে দু তিনটি জানাজার নামাজ হচ্ছে। এই প্রিয় মানুষগুলোকে গত দুই যুগ কাছে থেকে দেখেছি। আজ তাঁরা চিরদিনের জন্য বিদায় নিচ্ছেন। সঙ্গত কারণেই মন মানসিকতা ভালো নেই। তার উপর বিভিন্ন ধরনের অসুখ বিসুখ ও মানসিক চাপে জীবন বিপর্যস্ত। কখন নিজের ও চলে যাই, একমাত্র আল্লাহই জানেন। ইচ্ছে থাকলেও অনেক কিছু স্বাভাবিকভাবে করতে পারছি না।
মৃত্যু অবধারিত সত্য। যে কোন ধর্ম বর্ণ গোষ্ঠীর জন্য তা নির্ধারিত। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে জীবনের পূর্ণতা পায় ও পরিসমাপ্তি ঘটে। সাধারণত পরিপূর্ণ বয়সে মৃত্যুবরণ হলে সেটা মেনে নেয়া যায়। কিন্তু অকালে চলে যাওয়া, অসময়ে চলে যাওয়া যে কতো কষ্টের। তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউই বুঝতে পারে না। যার যায় সেই বুঝে কি অসহনীয় যন্ত্রণা। যার শুরু আছে শেষ নেই। করোনা মহামারী কালে আমরা দেশে বিদেশে এমন অনেক মানুষকে হারিয়েছি। মনকে শান্তনা দিয়েছি তাঁর আয়ু শেষ বলে। নিঃসন্দেহে আল্লাহর হুকুমে তার মৃত্যু হয়েছে। যদি একই এলাকায় প্রতি সপ্তাহে চার পাঁচজন মৃত্যুবরণ করে তখন যেন কেমন লাগে?
তেমনি একটি মৃত্যু আমিনুর রশীদ এমরান। আমার লেখার পাঠকদের তথা হবিগঞ্জ জেলাবাসিকে তাকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার মতো কিছু নেই। জাতীয়তাবাদী ঘরানার মানুষসহ সকল দলের মানুষ তাকে এমরান নামেই ডাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। হবিগঞ্জ জেলায় বিএনপি ও ছাত্রদলের রাজনীতিতে সে অনেক পদই অলঙ্কৃত করেছে। পদের কথা লিখে আমার লেখার কলেবর বৃদ্ধি করতে চাই না। সে একাধারে ছিল রাজনৈতিক নেতা ও ক্রীড়ামোদী। রাজনৈতিক ময়দানের পাশাপাশি খেলাধুলার জগতেও ছিল তার ঈর্ষণীয় পদচারণা। যদিও তার সাথে আমার রাজনৈতিক ও খেলাধুলার জগতে কোন পূর্ব পরিচয় ছিল না। কিন্তু তৎকালীন সময়ে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় তার এসব কর্মকান্ড আমার চোখ এড়াতো না। উপরন্তু একই জেলার বাসিন্দা হওয়ায় তার ব্যাপারে অনেক খবরাখবর জানতে পারতাম। বিশেষ করে এরশাদ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে বর্তমান সরকার বিরোধী আন্দোলনে তার নির্ভীক ও সাহসি ভূমিকা সর্বজন স্বীকৃত। আমি ১৯৯৭ সালের শেষের দিকে দেশান্তরী হই। তখনকার যোগাযোগ ব্যাবস্থা এখনকার মতো সহজলভ্য ছিল না। পত্র পত্রিকাও অনলাইনে ছিল না। ছিল না কোন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। তাই অনেক খবরাখবর থেকে যায় আমার অগোচরে। এরশাদ পতনের পর জাতীয়তাবাদী দল দু টার্ম ক্ষমতায় ছিল। ১৯৯১ ও ২০০১ সালে। মাঝে ১৯৯৬ সালে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় থাকে। বিএনপি ক্ষমতায় গেলে তার অধিকাংশ নেতাকর্মীরা ও উদরপূর্তি নিয়ে ব্যস্ত থাকে। কিসের নিয়ম, কিসের অনিয়ম দলের নাম ভাঙিয়ে অনেকেই তখন আঙ্গুল ফুলে বটগাছ। চোখের সামনে দেখতে পেলাম আমাদের সমবয়সি কথিত নেতারা বড় ভাই ডেকে ডেকে অতি সঙ্গোপনে আখের গুছিয়ে নিয়েছে। জেলা শহরে অনেকেই বাসাবাড়ি করে ফেলেছে। বড় ভাই মন্ত্রীদের তৈল মেরে, মেকি আত্মীয়তার ফাঁদ পেতে ঢাকায় ফ্লাট বাড়ি গাড়ি করে ফেলেছে। রাগ করবেন না এই চিত্র শুধু হবিগঞ্জের নয়। প্রতিটি জেলার বড় ভাইয়েরা যার যার এলাকার মন্ত্রীদের দিয়ে এমন কাজ করিয়েছে। মন্ত্রীদেরও না করে উপায় নেই। এলাকায় বড় ভাই মন্ত্রীর রাজনীতির কেন্দ্র বিন্দু। তাকে ছাড়া মন্ত্রী সাহেব এলাকায় অচল। এটি হচ্ছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আবহমান কালের ঐতিহ্য। যাকে আমরা চেইন অব কমান্ড বলি। যার ধারাবাহিকতার বাহিরে বর্তমান সরকারও যেতে পারছে না। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে যত দলই ক্ষমতায় এসেছে কেউই এ বৃত্তের বাইরে যেতে পারেনি।
জনকল্যাণে সরকার নিয়োজিত না থেকে থেকেছে শুধু দলের নেতাকর্মীদের কল্যাণে। যে আকাক্সক্ষা নিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছিল সে আকাক্সক্ষা আজো অধরা। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার শুধু নামে আছে। কার্যত জন আকাক্সক্ষার প্রতিফলন কোন সরকারের আমলেই পুরোপুরি ঘটেনি। (যে মাত্রায় ও গতিতে দলের নেতাকর্মী ও চামচা লাভবান হয়, সে মাত্রায় জনগণ হয় না) যা হচ্ছে তাঁর সুফল দল নির্ভর। দলের নেতাকর্মীদের ভাগ্য বদল হয়। সাধারণ মানুষের হয় না। দলীয় নেতানেত্রীর ভাগ্য সদা সর্বদা সুপ্রসন্ন। যে কারণে দিনে দিনে সাধারণ মানুষ রাজনীতি বিমুখ হয়ে পড়ছে। তাদের মুখে এক কথা, “লঙ্কা যে যায় সেই রাক্ষস”। ক্ষমতার পালাবদলে আমাদের কিছু যায় আসে না। আজ এ সরকার তো কাল আরেক সরকারের নেতাকর্মীরা খাবে। যে কারণে সরকার পরিবর্তনে সাধারণ মানুষের আগ্রহ কমে গেছে। একমাত্র রাজনৈতিক সুবিধাভোগী ছাড়া কেউ পরিবর্তনের ঝুঁকি নিতে চায় না। তাই বাংলাদেশের রাজনীতি না করা বিশাল জনগোষ্ঠী দিনে দিনে ভোটের আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। অবশ্য এক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনদের মেকানিজম নিয়েও অনেক অভিযোগ রয়েছে। এ নিয়ে একটি গবেষণা হওয়া দরকার। স্থানীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে এ চিত্র ভিন্ন। অসৎ প্রার্থীরা সামান্য নগদ নারায়নের মাধ্যমে গরিব মানুষদের ভোটে নিয়ে আসে। অনেকে আবার তার আত্মীয়তার খাতিরে, গোষ্ঠীর টানে অথবা আঞ্চলিকতার কারণে ভোট প্রদান করে। এমরান এর কথা লিখতে গিয়ে সঙ্গত কারণেই এ লেখা চলে এলো। এমরান যে পর্যায়ের নেতা ছিল যদি তার সরকারের দু টার্ম মন্ত্রীদের জন্য খাটি সরিষার তৈল নিয়ে ঢাকা দৌড়াদৌড়ি করত তাহলে সে অনায়াসে বাকি জীবন সুন্দরভাবে কাটিয়ে দিতে পারতো। কিন্তু সে তা করেনি। আমেরিকায় এসেও কঠিন পরিশ্রম করে বৈধ উপার্জন করেছে।